২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী তখন সবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। চিন সরকার ভারত থেকে কতিপয় সাংবাদিকদের এক প্রতিনিধি দলকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে বেইজিং-সাংহাই নিয়ে গেল। প্রবীণ সাংবাদিক ডঃ স্বপন দাশগুপ্ত ছিলেন আমাদের প্রতিনিধি দলের কাণ্ডারী। মনে আছে, রওনা দেওয়ার আগে দিল্লি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে স্বপনদা বলেছিলেন, "জানো তো, এর আগে কখনই চিনে যাই নি।" বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কেন? তুমি তো গোটা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছ। তা চিন কেন যাও নি?"
শুনলাম, চিন কখনোই ওঁকে ভিসা দেয়নি। তাইওয়ান অবশ্য একাধিকবার ওঁকে সে দেশ দেখাতে নিয়ে যায়। অনেকেরই ধারণা, পাসপোর্টে তাইওয়ানের ভিসার ছবি থাকলে চিন সেই ব্যক্তিকে, বিশেষত কোনও ভারতীয়কে, তাদের দেশের ভিসা দেয় না। তার ওপর স্বপন দাশগুপ্ত ভারতের অন্যতম দক্ষিনপন্থী পাবলিক ইনটেলেকটচুয়াল। তাহলে ২০১৪ সালের পর এমন কী ঘটল?
আজ স্বপনবাবু রাজ্যসভার সদস্য, বিজেপির বিশিষ্ট নেতা। মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের ছ'বছর অতিবাহিত। আজ এত বছর পর এই তুচ্ছ ঘটনাটি মনে পড়ার কারণ একটাই। এক ভারতীয় কূটনীতিক সাংহাইয়ে বুঝিয়েছিলেন, চিন কোনও কাজ না ভেবে হঠাৎ করে ফেলে না। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পিছনেই থাকে সুপরিকল্পিত নকশা। সম্ভবত সে সময়ে নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চিন দ্রুত সখ্য গড়ারই অঙ্ক কষছিল। বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ও বিদেশ সচিব জয়শংকর ছিলেন। জয়শংকর আজ বিদেশমন্ত্রী। তিনি চিনে ভারতের রাষ্ট্রদূতও ছিলেন। ম্যাণ্ডারিন ভাষায় স্বচ্ছন্দ তিনি। আমরা তখন দেখেছিলাম, সুষমা এবং জয়শংকরকে সমাজতান্ত্রিক চিন কীভাবে প্রতিটি অনুষ্ঠানে কূটনৈতিক গুরুত্ব দিচ্ছিল। চিনের মিডিয়া প্রতিনিধি দল কার্যত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে, ভারত নিয়ে তাদের কৌতূহল ও উৎসাহও ছিল দেখার মতো।
আরও পড়ুন: করোনা-আমফান, এবং বাঙালির আত্মপরিচয়
এখানে একথাও মনে রাখতে হবে, মোদীকে ভোটের আগে যখন আমেরিকা ভিসা দিতেই রাজি হচ্ছিল না, তখন চিন কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীকে মহাসমারোহে 'গ্ৰেট ওয়াল প্রোটোকল' ভেঙে বেইজিং নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদী চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকেও সবরমতী নদীর তীরে ঝুলায় বসিয়ে এক যৌথ কূটনৈতিক রোমান্সের নিদর্শন দেখান। কাজেই মোদী ক্ষমতায় এসেই শপথ গ্ৰহন অনুষ্ঠানে যেমন সার্ক ভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বিশেষ খাতির যত্নের নমুনা প্রদর্শন করেন, তেমনটা করেছিলেন চিন সম্পর্কেও।
কিন্তু চিনের ভারত সম্পর্কে মনোভাবে তাতে কোনও বদল এল না। ২০১৭ সালে ডোকলাম কান্ড। সে সময়ে দু'দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলল ৭৩ দিন ধরে। তারপর ২০২০ সালের মে মাসে লাদাখে আবার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় মুখোমুখি দু'দেশের সেনা। যখন গোটা দুনিয়া করোনা নামক এক দানব ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তখন হঠৎ চিন এই সীমান্তে আগ্ৰহী হলো কেন? চিন সেনা ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকল কেন? পাঙ্গং লেকের একটা অংশ তারা দখল করতে চাইল কেন? গালওয়াল ঘাটিতে চিন তাদের সেনা মোতায়েনের সংখ্যা বাড়িয়ে দিল কেন?
একটা কথা তো স্পষ্ট, যে ১৯৬২ সালে ৩,৫০০ কিমি দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার এই এলাকাতেই চিন অনুপ্রবেশ করেছিল। আকসাই চিন দখল করে নিয়েছিল, যে ভূখণ্ড ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ ডবলিউ এইচ জনসনের সীমারেখা অঙ্কনের মাধ্যমে ভারত পেয়েছিল। যাকে বলা হয় জনসন লাইন। ১৯৫১ সাল থেকেই এখানে সড়ক নির্মাণ নিয়ে ভারত-চিন বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে সে ভূখণ্ড ভারত হারায়, আজও তা পাওয়া যায় নি। অতএব চিনের প্রসারবাদ ও ভারত-বিরোধী আগ্ৰাসন নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই।
আরও পড়ুন: কীভাবে ছ’বছর আগে মিটেছিল আরেক ভারত-চিন সংঘাত
প্রশ্ন হলো, এরকম করোনা আক্রান্ত এক বিধ্বস্ত সময়ে চিন এটা কেন করল? আর এখনও চিন ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে তার সমস্ত সেনা প্রত্যাহারও কিন্তু করেনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসময়ে চিনের আক্রমণের কারণ বিবিধ। মূল কারণ হলো, করোনাভাইরাসের আঁতুড়ঘর চিন। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই ভাইরাসের নাম চিনা ভাইরাস দিতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সহ পৃথিবীর নানা দেশের কাছে চিন আজ ব্রাত্য। জাপান সরকার তো ঘোষণাই করেছে যে চিন থেকে সমস্ত জাপানি ব্যবসায়ী তাঁদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করুন। ওই অর্থ জাপান সরকার তাঁদের দেবে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, করোনা কাণ্ডে চিনের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত করার আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। আবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তদন্ত কমিটির প্রধান এবার ঘটনাচক্রে ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। চিনের শঙ্কা রয়েছে। তদন্তে যদি এটা বোঝা যায় যে চিন তথ্যের কারচুপি করেছে, অনেক তথ্য জানায় নি, তবে কিন্তু চিনের সমস্যা বাড়বে। তৃতীয়ত, আমেরিকা প্রকাশ্যে চিন সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, করোনা বিবাদ না মেটা পর্যন্ত আমেরিকা চিনের সঙ্গে কথা বলবে না।
চতুর্থ, হংকং-এর বিদ্রোহ এবং পঞ্চম, সেই তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসনের হুঙ্কার, এইসব চিনকে বেশ চাপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সম্ভবত এই কারণেই চিন এখন কোনও অস্ত্র ব্যবহার না করে ভারতীয় সেনার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সীমান্তে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। এছাড়া ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি ও কাশ্মীর ইস্যুতেও চিনের প্রতিক্রিয়া আছে। পাকিস্তানকেও খুশি রাখা চিনের প্রয়োজন। গোটা পৃথিবীতে যখন উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইজরায়েল, প্যালেস্টাইন প্রভৃতি বিবাদমান দেশগুলি কোথাও কোন ঝামেলা করছে না। তখন চিন এমন একটা কান্ড করল। এটা আচমকা প্রতিবর্ত নয়। এটা সচেতন। পরিকল্পিত। এটাই চিনের ডিএনএ।
এবার প্রশ্ন হলো, নরেন্দ্র মোদী কী করলেন? বা কী করছেন? একথা সত্য, করোনা নিয়ে ব্যস্ত সরকারের কাছে এহেন চিনা সেনা অনুপ্রবেশ ছিল অপ্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে মোদী ব্যবস্থা নিয়েছেন। তিনি চিন সঙ্কট নিরসনে তিনজনের সঙ্গে বৈঠক করেন বিশেষভাবে। এঁরা হলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিদেশমন্ত্রী জয়শংকর এবং চিফ অফ ডিফেন্স বিপিন রাওয়াত। ডোকলামের সময়ও কিন্তু এই তিনজনই ছিলেন প্রধান কুশীলব। শুধু তখন জয়শংকর ছিলেন বিদেশ সচিব এবং রাওয়াত সেনা প্রধান। মোদীর নির্দেশে রাজনাথ সিংহও হুমকি দেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যে কোনও ধরনের সম্ভাবনার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। এটা বলার
প্রয়োজন ছিল, কারণ তার আগে শি জিনপিং ও তাঁর সেনাবাহিনীকে একই বার্তা দেন।
নরেন্দ্র মোদীর রণকৌশল ছিল একদিকে শক্তি প্রদর্শন, অন্যদিকে সংযম। আমেরিকা মধ্যস্থতা করতে চাইলেও ভারত তাতে রাজি হয়নি। আবার আমেরিকা এখন জি-৮ শীর্ষ বৈঠকে ভারতকে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। চিন কখনোই চাইবে না, ভারত আমেরিকার পেন্টাগন ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হয়ে যাক। চিন বিভিন্ন দেশে সড়ক নির্মাণ করে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিচ্ছিল, নেপালের মতো রাষ্ট্রকে তো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছিল, মোদীর কৌশলে তা রদ হয়েছে।
আরও পড়ুন: দ্বিপাক্ষিক চুক্তির ভিত্তিতেই ভারত-চিন সীমান্ত উত্তেজনার সমাধান করবে: বিদেশমন্ত্রক
নেপালের সংসদ তাদের মানচিত্র বদলে বেশ কিছু ভারতীয় ভূখণ্ড নেপালের জমি বলে দাবি করার তালে ছিল। চিনের ইশারাতেই নেপালের 'অসুস্থ' প্রধানমন্ত্রী এসব করছিলেন। ভারতের চাপে নেপাল আবার ব্যাকফুটে গেছে। চিন ব্যাক চ্যানেল কূটনীতিও শুরু করে দিয়েছে। ভোল পাল্টে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। চিনের বিদেশমন্ত্রক বলেছে, যুদ্ধের কোনও সম্ভাবনা নেই। দিল্লিতে চিনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ড্রাগন আর হাতি আবার যৌথভাবে নৃত্য করবে। মোদী সরকারের শক্তি ও সংযমের যৌথ রণকৌশলের সাফল্য এটি। ৬ জুন, শনিবার দু'দেশের সেনা পর্যায়ের বৈঠক হয়। নয়া দিল্লিরই প্রস্তাব। চিন মেনে নিয়েছে। এর আগে জেনারেল পর্যায়ের আট-দফা বৈঠক হয়েছে। চিন ও ভারত দু'পক্ষের সেনা পিছু হঠেছে।
লাদাখ সীমান্তের চুশল মলডো সেনা ছাউনিতে এই বৈঠক। নেতৃত্ব দেন ১৪ কোরের কমান্ডার। দু'দেশই আপাতত এই সংঘাতের আবহকে শান্তির পথে আনতে উদ্যোগী। এ হলো আশার কথা। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্বের দরবারে নানা সমস্যায় জর্জরিত চিনের দীর্ঘমেয়াদি প্রসারবাদের ডিএনএ সম্পর্কে ভারতকে সর্তক থাকতে হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন