মেনস্ট্রীম মিডিয়া বিষয়টি এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার কারণ, সেখান থেকেই আজকাল জনমত তৈরি হয় বেশি। ইন্টারনেট আছে, যেখানে বড় ব্যবসায়ী কিংবা সরকারের দখলদারি কম। সেখানে আপনি যেমন অন্যমত শুনতে পান, তেমনই যখন খুশী উগরেও দিতে পারেন। এতে বিভিন্ন মতের মাঝে সাধারণভাবে গোটা বিষয়টা গুলিয়ে যায়। ধরুন, মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের কোনও সাংবাদিক অন্তর্জালে নিজের মনের কথা লিখলেন। সে কথা তিনি যে কাগজে চাকরি করেন তারা ছাপবে না, কারণ সেক্ষেত্রে সরকারি বিজ্ঞাপন যাবে আটকে। কিন্তু অন্তর্জালে লেখা সেই অসাধারণ ভালো এবং সত্যনিষ্ঠ কোনও প্রতিবেদন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হারিয়ে যাবে অন্য আরও অনেক কথার মাঝে। কেউ অনুসরণ করবে না সেই বক্তব্য, আলোচনা ফুরিয়ে যাবে কয়েক ঘণ্টায়।
বঙ্গদেশের মেনস্ট্রীম মিডিয়া কিন্তু সারা দিন ধরে আপনাকে শোনাবে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতানেত্রীর অসংখ্য শেষ সাক্ষাৎকার। নতুন করে শুরু রোজ সকালে। একই রকম, গুলিয়ে যায় যে কোনটা জীবন্ত আর কোনটা পুনঃপ্রচারিত। কাউন্সিলর থেকে বিধায়ক, পাড়ার দাদা থেকে সাংসদ। কেউ তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাচ্ছেন, কেউ বা আবার ফিরে আসছেন নৈহাটি কিংবা কাঁচরাপাড়ায়। যখন তখন আরও একটা সাংবাদিক সম্মেলন। গোপন রাজনীতির প্রেম আর বন্ধুত্বের কানাকানি অস্তিত্বহীন। গোটাটাই লাউডস্পীকার ঠুসে খোলা মাঠের সিংহনাদ। বাঙালির আত্মোপলব্ধি আজকে শোভা পাচ্ছে নতুন অভিধানে, যেখানে ক্যারেকটারের অর্থ সংস্কৃতি, আর কালচারের, বাংলা চরিত্র।
অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে এখন মোটা দাগের নাটক বিনা পয়সায় পাওয়া যাচ্ছে। অতিরিক্ত সস্তায় নয়, একেবারে বিনামূল্যে। চ্যানেল ঘোরাতেই হচ্ছে না, খবর দেখলেই সন্ধেটা কাটছে ফুরফুরে মেজাজে। হাওয়া-মোরগ বুঝিয়ে দিচ্ছে সামনের বিধানসভায় লড়াই হবে বর্তমান আর প্রাক্তন তৃণমূলীদের মধ্যে। ডানপন্থী, জাতীয়তাবাদী, রক্ষণশীল ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত খাঁটি বিজেপি দেশের আর যেখানেই থাকুক না কেন, এ রাজ্যে তাদের স্বকীয়তা কমছে গোঁত্তা খেয়ে। মূল চরিত্র হারিয়ে বিজেপি এখানে তৃণমূলের প্রাক্তনী-সমৃদ্ধ।
আরও পড়ুন: দল বদল, বিশ্বাসের মৃত্যু ও মুলতুবি থাকা স্বপ্নেরা
সেই লড়াইতে পুরোটাই পার করবেন কোনও এক বাবা। সন্তান-সন্ততিরা ছুটছেন শহর আর শহরতলীর রাস্তা দিয়ে। পাশে সামিয়ানা খাটিয়ে উদ্দাম উল্লাস। তৃষ্ণার্ত না হলেও মানুষের হাতে হাতে অসংখ্য প্লাস্টিকের গেলাস। যশোর কিংবা বিটি রোডে সপ্তাহান্তের সকালে গেলাস কুড়িয়ে বিক্রি করলে নিশ্চিন্তে দারিদ্র্য সীমার ওপরে থাকা যায়। উপসংহারে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুই তাই এই রাজনীতির ভবিতব্য। আর রাজনীতি মরবে, কিন্তু অর্থনীতি দাপটে দশ সেকেন্ডে একশো মিটার দৌড়বে, এমনটা তো হয় না। তিনিও চিৎপাত, তবে সে গল্প শুধু পিছিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গের নয়, গোটা উপমহাদেশের।
রাজ্যের ক্ষেত্রে যেমন মিডিয়া জনগণকে তৃণমূল-বিজেপি দ্বন্দ্ব গেলাতে সফল, সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম তেমনই ব্যস্ত তিন তালাক কিংবা কাশ্মীরের ৩৭০ নিয়ে। সঙ্গে আছে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা চিদাম্বরমের গ্রেফতারি। এই নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল দিনরাত। এর মাঝে অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে যে দেশের অবস্থা বেশ গোলমেলে, এ খবর লাফ মেরেছে ঝুলির বাইরে। হাজারের এককে চাকরি যাওয়ার কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে আঙুলের ফাঁক গলে। নীতি আয়োগের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং সহ-সভাপতি রাজীব কুমার বলে ফেলেছেন সেই কথা। বাজারে টাকা নেই একেবারেই। সবটাই নাকি মানুষের আলমারিতে আর ব্যাঙ্কে মাটির নিচে সিন্দুকে।
বাজারে টাকা না খাটলে ঠিক কী মুশকিল হয়, সেটা অঙ্ক কষে বোঝাবেন অর্থনীতিবিদেরা। আপাতত সোজা কথায় গাড়ি বাজারে বিপুল মন্দা, সেই প্রভাব পড়েছে ইস্পাত শিল্পে। দেশের অন্যতম পরিচিত পার্লে কোম্পানিতে নাকি ছাঁটাই হতে চলেছেন দশ হাজার কর্মী। মনে রাখতে হবে, গাড়ি কেনেন সম্পন্ন মানুষ, কিন্তু তার চারপাশে যে আমজনতা কাজ করেন, তাঁদের ছাদে হেলিকপ্টার নামে না। বাড়ি ব্যবসার গতি শ্লথ হলে অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের চৌকো নীল ডোবায় সাঁতার কাটা মানুষের অসুবিধে কম, অনেক বেশি ঝামেলা রাজমিস্ত্রির। এই জায়গায় ধনতন্ত্রের চুঁইয়ে পড়ার গল্প একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়।
আরও পড়ুন: বাজারে মন্দা, ১০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের মুখে বিস্কুট নির্মাতা পার্লে
বাজার ভালো থাকলে ধনীর কাছ থেকে সামান্য কিছু সম্পদ নিম্নবিত্তের কাছে আসে। কিন্তু বাজার ধুঁকতে থাকলেই ঝামেলা। বাজার যাঁরা চালান, তাঁদের মনে কিছুটা ভয় আসে। নিজেদের সম্পদ সামলাতে গিয়ে তাঁরা তখন টাকা ধরে রাখেন। ফলে চুঁইয়ে পড়া জলের ফোঁটা তখন জমে থাকা কড়কড়ে টাকার লীনতাপ সংগ্রহ করে বাষ্পীভূত।
এমতাবস্থায় জনগণকে আশ্বাসবাণী শোনাতে দেশের অর্থমন্ত্রী বাধ্য হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন। কিন্তু এইবারে অনেক বেশি ভয়ের প্রতীক হলো পার্লে বিস্কুটের বিক্রি কমে যাওয়া। এই বিস্কুট বড়লোকের বৈঠকখানায় জল মেশানো হুইস্কি রঙের লাল চায়ের সঙ্গে শোভা পায় না। এর সবচেয়ে বেশি বিক্রি গ্রামে আর শহরতলীতে, রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে। সেইখানে বিক্রি কমে যাওয়ার কথা শুনে গায়ে কাঁটা দেওয়াটা স্বাভাবিক। বিষয়টা বড়লোকের জিনিস বিক্রি হওয়া কমে গিয়ে গরীবের অসুবিধের ছোটগল্প নয়।
পার্লে কোম্পানি নিজেদের লাভ ঠিক রাখার জন্যে একই দামের প্যাকেটে কিছুটা কম বিস্কুট ভরছিল সেকথা হয়ত সত্যি। কিন্তু সেই প্যাকেটের দাম পাঁচ-দশ টাকাই ছিল। ফলে সেই কারণে বিস্কুট বিক্রির হাল খারাপ, এত সহজে গোটা অর্থনীতিটা বিচার না করাই ভালো। বরং ফিরে তাকানো যাক নোট বাতিলের দিনগুলোয়। বাজার থেকে কাঁচা টাকা সরে গেলে একটা দেশে যে কী ধরনের বিপদ বেশ কিছুদিন পরে আসতে পারে, সে কথা বোঝা যাচ্ছে এইবার। রাজীব কুমার বলেছেন যে ভারতের অর্থনীতিতে এইরকম গোলমেলে পরিস্থিতি গত সত্তর বছরে আসে নি।
বাঁচার উপায় আছে, আর তার জন্যে বিজেপিকে ফিরে যেতে হবে দেশ চালানোর গোড়ার কথায়। গ্রামের দিকে টাকা ঢালতে হবে অনেক বেশি। হয়ত বা কিছুটা সেই পথে হেঁটেছেনও তাঁরা, অন্তত জনগণকে সেটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন। আর সেই জন্যেই ভোট পেয়েছেন গাদা। তবে রাজনীতি তো চলমান। তাই একবার জিতলেই কাজ শেষ এমনটা নয়। সুতরাং জনগণের বিপুল রায়ে ক্ষমতায় এসে লোকজনকে দাবড়ে রাখলে চলবে না। বরং তাঁদের কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।
বিজেপির পেছনে আছে আরএসএস। হিন্দুত্ব কিংবা জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে তাদের ভাবনাচিন্তা খুবই গোলমেলে। কিন্তু অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে তাদের প্রচুর পরিকল্পনার কথা শোনা যায়, যেখানে সাধারণ মানুষ উপকৃত হতেই পারেন। ফলে ডানপন্থী মোড়কেও যদি কিছুটা নিম্নবিত্ত মানুষের কথা ভাবা যায় তাহলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর রাস্তা আছে। আর সবথেকে আশার কথা হলো, আমাদের দেশ এতটাই বড় যে চটজলদি একেবারে সব শ্মশান হয়ে যাবে এমনটা নয়।
আরও পড়ুন: দ্রুত পড়ছে দেশে গাড়ি বিক্রির হার, সরকারি সাহায্যের জন্য মরিয়া ইন্ডাস্ট্রি
পার্লের সঙ্গে ব্রিটানিয়া যেমন ভয়ের কথা শোনাচ্ছে, তেমনই নীতি আয়োগের সাবধানবাণী শোনা যাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের থেকেও। সুদের হারের ওলটপালট হচ্ছে অনেক। অর্থমন্ত্রীও মাঠে নেমে পড়েছেন। সামনে দু-একটা রাজ্যের বিধানসভা ছাড়া সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনও ভোট আসছে না। ফলে শাসকের খুব দায় নেই দেশের পরিস্থিতি যে দারুণ এই খবর প্রচার করার। তাই তাদের পেটোয়া সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোকেও আপাতত সৎ থাকার নির্দেশ দেওয়াটাই বিজেপি সরকারের পক্ষে মঙ্গলের। বোধহয় সেই কারণেই মন্দা নিয়ে আলোচনার সুযোগ পাচ্ছে জনগণ। দেশের অর্থনীতির বিস্কুট যে ফোটানো চায়ে নেতিয়ে পড়েছে, এ খবর তাই লুকিয়ে থাকছে না।
সেটাই অবশ্য অন্যদিকে সবচেয়ে আশার কথা। অসুখ চেপে না গিয়ে অন্তত আয়ুর্বেদ দিয়েও সারানোর চেষ্টা করা ভালো। আর অর্থনীতি যদি একেবারে ঘেঁটেই যায়, তাতেও ভোটে হারার খুব ভয় নেই। পড়শি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করলে সব কিছুই চাঙ্গা হয়, ভোটও বাড়ে প্রচুর। ফলে অস্ত্রনীতির পরিকল্পনা 'খ' হাতে রেখেই আপাতত সংস্কারের সোজা পথে হাঁটতে পারে বিজেপি। তারকেশ্বর, চাকলা কিংবা কচুয়া নয়, অর্থনীতির পাঠ্যবই থেকে তুলে আনা যুক্তিপূর্ণ কোনও রাস্তায়। তিন তালাক আর কাশ্মীর তো মিটেই গেছে। আপাতত চিদাম্বরম ভুলে 'চিন্তন দল' কি একটু টাকাপয়সা নিয়ে ভাববে?
সঙ্গে মাথায় রাখা দরকার যে ধর্মনিরপেক্ষতায় আঘাত এলে কিন্তু তা পরোক্ষভাবে বিপদে ফেলতে পারে গোটা দেশের অর্থনীতিকে। খুব বেশি হিন্দুত্ব গেলালে বিদেশি পুঁজি যেমন মার খাবে, দেশের মধ্যেও টাকা খাটাতে ভয় পাবেন এক বড় অংশের মানুষ। দেশের সব ধর্মের, সব প্রান্তের মানুষের শান্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার অবশ্যই রোজকার বাজারকে চাঙ্গা রাখে। ক্ষমতাশালী ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীদের কাছে তাই অন্যপক্ষের আকুল আবেদন, "একটু দেখবেন স্যার, ইয়ে, মানে আমাদের ইকোনমিকে!"
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)