ভারতের শীতল মরুভূমি লাদাখে বাড়ছে উষ্ণতা। এদিকে করোনাভাইরাস অতিমারীর কবলে দেশ, ওদিকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পার করে ভারতের মাটিতে অনুপ্রবেশ করেছে চিন। সোমবার গালওয়ান উপত্যকায় ২০ জন ভারতীয় সৈনিকের মর্মান্তিক মৃত্যু, যা ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষে ৪৫ বছরের মধ্যে প্রথম, বলে দিচ্ছে সমস্যা কতটা বৃহৎ, এবং সামনের পথ কতটা কঠিন।
সহজ হবে না এই সফর, প্রয়োজন পড়বে একতা এবং দৃঢ় সঙ্কল্পের। বিগত প্রায় তিন দশক ধরে, সেই ১৯৮৮ সাল থেকেই ভারত-চিন সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে বেশ কিছু বলিষ্ঠ কূটনৈতিক পদক্ষেপ, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই রয়ে গেছে এই ক্ষত। একদিকে বিশ্বের তামাম বিজ্ঞানী এবং সরকার দিনরাত এক করে করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় ব্যস্ত, লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রিয়জন হারানোর আশঙ্কায় বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন হাসপাতালের ওয়ার্ডে, এদিকে স্পষ্টতই সেই সঙ্কটকে পরিণত করেছে কৌশলগত মওকায়, এবং সুযোগ নিয়েছে ভূ-রাজনৈতিক বিক্ষিপ্ততার।
বেইজিং যেন চারিদিকে পরীক্ষা করে বেড়াচ্ছে সুন জ়ু-এর সেই পরিচিত অনুশাসন বাক্য, যুদ্ধের চরম উদাহরণ হলো বিনা লড়াইয়ে শত্রুকে দমন করা। পারাসেল দ্বীপমালার কাছে ভিয়েতনামের জেলে নৌকা আটক করেছে চিন; বিতর্কিত দ্বীপমালার শাসনকার্য চালাতে দুটি নতুন পুর জেলা গঠন করেছে; দক্ষিণ চিন সমুদ্রের ৮০টি ভৌগোলিক এবং সমুদ্রগর্ভস্থ বৈশিষ্ট্যের নাম প্রকাশ করেছে চিনা ভাষায়; একাধিক দেশের বিরুদ্ধে জারি করেছে মাছ ধরার ওপর স্থগিতাদেশ; মালয়েশিয়ার স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক জোনে প্রবেশ করেছে; তাইওয়ান প্রণালীর মধ্যবর্তী সীমা অতিক্রম করেছে; এবং ফিলিপিনসের বাণিজ্যিক জাহাজকে হয়রান করেছে।
আরও পড়ুন: শুধু কোভিড নয়, সঙ্গে ঘাড়ের ওপর চিন
আমাদের আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিনিময়ে আর শান্তির বাণী শুনিয়ে যেতে পারি না আমরা। 'উহান স্পিরিট' এবং মহাবলিপুরম বৈঠকের আড়ালে গুরুতর রকমের অনুপ্রবেশ করে আমাদের ক্ষতিসাধন করেছে চিন।
হট স্প্রিংস এবং গালওয়ান এলাকায় ঠিক কী ঘটেছে, তা নিয়ে অস্বাভাবিক রকমের সংযতবাক্ আমাদের সরকার। 'ফিঙ্গার ৮' এলাকায় যে তাদের নিয়মিত টহলদারি করতে দেওয়া হয় নি ভারতীয় সেনাকে, যা কয়েকদিন আগে পর্যন্তও অবাধে করছিল তারা, এটি সত্যিই অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ঠিক একইভাবে ১৯৯৯ সালে লাহোর বাসযাত্রার পর যে উল্লাসের সৃষ্টি হয়েছিল, তা কার্গিলে পাকিস্তানি অনুপ্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে নিমেষে উবে যায়। আমরা অ-প্রস্তুত ছিলাম ঠিকই, তবে ভারতীয় সেনা দুর্দমনীয় সাহস এবং ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সেবার ফিরিয়ে দেয় পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের।
এখনও, যখন পূর্ব লাদাখে একাধিক বাধা পেরিয়ে ঢুকে পড়েছে চিনা বাহিনী, তখনও ভারত-চিন সম্পর্ক নিয়ে সেই একই আত্মপ্রসাদ চোখে পড়ছে।
প্রশ্নটা হলো: কেন এবং কীভাবে? নানারকম ত্রুটি-বিচ্যুতি সংক্রান্ত যেমন একটি পরামর্শ তালিকা বানিয়েছিল কার্গিল পর্যালোচনা কমিটি, তেমনই আরেকটি কমিটির প্রয়োজন, বর্তমান সময়ের সম্ভাব্য বিচ্যুতি চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে। আমাদের জানা দরকার, কেন দেশকে সব কথা জানানো হচ্ছে না। কেন কথা বলা হয় নি বিরোধী দলগুলির সঙ্গে? চিনা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে মতের আদানপ্রদানে উৎসাহ দেওয়া উচিত ছিল সরকারের। আমাদের প্রত্যেকের কাছেই কিন্তু দেশের স্বার্থ সবার উপরে।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে চিনা অনুপ্রবেশ, অভিসন্ধি বোঝা জরুরি
কৌশলগত দিক থেকে দেখলে লাদাখের গুরুত্ব অপরিসীম। কার্গিল যুদ্ধ এখানেই হয়, সিয়াচেন হিমবাহ বা গ্লেসিয়ারের তুষারাবৃত চড়াইও এই অঞ্চলে অবস্থিত। ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের শাসনকালে 'অপারেশন মেঘদূত'-এর মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করে এই হিমবাহ, যা হিমালয়ের প্রতিকূল ভৌগোলিক পরিবেশে দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। এই হিমবাহের পশ্চিমে রয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত গিলগিট-বালটিস্তান, পূবে চিন-অধিকৃত আকসাই চিন।
সিয়াচেনে ভারতীয় সেনার মজবুত উপস্থিতি এটুকু নিশ্চিত করেছে যে এই স্থানটি সুরক্ষিত। বস্তুত, কার্গিল যুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীদের হঠাতে ব্যস্ত ভারতীয় সেনা, সেই সুযোগে প্যাংগং লেকের পাড় ধরে ভারতের ভূখণ্ডের ভেতরে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা বাড়িয়ে নেয় চিন। পাকিস্তানের নীতি হলো "হাজারটা ক্ষত থেকে ভারতের রক্ত ঝরানো", ওদিকে চিন একটু একটু করে জমি খুবলে নেওয়ার পন্থা অবলম্বন করেছে, "প্রকৃত রেখার ধারণা"কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে।
যতক্ষণ না তাদের ঠেলে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতের দিকে এগিয়ে আসার যেন কোনও সীমা নেই চিনের। চিনা প্রশাসনের ঘোষিত লক্ষ্য হলো 'মিডল কিংডম' বা 'মধ্যবর্তী রাজত্ব' পুনরুদ্ধার করা, কারণ তাদের দাবি, এই রাজত্ব তাদের দুর্বল সময়ে তারা খুইয়েছে বিদেশি শক্তির কাছে। পঞ্চাশের দশকে মাও সে তুং বলেছিলেন যে তিব্বত (শিজাং) হলো চিনের ডান হাতের তেলো, যা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তার পাঁচটি আঙুলের থেকে - লাদাখ, নেপাল, সিকিম, ভুটান এবং NEFA (অরুণাচল)।
চিন চায়, নিজেদের শর্তে সীমান্ত বিতর্কের নিষ্পত্তি করতে। ভারত ছাড়া বাকি সমস্ত পড়শি দেশের সঙ্গে সীমান্ত বিতর্ক মিটিয়ে ফেলেছে তারা। দুটি বা তার বেশি ঘরোয়া বৈঠক করে আত্মপ্রসাদ লাভ করার কোনও কারণ নেই। এই প্রেক্ষিতে উদ্বেগজনক কৈলাস-মানসরোবরের পথে লিপুলেখ পাস সম্পর্কে নেপালের যুদ্ধং দেহী মনোভাবও। নেপালের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরলে আমাদের কূটনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এবং চিনের বিরাট সুবিধে। ভারতের উচিত, সবরকম কূটনীতিক প্রয়াস করা, যাতে নেপালের সঙ্গে "রোটি-বেটি"র সম্পর্ক অব্যাহত থাকে। ওদিকে চিন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও এক বিপদ, 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (Belt and Road Initiative বা BRI), এবং লুণ্ঠনমূলক ঋণ কূটনীতি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের বাড়তে থাকা প্রতিপত্তি হয়ে উঠেছে চিনের চক্ষুশূল।
এই যেখানে পরিস্থিতি, সেখানে পড়শি রাষ্ট্র এবং পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক মজবুত করতে তৎপর থাকুক ভারত। পৃথিবীর শক্তিশালী দেশগুলির মধ্যে একমাত্র চিনই হলো অগণতান্ত্রিক। ভারতকে ভেতর এবং বাইরে থেকে দুর্বল করে তুলতে কোনোরকম চেষ্টার ত্রুটি তারা রাখবে না।
যে কোনও মূল্যে দেশের সাম্প্রদায়িক সংহতি বজায় রাখতেই হবে, সঙ্গে থাকবে সাম্য এবং সচ্ছলতা। কেউ যাতে আচমকা আঘাত হানতে না পারে, তার জন্য তৎপরতার সঙ্গে দেখতে হবে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির বিষয়টি। এবং অকস্মাৎ কিছু ঘটলে বারুদ যাতে শুকনো থাকে, তাও দেখতে হবে, কারণ প্রতিক্রিয়া হতে হবে দ্রুত।
পরিশেষে, পূর্ব লাদাখে যেখানে অনুপ্রবেশ ঘটেছে, সেখানে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা থেকে এক ইঞ্চিও সরব না আমরা। চিনকে বুঝতে হবে যে ভয় দেখিয়ে সফল হওয়ারও সীমা আছে। ড্রাগন যতই মুখ দিয়ে আগুন ঝরাক, হাতি শুঁড়ে করে জল ঢেলে তা নিভিয়ে দিতে পারে। আমাদের সৈন্যদের মর্মান্তিক মৃত্যু যেন বৃথা না যায়।
(লেখক লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন