সত্যি আর জাস্ট নেওয়া যাচ্ছে না! দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খবরের কাগজ, ফেসবুক, টুইটার খুললেই দেশের পাকা রাস্তাগুলো জুড়ে খালি পায়ে, মধ্য মে-এর রক্তসূর্যের নিচ দিয়ে চলতে থাকা, কালো, রোগা, ক্ষয়াটে শরীরগুলোকে আর দেখতে পারছি না। তাকাতে পারছি না ওই শরীরগুলোর-ই আশ্রয়ে ঝুলতে ঝুলতে চলা হাক্লান্ত কচিকাঁচা, ছোট ছোট মানুষগুলোর দিকে।
বিশ্বাস করুন, ভেবেছিলাম নেহাতই সাময়িক এই পরিযায়ী শ্রমিকদের মিছিল, এত অসহায় ঘরমুখো মানুষ যখন রাস্তায়, নিশ্চয়ই সরকার, সে কেন্দ্রেরই হোক কী রাজ্যের, নিশ্চয়ই একটা কিছু সুবন্দোবস্ত করবে। কিন্তু চ্যানেলে চ্যানেলে মাস্ক বেঁধে ঝগড়া ছাড়া কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না, জানেন। তাই লকডাউন ৪-এর কোলে গা এলিয়ে দেওয়া আমি, ওয়ার্ক ফ্রম হোম-এর গুণগান গাওয়া আমি যখন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্যালারি ঢোকার মেসেজটা পড়ে সবে আয়েস করে ডালগোনা কফিতে চুমুক দিতে যাচ্ছি বা বাড়িতেই মাটন বিরিয়ানি রান্নার পোস্ট দিয়ে ফেসবুক-এ লাইক কুড়োনোর ফন্দি আঁটছি, তখনি আবার মোবাইল থেকে, টিভি থেকে, কম্পিউটার থেকে পিলপিল করে এই নোংরা, কালো, জিরজিরে মানুষগুলো ঢুকে পড়ছে আমার মগজে।
দিন-হপ্তা-মাস পার করে, মাইলের পর মাইল, ছোট্ট বাচ্চা কাঁধে-কোলে নিয়ে, নোংরা পোঁটলা-পুঁটলিতে সংসারের যথাসর্বস্ব পুরে, বুদ্ধ-পূর্ণিমার রুপোর থালার মতো চাঁদকে যেন ভেংচি কাটতে কাটতে এগিয়ে যাওয়া এই মিছিল আমাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। খবরের কাগজের পাতায়, মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার হাইওয়ের ধারে বন্ধু ইয়াকুব-এর কোলে শুয়ে থাকা মাত্র বছর চব্বিশের অমৃতের মৃত-মুখ আমার সকালের চাকে করে তুলছে বিস্বাদ। আমার জিভে জল আনা খাবারের প্লেটে উড়ে আসছে মজুর পোড়া ছাই। রেললাইন জুড়ে ছড়ানো, কাটাপড়া মজুরদের রক্তের ছিটে লাগা রুটি ক'টা আমাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে আমি অপরাধী। আমি এই শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনে, অনেকের খুব খারাপ থাকার শর্তে ভালো থাকার অপরাধে অপরাধী, আমি নিজের রুজি-রুটির ধান্দায়, সব প্রতিবাদ ভুলে আপস করার অপরাধে অপরাধী। মজুরজন্মের অতলান্ত অন্ধকার থেকে উঠে আসা চাপ চাপ ভারী দুর্গন্ধ আমার প্রতিগ্রাস খাবারে মিশিয়ে দিচ্ছে এই অপরাধবোধ।
কিন্তু এরকমটা হওয়ার কথা ছিল না, বুঝলেন। দেশটা তো আমরা চালাই না, আমাদের ঘর চালাতে হয়। সেইজন্যে আমরা ভোট দিয়ে সরকার গড়ি। যাতে সরকার দেশ চালাতে পারে। সরকার সেই কাজে আমাদের থেকে ট্যাক্স উশুল করে - কতরকম ট্যাক্স, এমনকি এই মজুররাও কি দিয়ে যাননি সেই ট্যাক্স অনবরত, লাল সুতোর বিড়ির বান্ডিলটা কিংবা বাচ্চার জন্যে দুধের প্যাকেটটা কেনার সময়? কোথায় যায় সেই ট্যাক্সের টাকা? কোথায় থাকে রাষ্ট্রের উদার অভিভাবকত্ব এই অভিনব এবং অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের কালে? আসল ক্রাইসিসগুলোর থেকে নজরে ঘোরাতে বছর বছর কেন এত নকল ক্রাইসিস আমদানি করা হয়?
কখনো ধর্মের নামে, কখনো নাগরিকত্বের নামে মানুষকে খেপিয়ে, উত্যক্ত, বিপর্যস্ত করে, তার সামনে হিন্দুত্বের গাজর ঝুলিয়ে পেছনের কাপড়টা পর্যন্ত টান মেরে খুলে নিয়ে আখেরে কাদের লাভ হয়? সমস্ত আইন বাঁচিয়ে, মানুষের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্যের সুযোগে, একটি নির্বাচিত সরকারকে দিয়ে আধুনিক ক্রীতদাস প্রথা জিইয়ে রাখে কারা - শ্রমিক, মজুরের নামে? প্রশ্ন অনেক, প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তর জানা থাকলেও লাভ নেই কিচ্ছু। কারণ এদেশে ভোট করাতে গেলে ভোটার থাকলেই চলে না, কর্পোরেটদের টাকাও লাগে, রাষ্ট্রচালনার সমস্ত ব্যর্থতাকে বিজ্ঞাপনে ঢেকে দিতে।
আরও পড়ুন: বিজেপি কি অন্য ভাবনা ভাববে? নাকি গৃহযুদ্ধই শ্রেয়?
'পরিযায়ী শ্রমিক' শব্দবন্ধটি মাসদুয়েক আগেও কতজন বাংলাভাষী জানতেন, তা নিয়ে আমার ঘোর সন্দেহ আছে। এই শব্দবন্ধের আড়ালে থাকা নামহীন খুচরো মানুষগুলোও কি এযাবৎ আমাদের কাছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ছিলেন? অথচ এঁরা তো এই বড় শহরগুলোতেই থাকতেন - আমাদের কমফোর্ট জোন-টি যা যা দিয়ে তৈরী অর্থাৎ শপিং প্লাজা, রেস্তোঁরা, মেট্রো রেল, মাখনের মতো হাইওয়ে - এঁদের ঘাম মিশে গেছে সেগুলোর আনাচে কানাচে। আমরা বছরের পর বছর সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে এসেছি, কর্পোরেটদের হাতে আমাদের রোজগার তুলে দিয়ে কিনে নিয়েছি ঠান্ডা ঠান্ডা আরাম। কিন্তু সেই লাভের গুড় পুরোটাই খেয়ে গিয়েছে আরও উঁচু একটা মহল, আর মজুরদের 'কোয়ালিটি অফ লাইফ' হয়ে উঠেছে ফাটা-চটা, চামড়া উঠে যাওয়া, ফোস্কা ভর্তি, ১,০০০ কিলোমিটার পাড়ি দেওয়া দুটো পায়ের পাতার মতোই।
হিটলারের ইহুদী-নিধন যজ্ঞ বা হলোকস্ট থেকে বেঁচে ফেরাদের সাক্ষ্য থেকে জেনেছিলাম, নাৎজি জার্মানি-অধিকৃত পূর্ব ইউরোপের কিছু কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প-এ 'মাস গ্রেভ'-এর ব্যবস্থা ছিল। কেমন সে ব্যবস্থা? একদল ইহুদী কী চেক কী পোলিশ বন্দি, নাৎজি ডাক্তারদের বিচারে যাঁদের খাটার ক্ষমতা ফুরিয়ে গেছে, তাঁদের দিয়ে সার সার আয়তক্ষেত্রের মতো গর্ত খোঁড়ানো হতো নির্দিষ্ট মাপে। খোঁড়ার কাজটা শেষ হলেই মানুষগুলো শাবল ফেলে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন সেই গর্তগুলোর সামনে। আর তারপরেই গেস্টাপো অফিসাররা তাঁদের ঘাড়ে পিস্তলের নল ঠেকিয়ে, একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ-এ গুলি করত। সেই গুলির অভিঘাতে তাঁদের প্রাণহীন দেহগুলো নিজেদেরই খোঁড়া কবরে গিয়ে পড়ত ঠিক ঠিক। পরের ব্যাচের বন্দিরা ফেলে দেওয়া শাবল কুড়িয়ে এই গর্তগুলো মাটি দিয়ে ঢেকে দিতেন আর নিজেদের লাশের জন্যে আরেক প্রস্থ গর্ত খুঁড়তে শুরু করতেন।
উত্তরপ্রদেশের রেললাইন-এ ঘুমিয়ে পড়া মজুরদের ধারালো চাকায় কেটে ফেলে যখন ছুটে চলে মালগাড়ি, কিংবা তাঁদেরই কোনও পেশাতুতো ভাইদের হাতে বানানো জাতীয় সড়কে হেঁটে চলা দিনমজুরদের পিষে দিয়ে চলে যায় ভারী ট্রাক, বিশ্বাস করুন, মনে হয় আমাদের ঝাঁ চকচকে ইন্ডিয়া-র বাইরের যে ভারত - তার গোটাটি বুঝি এই পরিযায়ী মজুরদের জন্যে একটা অতিকায় কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
নাৎজি-রা ইউরোপের বিভিন্ন পদানত দেশ থেকে ইহুদি বন্দিদের কীভাবে নিয়ে যেত লেবার ক্যাম্প বা কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প-এ? বিরাট বিরাট মালগাড়ির সীল করা ওয়াগনে তোলা হতো ৭০-৮০ জন বন্দিকে। বসা-শোয়া তো দূর-অস্ত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই যেতে হতো তিনদিন টানা। ঠিক যেভাবে গরু ছাগল যায় এদেশে ট্রাক বা ম্যাটাডোর বোঝাই হয়ে। টানা দাঁড়ানো অবস্থায়, নিজেদের মল-মূত্র নিজেদেরই অন্তর্বাসে বহন করতে করতে, এই নারকীয় যাত্রায় কতজন মরে বাঁচতেন জানি না। কিন্তু যাঁরা মরতেও পারতেন না এত সহজে, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো শক্ত হয়ে যাওয়া মৃতদেহের ভারটুকু বহন করেই বাকি সময়টা কাটাতে হতো - সেই ওয়াগনে পড়ে যাওয়ারও জায়গা থাকত না।
খুব একটা অমিল লাগছে না - ঠিক এভাবেই ছটি মৃতদেহের সাথে একই ট্রাকে ১১ ঘন্টা ধরে উত্তরপ্রদেশ থেকে ফিরেছেন পুরুলিয়ার শিবু কর্মকার, এই ভ্যাপসা গরমে, বমি চাপতে চাপতে। কী আর করা যাবে, মৃত মজুর তো আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে পারেন না শত তাড়নাতেও, তাঁদের মৃত শরীরও ডিকম্পোজিশন-এর অমোঘ নিয়মে ছড়িয়ে চলে গন্ধ। মৃতদেহের সাথে তোলা ওঁর সেলফি এখন সমাজ-মাধ্যমে ভাইরাল। যে শ্রমিকেরা স্ত্রীর শরীরের শেষ সোনাটুকু বিক্রি করে ৪,০০০-৫,০০০ টাকা মাথাপিছু দিয়ে ট্রাক ভাড়া করে ফিরছেন টানা তিন-চার দিন ধরে, ট্রাকের মধ্যে তাঁদের গাদাগাদি করে বসে থাকার ছবিগুলো একবার দেখবেন ভালো করে। এত করেও ট্রাকের ভেতরে বসতে না পেরে, পেছনের পাদানিতে পা রেখে ঘন্টার পর ঘন্টা প্রাণ হাতে করে দাঁড়িয়ে আসছেন যাঁরা, তাঁদের ছবিগুলো একবার দেখে নেবেন। অবিকল নাৎজি ইভাকুয়েশন-এর হাড়-হিম করা দৃশ্য মনে পড়ে যাবে।
বিজেপির মতো একটা চরম দক্ষিণপন্থী দল যে দক্ষিণপন্থী পদক্ষেপই নেবে এবং পুঁজিপতিদের স্বার্থই দেখবে সেটা জলের মতো পরিষ্কার, আলোর মতো স্পষ্ট। মুশকিলটা হচ্ছে, এখনও দেশে নির্বাচন নামক একটি গেরো রয়েছে, 'এক দেশ, এক দল' হয়ে যায় নি। তাছাড়া দেশের সব মানুষ এখনো গোচনা বা গোবর খান না, আদ্ধেক খান। ফলে কিছু নাটক করতেই হয় - যাত্রাপালার চড়া মেকআপ-এ ঢাকা সহজ নাটক, সেগুলো বুঝতে অর্থনীতির পন্ডিত হতে হয় না। যেমন ৫০ জন কর্পোরেট ঋণ-খেলাপিদের মোট অনাদায়ী ঋণের বকেয়া ৬৮ হাজার কোটির অঙ্কটা মুছে ফেলা, বা বছরে ১ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটির রাজস্ব ক্ষতির ধাক্কা সামলে কর্পোরেট করে ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি দেশের ৮ কোটি ভিন রাজ্যবাসী শ্রমিকের জন্যে দু'মাসের রেশন-বাবদ মাথাপিছু ৪৩৭ টাকার মতো একটা বিশাল অঙ্কের টাকা ঘোষণার নাটক।
এইটুকু পর্দা না করলে বোধহয় কোভিড-১৯ এর এই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে, বিরোধীদের ঝিমিয়ে পড়ার সুযোগে সবকিছু বেচতে থাকা এই সরকার, কৃষিপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রকারান্তরে দেশি বিদেশি পার্টনার কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া এই সরকারেরও আত্মনির্ভরতার বুলি আওড়াতে কোথাও একটা আটকাবে। এত বিলগ্নিকরণের থেকে ওঠা টাকা কোথায় যাবে? করোনার বাজারে কাজ হারানো, অপুষ্টি ও পারিবারিক আত্মহননের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো কয়েক কোটি মানুষের হাতে আসবে কি তার ছিটে ফোঁটা? কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয়, তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা সামলানোর জন্যে এই বিপুল অর্থের কতটা আরো উন্নততর স্বাস্থ্য পরিষেবার পরিকাঠামো নির্মাণে খরচ হবে? আশানুরূপ ভাবেই এর কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই।
বিজেপি যদি বড়লোক আর পুঁজিপতিদের দল হয়, তাহলে গরিব মানুষের পার্টি বললেই স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় মাথায় যে নামগুলো আসে, সেই সিপিএম ও অন্যান্য বামদল কি কেরালার বাইরে, সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে সত্যি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? যদি না গিয়ে থাকে, তবে পরিযায়ী শ্রমিকদের এই মহা অভিনিষ্ক্রমণ (এক্সোডাস) কেন বদলে গেল না এক অভূতপূর্ব লং মার্চে? কোভিড-এর ভয়কে তোয়াক্কা না করে শ্রমিকরা তো রোজই হাঁটছেন, তাঁদের সামনে, পাশে, বোতলে জল, কিছু পুরোনো জুতো, শুকনো খাবার আর কাস্তে-হাতুড়ি-তারার পতাকা নিয়ে কেন সামিল হলেন না বাম কর্মী, সমর্থক, নেতারা? শুধুই মাস্ক পরে চ্যানেলে বসে বাণী বিতরণ করে গেলেন।
আরও পড়ুন: সাপ্লাই লাইন, মদ কিংবা ছড়িয়ে থাকা রুটি
যে সব শ্রমিক ভিন রাজ্যে আটকে পড়েছেন, কন্ট্রাক্টর কোম্পানিগুলো তাদের ছাঁটাই করলে বা মাইনে না দিলে, ভবিষ্যতে বঞ্চিত হবে সরকার প্রদত্ত সমস্ত সুবিধে থেকে, এরকম আইন অবিলম্বে প্রণয়ন করার জন্যে কেন বামপন্থী দলগুলোর তরফে চোখে পড়ার মতো কোনো চাপ সৃষ্টি করা গেল না সরকারের ওপর? আসলে কোভিড-১৯ শুধু একটা ভেঙে পড়া ব্যবস্থাকে উলঙ্গ করে দেয়নি, এটাও চোখে আঙ্গুল ঢুকিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে বিজেপির রাম আর সিপিএম-এর মার্ক্স একই বন্ধনী-ভুক্ত, দুটোই ক্ষেত্রবিশেষে অজুহাত - প্রান্তিক মানুষকে নির্বিচারে শোষণ করার।
মানুষ ঘরে ফিরতে চায়, সে হামাগুড়ি দিয়ে, রেললাইনে ধরে হেঁটে হেঁটে, লরির পেছনে ঝুলতে ঝুলতে মরে গিয়ে হলেও। ঘর কোনটা? দেশ কোথায়? যেখানে বুড়িয়ে যাওয়া বাবা-মা থাকেন, ছোট ছোট ভাইবোন আধপেটা খেয়ে অপেক্ষা করে, যেখানে পৌঁছতে বারবার কান্নাঝরা ভিডিও বার্তা পাঠাতে হয় - "ওগো একবার আমাদের ঘরে পৌঁছে দাও গো, তারপর যা নিয়ম হবে সব শুনব, ঘরেই বসে থাকব, কিচ্ছু চাই না, না খেয়ে মরে গেলেও না, শুধু একবার ঘরে নিয়ে চলো গো।"
অখণ্ড হিন্দু ভারত পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন দেখানো গেরুয়া শিবির কি দেখেছে না, যে কোভিড-১৯ আরেকটা দেশভাগের চালচিত্র বিছিয়ে দিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল? দেখছে না, বিদেশ থেকে যে শিক্ষিত, ভদ্র বড়লোকদের বন্দে ভারতের রেড কার্পেট বিছিয়ে ফেরানো হচ্ছে, তাঁদেরই একাংশের বয়ে আনা রোগের প্রকোপে, না পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নয়, বরং ইন্ডিয়া থেকে গ্রাম ভারতের দিকে ছুটে চলেছে এক আশ্চর্য উদ্বাস্তুদের স্রোত, সেই সব উদ্বাস্তু, যাঁরা ভোটাধিকার থাকা সত্ত্বেও নিজেরই মাটিতে পরবাসী?
নাহ, কেউ কিচ্ছু দেখছে না। আগামী নির্বাচন অনেক দূরে। ততদিনে শ্রমিক মজুরদের রক্তে ভেজা রাস্তাগুলোর ওপর মাইলের পর মাইল শান্তিকল্যাণ বিছিয়ে নতুন উদ্যমে হিন্দু-মুসলমান, ভারত-পাকিস্তান কাটাকুটি খেলা শুরু হবে। এর সাথে নতুন করে, অন্তত বাংলায়, যোগ হতে চলেছে তিন-শতকের করালতম ঘূর্ণিঝড়ে ঘর-বসত হারানো হা-ঘরেদের মিছিল। কিন্তু কেউ কিচ্ছু দেখছে না। আগামী নির্বাচন এখনও তিন-চার বছরের নিরাপদ দূরত্বে।
রাজনীতির যে কারবারিরা ভাবছেন ততদিনে শ্রমিক মজুরদের রক্তে ভেজা রাস্তাগুলোর ওপর মাইলের পর মাইল শান্তিকল্যাণ বিছিয়ে নতুন উদ্যমে হিন্দু-মুসলমান, ভারত-পাকিস্তান কাটাকুটি খেলা শুরু হবে, তাঁরা কিন্তু প্রকৃতির সাবধানবাণী পড়তে ভুলে যাচ্ছেন। নির্বিচারে পরিবেশের সর্বনাশ আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবের ফলে অতিমারী, ঘূর্ণিঝড়ের মতো বিপর্যয় যদি তাদের স্বাভাবিক পর্যায়বৃত্ততা ছেড়ে পৌনঃপুনিক হয়ে ওঠে, তখন কিন্তু মানুষকে শুধু ফাঁপা প্রতিশ্রুতি খাওয়ালে হবে না। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া ন্যাংটো, নিরন্ন মানুষগুলোকে সেদিন সব হিসেব বুঝিয়ে দিতে হবে।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন