অঙ্ক কখনও সহজ হয় না। তার মধ্যে টুকটাক গোলমাল থাকবেই। সেই জন্যে ২০১৯ এর স্বাধীনতা দিবস কততম সে নিয়ে গোনাগুনতিতে সতর্কতার প্রয়োজন আছে। আগে হলে কিছু একটা বলে দেওয়া যেত। কিন্তু আজকাল ভুল করলে জায়গামত দেশদ্রোহীর সীলমোহর পড়ে যেতে পারে। বাজার এখন অনর্গল দেশপ্রেমের। কোনও ওষুধেই সে ধারা রোখা যাচ্ছে না। তাই প্রেমের সময় কলেরার দিনগুলিতেই হোক কিংবা ডেঙ্গির মধুমাসে, দেশের শরীরে চোখের জলের ভাগ ধরে রাখার জন্যে নুনজল অবশ্য পথ্য। সঙ্গে একচিমটে চিনি মস্তিষ্ক সতেজ করবে। সেটুকু গলাধঃকরণ করে এবারের স্বাধীনতা কত বছরের সেই অঙ্কটা শুরুতেই কষে ফেলা যাক।
যদি ১৯৪৭-এর ১৫ অগাস্টকে প্রথম স্বাধীনতা দিবস ধরে নেন, তাহলে এবারেরটা ৭৩-তম। যদি প্রশ্ন করেন আমাদের স্বাধীনতার কত বছর পূর্ণ হল, সেক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৭২। বয়েস হিসেব করতে গেলে এই এক বছরের গোলমালটা মানুষের যেমন হয়, তেমন দেশেরও। তার ওপর বাহাত্তুরে ধরলে ছোট্ট এক-এ কিছু যায় আসে না। তবে সঙ্কটাপন্ন রুগীর ক্ষেত্রে বছরের বদলে ঘণ্টা বাজে, আর তাই সেখানে প্রতিটি এককই গুরুত্বপূর্ণ। চিৎ হয়ে পড়লেই চিকিৎসকদের ৭২ ঘণ্টার নিদান। ভাগ্যিস দেশদ্রোহীদের চাবকে এই অলুক্ষুণে সংখ্যাটা এবার পার হওয়া গেল। ক্ষুদ্র ঘণ্টা নয়, একেবারে লম্বা বছরের হিসেবে। দেশের স্বাধীনতার সঠিক উত্তরণে, নিশ্ছিদ্র উদ্বেগহীনতায়, ধারাবদলের দৃঢ়তায়। কিন্তু দিনগুলো কি বদলালো?
আরও পড়ুন: দল গৌণ, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি এখন মুখ্য
গোটা দেশের পরিস্থিতি বিচার করতে গেলে ইতিহাস আর ভূগোলের পরিধি বেড়ে যাবে অনেকটা। তাই রাজ্যের প্রেক্ষিতে দেশপ্রেম অনুধাবন করাটাই সহজ কাজ। স্বাধীনতা দিবসের তীব্রতা পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে তৃণমূল শক্তিশালী হওয়ার পর থেকেই। তার আগেও রাজ্যে স্বাধীনতা দিবস ছিল। তবে সেখানে পোড়খাওয়া বিদগ্ধ বাম নেতারা নামতা পড়ার মত আউড়াতেন যে সে স্বাধীনতা নাকি মেকি। তাই কৈশোরে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগত, তাহলে কি স্বাধীনতার গুণগত মান বিচারের জন্যে স্যাকরার কাছে যেতে হবে? যাই হোক, সে বামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই। পুরনো সেই দিনগুলোতে বামেদের থেকে কংগ্রেসের স্বাধীনতা উদযাপনের রমরমা কিছুটা বেশি থাকলেও আজকের তুলনায় তা নস্যি।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার গন্ধ পাওয়া গেল ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে, আর ২০০৯-এ তো বিষয়টা একেবারে জলের মত পরিষ্কার। তখন থেকেই শুরু স্বাধীনতার আগের রাত জুড়ে হইচই। তৃণমূলের একটা বড় গুণ হলো, স্বাধীনতাই হোক কিংবা দূর্গাপুজো, প্রজাতন্ত্র দিবসই হোক কিংবা গণেশ চতুর্থী, কাজটা বেশ কদিন আগে থেকে শুরু করে দেওয়া। ক্ষমতায় আসার পরে পরেই চোদ্দর রাত থেকে দেশাত্মবোধক গান শুরু হত। এবার আরও তাড়াহুড়োয় ১৩ অগাস্ট থেকেই উৎসবের শুরু। বিষয়টা মোটামুটি দূর্গাপুজোর অনেক আগে মহালয়ার দিনে বোধনের মত।
তবে এ বিষয়ে কিছুটা সাবধানতার প্রয়োজন আছে। তার কারণ পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস আমাদের ঠিক আগের দিন। সুষম দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদের মধু-তুলসীপাতা মেশাতে গেলে অবশ্যই পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিনটাকে ভারতবর্ষে কালা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা দরকার। ইমরানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান যেমন আমাদেরটাকে করেছে। উপযুক্ত জবাব দেব আমরা। সেদিন মাইকে কোনও গান বাজাব না। ইডেন গার্ডেনের সামনে ইমরানের কুশপুত্তলিকা দাহ করব। আর বাংলার সব টিভি চ্যানেল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেই একই ধোঁয়া দিয়ে দৃশ্যমান জগৎটাকে যারপরনাই ঝাপসা করে দেবে।
এর মধ্যে রাজ্যে স্বাধীনতা দিবসের আতিশয্যের সঙ্গে বিজেপির উত্থানের সম্পর্ক অনস্বীকার্য। ভারতমাতার পুজো তো আছেই, সঙ্গে গুরুগম্ভীর জাতীয়তাবাদ। কোথাও কোথাও তৃণমূলের সঙ্গে মারপিট। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ডেঙ্গির মশা আর পাকিস্তানের সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়া সন্ত্রাসবাদী, সবটাকেই আটকানোর জন্যে রাজনৈতিক নেতাদের দৈনন্দিন দেশপ্রেম সংক্রান্ত কর্মসূচি জরুরি।
দিনগুলো যাই হোক, ডেঙ্গি কিংবা কলেরার, আর্থিক অসহায়তার কিংবা বেদ থেকে খুঁজে পাওয়া বিজ্ঞানের, দেশপ্রেম দেখানোটা এখন অবশ্য কর্তব্য। তাই দ্বিচক্রযানে বেশি শব্দ হলে ক্ষতি নেই, মাথায় হেলমেট না পরলেও চলবে। গাড়ির সামনে তেরঙ্গা থাকলেই অন্য কোনও কাগজ রাখার দরকার নেই। দেশপ্রেমই মাঝ-অগাস্টের লাইসেন্স, স্বাধীনতার ঔজ্জ্বল্যে আধার (আঁধার নয়, পরিচয়পত্র) ভুলে থাকার সময়। দেশপ্রেমের চাকা ঘুরিয়ে গাঁকগাঁক আওয়াজে মনেও পড়বে না যে গাড়ি বাজারে বিক্রি কমেছে ভয়াবহ হারে। চাকরি গেছে কয়েক হাজার স্বাধীন নাগরিকের।
আরও পড়ুন: আমাদের ওপর ভরসা হারাচ্ছে আমাদের সন্তানরা
আর সেই জন্যেই রক্তশূন্যতার মাঝে রক্তদানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে পেশীবহুল দেশনেতা “স্বেচ্ছায়” শব্দটির সংজ্ঞা বদলে দিতে পারেন দেশপ্রেমের মোড়কে। আজকাল স্বাধীনতা দিবসের সময় থেকেই দূর্গাপুজোর যাত্রা শুরু। তাই পতাকা উত্তোলনের সঙ্গেই পাশের খুঁটিপুজোয় একাধারে রাজনীতিবিদ এবং অভিনেতা অভিনেত্রীদের উচ্ছ্বল মুখাবয়ব। ভুল করে দেশপ্রেমের গানে ঢুকে পড়েছে 'সাধের লাউ', বৈরাগ্যের অমোঘ কথামালা।
তবে সবটা তো আর বিমূর্ত দেশ নয়। ব্যক্তি-মানুষের উদাহরণ টানতেই হবে। কাউন্সিলর হয়ে স্বপ্ন সফল হয়েছে পাড়ার হারুদার। শিশু বয়স থেকেই তিনি পতাকা উত্তোলনে ভীষণ উৎসাহী। হাতের ছোট্ট কাগজের পতাকা নেড়ে আশ মিটত না। চাইতেন বড় মানুষদের মত দড়ি টেনে কাপড়ের পতাকা তুলতে। কোঁচকানো পতাকা পতপত করে উড়তে উড়তে যে পুষ্পবৃষ্টি করে তা শিরোধার্য করার স্বপ্ন তাঁর ছেলেবেলার। ফাঁক পেয়ে লোকাল কমিটির সেক্রেটারি আসার আগেই দু-একবার দড়ি টেনে ফেলে বাম আমলের পাড়ার দাদাদের চাঁটা খেয়েছিলেন তিনি। তবে সে তো নব্বইয়ের দশক। আজকের দিনে সরকার বদলেছে, তাঁর বয়েস বেড়েছে, আর সঙ্গে তিনি সমাজসেবক থেকে পুরো সময়ের পাড়ার নেতা। সতেরো জায়গায় দড়ি টেনে এবছর দেশপ্রেমের আশ মিটিয়েছেন তিনি। আঙুল ছড়ে গেছে, কিন্তু দেশের জন্যে এটুকু তো করাই যায়।
স্বাধীনতা দিবসের আবেগে একই দিনে সাত জায়গায় রক্তদান করতে চেয়েছিলেন হারুদা। কিন্তু তাঁর অনুগামীরা নেতার স্বাস্থ্যের কথা ভেবে বিপুল আপত্তি তোলায় এবছর আর দেশপ্রেমিক হিসেবে জীবন উৎসর্গ করার সুযোগ পেলেন না। আপাতত একটু দোনামোনা থাকলেও, সামনের নির্বাচনের আগে সঠিক দেশপ্রেম দেখানোর জন্যে তৃণমূলের সর্বসময়ের কর্মীর দায়িত্ব ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছেন তিনি। দল বড় নয়, তার থেকে অনেক উর্দ্ধে দেশ। তাই তো দরকারে তৃণমূল বিয়োগ। আর নির্বাচিত না হতে পারলে দেশসেবা করা বেশ কঠিন। সুতরাং দলমত নির্বিশেষে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছে নির্বাচনে জয়লাভ করাটাই সংসদীয় গণতন্ত্রে দেশপ্রেমের প্রকৃত পরিচয় - দেশবাসী ডেঙ্গিতেই মরুক, কী কলেরায়। একেই বলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উদ্ভূত দেশাত্মবোধ। দেশের জন্যে মন আর রাজনীতির রঙ তো বদলাতে হতেই পারে। তাই তো সাম্প্রতিক সংস্কৃতি ‘দিল্লি চলো’, অর্থাৎ দেশের রাজধানীতে গিয়ে দলবদলের স্বাধীনতা।
আরও পড়ুন: এখন সময় প্রতিযোগিতামূলক সামরিক জাতীয়তাবাদের
তবে রঙের অন্য দিকও আছে। সেটা চোখে দেখা, চেখেও। আজকের দিনে তা দেশপ্রেমের এক নতুন প্রকাশ। স্বাধীনতার দিনগুলোতে বিভিন্ন খাবারে দেখা যাচ্ছে জাতীয় পতাকার রঙ। এব্যাপারে সরকারের সমর্থন আছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবু মাঝে মাঝে ভাবনা হয়, জাতীয় পতাকার রঙের খাবার এঁটো করাটা ঠিক হচ্ছে কিনা। তেরঙ্গা ধোসা থেকে তেরঙ্গা চমচম, তেরঙ্গা বিরিয়ানি থেকে তেরঙ্গা মিহিদানা, সবেরই বাজার বেশ উর্দ্ধমুখী। সন্দেহবাতিক বাঙালি অবশ্য বিষাক্ত রঙ নিয়ে সামান্য দুশ্চিন্তায়। কিন্তু সে চিন্তাও আপাতত দূর হয়ে গেছে। সব রঙই প্রাকৃতিক।
সেজন্যেই দাম বাড়ছে গেরুয়া গাজর কিংবা কুমড়োর, সবুজ পালং শাক, ধনে পাতা, অথবা থানকুনির। এমনকি অশোকচক্রের নীল নাকি যোগান দিচ্ছে ফেলে আসা জ্যৈষ্ঠের জাম। তাই দেশপ্রেমিক তকমা পেতে গেলে রঙকানা হলে চলবে না, রঙ দেখে রঙ গিলতে হবে। আর তাতেই তো বদলাবে মন আর শরীরের রঙ, সঙ্গে রাজনীতির। সাচ্চা এবং স্বচ্ছ দেশপ্রেমিকদের কিছুতেই নজরে আসবে না রাষ্ট্রব্যবস্থার বিবর্ণতা। অসুখের দিনগুলিতে দেশপ্রেমে যেন ভাঁটা না পড়ে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)