জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (Naional Statistical Office)-এর শ্রমশক্তি সমীক্ষার পর্যায়কালীন যে রিপোর্ট, তার ২০১৭-১৮ সালের তথ্য বলছে, সারা ভারতে বেকারের হার হলো শতকরা ৬.১ ভাগ। এর অর্থ হলো এই বেকারি বা কর্মহীনতার হার শুধু যে প্রচন্ড বেশি তা নয়, এ হলো যাকে বলে 'অল টাইম হাই'। ১৯৭৭-৭৮ সালের পর এত বেশি বেকারি পুরুষদের ক্ষেত্রে দেখা যায় নি। মহিলাদের ক্ষেত্রে ১৯৮৩ সালের পর এত বেশি দেখা যায় নি।
কোনো সন্দেহ নেই, নানা বিষয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সাফল্য নিয়ে যখন দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ অথবা আসামের নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যখন দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে, তখন কিন্তু সব সমস্যা ছাপিয়ে গোটা দেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে দেশের আর্থিক সমস্যা। বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান চাকরি দেওয়া তো দূরের কথা, ছাঁটতে শুরু করেছে ব্যাপক হারে। পার্লে-জি কোম্পানির মত সুপ্রাচীন বিখ্যাত বিস্কুট কোম্পানি থেকে পর্যন্ত যে হারে কর্মী ছাঁটাই হলো, তা অভূতপূর্ব, অভাবনীয়।
সরকারের সবচেয়ে বড় থিঙ্ক ট্যাঙ্ক হল নীতি আয়োগ। সেই নীতি আয়োগ-এর প্রধান রাজীব কুমার পর্যন্ত দেশের আর্থিক বৃদ্ধির সমস্যা নিয়ে মুখ খুলেছেন। তাঁর বক্তব্যে সরকারী মহলের ভিতরেও প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। রাজীব কুমার বলেছেন, বিগত ৭০ বছরে এহেন আর্থিক অধোগতি দেখা যায় নি। তিনি এও বলেছেন, বিশেষ বিশেষ শিল্পক্ষেত্রে এখনই কিছু নীতিগত হস্তক্ষেপ (policy intervention) দরকার। কিন্তু প্রধান আর্থিক উপদেষ্টা কে সুব্রহ্মণ্যম এই মতের বিপক্ষে। তিনি বলেছেন, শিল্পভিত্তিক ইন্সেন্টিভ না দিয়ে জমি ও শ্রম বাজারে প্রয়োজন structural reform বা গঠনমূলক সংস্কার। কিন্তু তাই বা হবে কী করে? জমি ও শ্রম আইনে আমূল বদল তো এখনো লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সরকার করতে সক্ষম হয়নি।
এটা খুব বিস্ময়ের ব্যাপার যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র দুবছর আগে গ্লোবাল রেটিং এজেন্সি মুডি ভারতের অর্থনীতির প্রশংসা করে এবং ভারতের সার্বভৌম দেশ হিসেবে credit worthiness সম্পর্কে প্রশংসা করে। বলা হয়, গত ১৪ বছরে এত ভালো রেটিং হয় নি। বলা হয়েছিল, মোদী সরকারের নেতৃত্বে অসাধারণ গঠনমূলক সংস্কারের কাজ হয়ে চলেছে। আর আজ? ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কফি স্টোর চেইন ক্যাফে কফি ডে-র বিশিষ্ট বাণিজ্যপতি আত্মহত্যা করলেন ব্যাঙ্গালোরে। মৃত্যুর আগে তিনি জানালেন, ভয়াবহ ঋণবৃদ্ধির ভয়াবহ অধোগতি এবং কর বিভাগের দৌরাত্ম্যের জন্য তাঁকে আত্মহত্যা করতে হলো।
গাড়ি শিল্পে নাভিশ্বাস উঠেছে। গাড়ি বিক্রি কখনোও এত কমে যায়নি। ফলে এক মিলিয়ন প্রত্যক্ষ এবং অপরোক্ষ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। অবশ্য অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বাজেটে যেসব কর বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের উপর চাপিয়েছিলেন, তা প্রত্যাহার করে নিবেশকারীদের আস্থা বাড়াতে চেয়েছেন। আর্থিক বৃদ্ধির এই অধোগতিও গত ১৫ বছরে এই প্রথম। বেসরকারি ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রকল্পে কার্যত কোনও বিনিয়োগ নেই। তার মধ্যে আয়কর বিভাগের দৌরাত্ম্য ক্রমশ বেড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
নরেন্দ্র মোদী দেশের এই আর্থিক সংকট বুঝতে পারছেন না তা নয়। সত্যি কথা বলতে, ২০১৯ সালে ভোটের সময়ও ছিল কর্মহীনতা, বাজারে ক্রেতার অভাব। বৃদ্ধির অধোগতি, রফতানির সংকট। সবই ছিল। মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির সমস্যাও অনেকদিনের। তবু ভোটের সময় সাধারণ মানুষ, সাধারণ ভোটার নরেন্দ্র মোদীর প্রতি আস্থা রেখেছেন। মানুষ ভোট দিয়েছেন মোদীকেই। মানুষ ভেবেছেন চাকরি নেই, কিন্তু এই সংকটের মুখে তিনিই পারবেন দেশকে মুক্ত করতে।
নির্মলা সীতারমণ বেশ কিছু আর্থিক দাওয়াই ঘোষণা করে চলেছেন। কখনও বাজেটের ঘোষিত করের বোঝা প্রত্যাহার করে চলেছেন, কখনো জাতীয় ব্যাঙ্কগুলির সংযুক্তিকরণ করছেন। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার প্রাক্তন গভর্নর বিমল জালান কমিটির সুপারিশ অনুসরণ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার মত কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার বিপুল উদ্বৃত্ত অর্থ-সম্পদ থেকে একটা বড় অঙ্কের অর্থ সরকারকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উদ্দেশ্য, বাজারে এই টাকা ঢেলে তাকে তেজি করা।
আসলে ভারতে যে শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্র, তাতে উৎপাদন গত পাঁচ বছরে শুধু কমেছে তা নয়, চিনের ওপর নির্ভরশীলতা দ্বিগুণ হয়ে গেছে। চিন থেকে প্রত্যেক ভারতীয় ৬,০০০ টাকার সমতুল্য দ্রব্য আমদানি করেন। ২০১৪ সালে এই পরিসংখ্যান ছিল ৩,০০০ টাকা। আর ভারতীয় রপ্তানি ২০১১ সালে সেই যে আটকে গেছে, আজও তা থেকে মুক্ত হতে পারে নি।
কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এই অর্থনীতি সম্পর্কে মুখর হয়েছেন। তিনি বলেছেন, অর্থনীতি সংকটে। জীবিকা হারাচ্ছেন বহু মানুষ। সরকার দিশাহীন। সাধারণ মানুষের কাছে এই সমস্যার কথা তুলে ধরাই এখন কংগ্রেসের প্রচারের প্রধান লক্ষ্য। ২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর রাজ্যস্তরের কমিটিগুলোকে কনভেনশন আয়োজনের ডাক দিয়েছেন তিনি। জাতীয় স্তরে বিক্ষোভ ১৫ থেকে ২৫ অক্টোবর। কংগ্রেসে সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম শীর্ষ বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সোনিয়া। কংগ্রেস এখনও মোদীর জনপ্রিয়তার কাছে যথেষ্ট দুর্বল, কিন্তু তবু কংগ্রেস মনে করছে, এই পরিস্থিতি চিরস্থায়ী হতে পারবে না। রাজনীতির ইতিহাস বলে, উত্থান যেমন সত্য, পতনও তেমন সত্য।
সোনিয়া তাই রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট মানুষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করছেন মনমোহন সিংকে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মুখে অর্থনীতি। কেন্দ্র নির্বিকার। কৃষি-আবাসন-কলকারখানার উৎপাদন, গাড়ি শিল্প, সর্বত্র বিবর্ণ ছবি। কৃষির বৃদ্ধি তলানিতে (২.৭ শতাংশ)। গ্রামে পাঁচ বছরে কার্যত বাড়েনি প্রকৃত আয়। ফলে টান চাহিদায়। মুখ থুবড়ে পড়েছে কলকারখানার উৎপাদনও। ২০১৯ সালের প্রথম ছ'মাসে বিক্রি হয়নি ৪.৫ লক্ষ বাড়ি-ফ্ল্যাট। কর সন্ত্রাসে লগ্নীকারীরা অতিষ্ঠ। দেখা নেই বেসরকারী লগ্নীর। অর্থনীতির দশা এমন বেহাল থাকলে কোথায় তৈরি হবে কাজের সুযোগ? কোথায় চাকরি পাবে নতুন প্রজন্ম? পাঁচ বছরে ৫ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি হতে গেলে বছরে গড় প্রকৃত বৃদ্ধি হতে হবে প্রায় শতকরা ৯ ভাগ। ভারত তো তার আশেপাশেই নেই।
আর্থিক সংকটের জেরে ভারতীয় রেলে কমছে পণ্য পরিবহন। শিল্পকে বার্তা দিতে তাই আজ লৌহ আকরিক ও পেট্রোপণ্য বাদে সমস্ত পরিবহনে ব্যস্ত সময়ের (অক্টোবর-জুন) সারচার্জ কমিয়ে দিয়েছে রেল। যুক্তি হলো, মালগাড়ি মারফত ছোট আকারের পণ্য আনা-নেওয়ায় শতকরা ৫ ভাগ বাড়তি ছাড় দিলে রেলে পণ্য পরিবহন বাড়বে। চাকা গড়াবে অর্থনীতির। বণিক সভাগুলি এক্ষেত্রেও প্রশ্ন তুলেছে, বাজারে যেখানে চাহিদা উধাও, মালপত্র পাঠানো কমেছে, বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি মার খাচ্ছে, সেখানে পণ্য ভাড়ায় ছাড় দিয়ে লাভ হবে কি?
প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ কিন্তু এই বিশ্ব আর্থিক সংকটের মধ্যেও তুলনামূলকভাবে ভালো কাজ করছে। আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনেটরি ফান্ড) সম্প্রতি জানিয়েছে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ শতকরা ৭.১ বৃদ্ধির হারের দৌলতে দ্বিতীয় গতিশীল অর্থনীতির দেশ। সেই শতকরা হার ৬.৫ ভাগ রেখে বাংলাদেশ কিন্তু আজও ভালো…