/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/08/suicide.jpg)
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, বিবাহিত পুরুষদের আত্মহত্যার হার বিবাহিতা মহালিদের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতীকী ছবি
পরিচিত এক ভদ্রলোক একদিন এক ঘরোয়া আড্ডায় হঠাৎ বললেন, "জানো তো, কলকাতায় শুনলাম পীড়িত পতি পরিষদ গঠিত হয়েছে। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি অত্যাচারিত স্বামীদের হয়ে কাজ করবে।" আমরা সবাই হেসে উঠলাম। উনি নির্ঘাত মজা করছেন, এমন আবার হয় নাকি? এতদিন জানতাম, মেয়েরাই হিংসার শিকার হন। যাবতীয় অত্যাচার তো তাঁদের ওপরেই হয়ে থাকে। স্বামীদের ওপর অত্যাচার? বক্তা ভদ্রলোক সিরিয়াস হয়ে বললেন, "কতটুকু খবর রাখো তোমরা? পুরুষের ওপরেও জুলুম কিছু কম হয় না। মেয়েদের প্রতি সবারই সহানুভূতি বেশি। হয়তো তুলনামূলক ভাবে দুর্বলও তারা। তাই তাদের খবর নিয়ে মিডিয়া হইচই বেশি করে। পুরুষের কথা নিয়ে মিডিয়ার আগ্রহ নেই। কারণ, এ খবর বিক্রির সম্ভাবনা কম।"
এটা প্রায় চার দশক আগের কথা। মিডিয়া তখনও তত সক্রিয় নয়। তবুও বধূ নির্যাতন, বধূ হত্যা, নারী ধর্ষণ, মেয়েদের ওপর নানা ভাবে অত্যাচার, পণ দিতে না পারার জন্য পুড়িয়ে মারা - এসব খবর বেশ গুরুত্ব নিয়েই সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসত। পুরুষরা নির্যাতিত হচ্ছেন, এমন খবর কস্মিনকালেও চোখে পড়েনি। তবে, ওই ভদ্রলোককে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ ছিল না। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং বহু সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ইনি চারপাশের খবর আমাদের চেয়ে একটু বেশিই রাখতেন।
সাল ২০১৯। আমরা খবর রাখি আর না রাখি, তথ্য বলছে, বিবাহিত মহিলাদের তুলনায় বিবাহিত পুরুষদের আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। কোথাও কোথাও তো প্রায় দ্বিগুণ। চমকে ওঠার মতো এই পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)। এনসিআরবি-র রেকর্ড অনুযায়ী, অবিবাহিত ও বিবাহিত, দুই ক্ষেত্রেই পুরুষদের আত্মহত্যার ঘটনা মহিলাদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। সবচেয়ে বেশি ধাক্কা লাগে যে তথ্যে, তা হলো, প্রতি ৯ মিনিটে একজন করে বিবাহিত পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
আরও পড়ুন: আমাদের ওপর ভরসা হারাচ্ছে আমাদের সন্তানরা
এই রেকর্ড দেখতে দেখতে বহু বছর আগের সেই আলোচনা স্মৃতিতে উঠে আসা ছিল খুবই স্বাভাবিক। পুরুষ পীড়ন তাহলে ভিনগ্রহের ঘটনা নয়। এক অতি জ্বলন্ত সামাজিক চিত্র। সেই পয়সার দু'পিঠের মতো। একটা দিক না দেখেই কাটে আমাদের। যেন এই পিঠটা না দেখলেও চলে। প্রশ্ন, এ কি নিছক অজ্ঞতাজনিত অবহেলা? নাকি তার চেয়ে জটিল কোনও মনস্তাত্বিক কারণ রয়েছে এর পিছনে? আমরা মেয়েরা কি নিজেদের অত্যাচারিত দেখতেই ভালোবাসি? তাহলে এর পিছনেও কি কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে?
একদল কলেজ ছাত্রের করা একটি সার্ভে রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে জাতীয় স্তরের প্রতিষ্ঠিত এক ইংরেজি সংবাদমাধ্যম গ্রুপের ওয়েব এডিশনে। সেখানে উঠে এসেছে এই সংক্রান্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যেমন, সমাজে লিঙ্গবৈষম্যের শিকার কি শুধু মেয়েরাই? পুরুষও কি নন? অত্যাচারী ও অত্যাচারিতের প্রকৃত চরিত্র নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে কতটা উদার, নিরপেক্ষ বা বিবেচক হই আমরা? ঘটনার গভীরে যাই কি সব সময়? তার চেয়েও বড় কথা, নির্যাতনের ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে নিজেরাও লিঙ্গবৈষম্যের মতো চিরাচরিত অভ্যাস-ভাবনার দাস হয়ে যাই না তো?
রিপোর্টে সবচেয়ে মারাত্মক যে তথ্য উঠে এসেছে, তা হলো মেয়েদের প্রতি পুরুষের অত্যাচার প্রতিরোধ আইনের রেকর্ড পরিমাণ অপব্যবহার। এতে একদিকে একজন পুরুষ নানা অন্যায়-অবিচারের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে এই অপব্যবহারের ফলে যে সন্দেহ-সংশয়ের বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে, তাতে ক্ষতি হচ্ছে সত্যিকারের নির্যাতিত মহিলাদের। তাঁরা যখন বিচারের দাবি তুলছেন, তখন সেই ন্যায্য দাবিও জনসমর্থন হারাচ্ছে।
আরও পড়ুন: আমাদের সমাজ কি ধর্ষণকারীর স্বর্গরাজ্য নয়?
নারীধর্ষণ। আজকের সভ্য সমাজের অন্যতম ঘৃণ্য এক ঘটনা। এ ব্যাপারে মেয়েদের পক্ষে সোচ্চার গোটা সমাজ, সংবাদ মাধ্যম, এবং অবশ্যই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। এটা নিশ্চয়ই এক ইতিবাচক দিক। এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে আইন-আদালত থেকে সামাজিক প্রতিবাদ, সবটাই এর প্রতিরোধে সাহায্যকারী হতে পারে ও হচ্ছে। কিন্তু বহুবার এক্ষেত্রেও সন্দেহের কারণ ঘটেছে। অভিযোগ, নিরপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যে ও সাজানো ঘটনায় জড়ানো হয়েছে। এমনভাবে তথ্যপ্রমাণ তৈরি করা হচ্ছে, যে ধর্ষণ না করেও ঘৃণ্য অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি ভোগ করছেন নিরীহ মানুষ।
এই সাজানো ঘটনাগুলির সামনে কোনও না কোনও মহিলা থাকলেও, পিছনে কোনও বড় চক্র থাকে। এই সংগঠিত অপরাধের উদ্দেশ্য অনেক কিছুই হতে পারে। তবে, টাকাপয়সা হাতানোই থাকে মূল লক্ষ্য। অতি সম্প্রতি এমনই এক মিথ্যে মামলা থেকে সসম্মানে রেহাই পেয়েছেন হিন্দি টিভির জনপ্রিয় তারকা করণ ওবেরয়। তবে সবাই করণের মতো ভাগ্যবান হন না। নিজেকে নিরপরাধ প্রমান করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন অভিযুক্ত, এমন উদাহরণও আছে।
তথ্য বলছে, মহিলাদের ওপর অত্যাচার, যৌন নির্যাতন সংক্রান্ত এমন প্রচুর এফআইআর হয়, যা আদতে ভিত্তিহীন। দিল্লী হাইকোর্টের এক পর্যবেক্ষণ অনুসারে, মামলা আদালতে ওঠার পর, অভিযোগকারিনীদের অনেকেই যে মিথ্যে বলছেন, তা প্রমাণিত। এঁদের একেবারেই রেয়াত করতে রাজি নয় আদালত। আদালতের মতে, এঁরা মোটেই তথাকথিত নিরীহ নির্যাতিতা নন। রীতিমতো পরিকল্পনা করে পুরুষদের বিপাকে ফেলেন এই নারীরা। যেমন, ডিভোর্সের মামলা হলো একদল মহিলার রোজগারের রাস্তা। প্রথমে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে লকআপে ঢোকাও। তারপর ডিভোর্সের মামলা করো। দর কষাকষির জন্য উকিল তো আছেই। কোনওভাবে একটা বড় দাঁও মারতে পারলে সারা জীবন পায়ের উপর পা দিয়ে আয়েশ করো।
প্রসঙ্গত, তথাকথিত অপরাধের আয়নাতেই সব ঘটনা অবলোকন না করেও পুরুষ পীড়নের কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়। বধূ নির্যাতনে শাশুড়ির ভূমিকার কথা সর্বজনবিদিত। একেবারে জীবন থেকে সাহিত্য-সিনেমায় এই সংক্রান্ত তথ্য ও তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু যে পুরুষকে স্ত্রীর চাপে বৃদ্ধ মা-বাবাকে ত্যাগ করতে হয়, তাঁকে আমরা কি বলব? মেরুদন্ডহীন? হতভাগ্য? না স্ত্রীর দ্বারা নিপীড়িত? স্ত্রীর অন্তহীন বিলাসের চাহিদা মেটাতে গিয়ে স্বামী অসৎ পথ বেছে নিয়েছেন, এমন উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে। এক্ষেত্রেও সেই সব স্বামীকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাই আমরা। যুক্তি, 'বউ বললেই শুনতে হবে'? শুনতে হয় বাবা! না শুনলে কী হয়, সবাই জানে। পুরুষের সব শক্তি যে নারীর মোহমায়ায় কাছে তুচ্ছ, এ তো যুগ-যুগান্তরের সত্য। বলা বাহুল্য, অনেকে এই যুক্তির মধ্যেও নারীকে ছোট করার একটা অভিমুখ খোঁজার চেষ্টা করবেন। তবে সেটা হবে আত্মপ্রবঞ্চনা, সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা।
আরও পড়ুন: গণপ্রহার: আদৌ ওষুধ আছে এই সামাজিক রোগের?
এই প্রতিবেদন লেখার উদ্দেশ্যে যত খবর ও তথ্য ইতিমধ্যেই নজরে পড়ল, তা এক কথায় অকল্পনীয়। সামাজিক একজন মানুষ হিসেবে চারপাশের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের নাড়া দেয়। বেশ কিছু ঘটনা আমাদের চিন্তার জগৎকে পৃথকভাবে প্রভাবিতও করে। শোষক ও শোষিতের ভূমিকায় এ যাবৎকাল পর্যন্ত যথাক্রমে পুরুষ ও নারীকেই দেখে এসেছি আমরা। বলা যায়, এটাই অভ্যাস আমাদের। তথাকথিত পুরুষবিদ্বেষী না হয়েও মোটামুটি এই ধারণাই আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যে পুরুষ মাত্রেই ধর্ষক, অত্যাচারী। ঘরের মা-বোন-বউ থেকে অফিসের সহকর্মী, কাউকেই ছাড়ে না সে। বলতে দ্বিধা করব না, এও এক রক্ষণশীল চিন্তা। জোর করে সত্যকে অস্বীকার করা। তবে, সত্যের শক্তি এখানেই, যার মুখ কিছুতেই ঢেকে রাখা যায় না। আমরা চাই না চাই, মেয়েরাই শুধু অত্যাচারিত, এই থিওরি মিথ্যে প্রমাণ করে একের পর এক পুরুষ নির্যাতনের খবর আজ জায়গা করে নিচ্ছে সংবাদের শিরোনামে।
এমন এক প্রেক্ষিতে আইপিএস অফিসার অমিতাভ ঠাকুরের পক্ষ থেকে পুরুষের অধিকারের প্রশ্নে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া কোনও মতেই আর অবাস্তব মনে হয় না। ঘরে-বাইরে নারী ও পুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনযুদ্ধে শামিল হবেন, এটাই ছিল আধুনিক মানুষের চাওয়া। যুগ যুগ ধরে জীবনেরও দাবি এটাই। যে পুরুষ নারীকে তাঁর সমমর্যাদা দেওয়া দূর, নিপীড়ন ও নির্যাতনে জীবন দুর্বিষহ করে তোলে, তার যেমন কঠোর শাস্তি প্রাপ্য, তেমনই আইন-আদালতের সুযোগ নিয়ে যে মহিলারা অধিকার আদায়ের নামে পুরুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করে, তারাও সমাজ এবং আইনের চোখে সমান অপরাধী। শাস্তি তাকেও পেতে হবে। তা নাহলে লিঙ্গবৈষম্য থেকেই যাবে। এটা নারী ও পুরুষ কারো পক্ষেই মঙ্গলময় হবে না। প্রকৃত দোষী নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে আর শাস্তি ভোগ করবে নিরীহ নিরপরাধী।
(তথ্য সৌজন্যে সাংবাদিক ও সমাজসেবী নন্দিনী ভট্টাচার্য)