গণপিটুনি!
গণপ্রহার!
জিঘাংসার নতুন নাম।
আদিম জিঘাংসা নয়, তথাকথিত সভ্য সমাজের পাশবিক উল্লাস। তবে পাশবিক বললে পশুদের অপমান করা হয়। জঙ্গলেরও একটা নিয়ম আছে। নিছক বন্য আনন্দের তাগিদে একদল পশু মিলে আর এক পশুকে মেরে ফেলে না। খাদ্যের প্রয়োজন বা নিজেকে রক্ষা করার জন্য ছাড়া জঙ্গলে এমন অবাধ হত্যালীলা চলে না।
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে গণপিটুনির ফলে মৃত্যুর ঘটনা। এ মৃত্যু কোনও আকস্মিক কার্যকারণ নয়। এটা একদল মানুষ কৃত হত্যা। এ এক ভয়াবহ সামাজিক অসুখ। এই মুহূর্তে এই অসুখ মহামারীর আকার ধারণ করেছে। আইনকানুন, সামাজিক অনুশাসন, কিছুই এই অসুখ ঠেকাতে পারছে না। কোথা থেকে আসে এত তিক্ততা, এত বিদ্বেষ, বিতৃষ্ণা, বিরাগ আর অসহিষ্ণুতা?
ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ - ইস্যুর অভাব নেই। স্থান, কাল, পাত্র বিবেচ্য নয়। সামান্য ইন্ধন পেলেই দেশের যত্রতত্র একদল মানুষ মেতে উঠছে পিটিয়ে মারার নারকীয় উল্লাসে। এটাও প্রশ্ন, ইন্ধন পাওয়া না ইন্ধন খুঁজে নেওয়া? যেন মারার জন্য অহরহ হাত নিশপিশ করতে থাকে। হাত না মন? যত গন্ডগোল তো ওই মনের কারবারে। যার যেখানে যত রাগ, ক্ষোভ, আক্ষেপ, হতাশা উজাড় করে ঢালো কারও শরীরে। তার পরিমাণ এতটাই যে মানুষটার প্রাণই চলে গেল শরীর ছেড়ে? এটা একবার-দু'বার, একদিন-দু'দিন হলে বোঝা যেত, আকস্মিক ভাবে, গরম মাথায় হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা তো নয়! হয়েই চলেছে। হয়েই চলেছে। বলা উচিত, চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে।
আরও পড়ুন: গাছ লাগান, গাছ কাটুন, তাহলে হাতে রইল কী?
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, যারা মারছে, তারাও আমি-আপনি। যারা মরছে, তারাও ওই আমার-আপনার মতোই দেশের সাধারণ মানুষ। চোর সন্দেহ থেকে রামনাম জপ, অজুহাত খুঁজে নিয়ে মারণযজ্ঞে মেতে উঠছে কেউ বা কারা। কোন সাহসে তারা আইন তুলে নিচ্ছে নিজের হাতে? নাহ, এই প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু হয়। মজার কথা হলো, সেখানেও বেছে নেওয়া হয় পাঁচ-সাতজনকে। যদিও ঘটনাস্থলে হয়তো ছিল শতাধিক মানুষ। বলা বাহুল্য, এই উন্মত্ত শতাধিক মানুষকে খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়াটাই জরুরি হলেও, কার্যকারণে খাড়া করা হয় ওই পাঁচ-সাতজনকেই। সেই পাঁচ-সাতজনও কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেল কিনা, জানার উপায় থাকে না।
মোদ্দা কথা, লোকজন তাদের এই অসুস্থ খিদে মেটানোর ক্ষেত্রে আইনের বাধার সম্মুখীন কতটা, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। সামাজিক ভাবে বাধা পাওয়া তো দূর, ঘটে একেবারে উল্টো। সীমাহীন উস্কানি, ব্যাপক হারে অন্ধ ও অশিক্ষিত আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া। শুভবুদ্ধির মানুষরা সেখানে ব্রাত্য ও একঘরে।
আমাদের শৈশব-যৌবনেও এই ব্যাপারটা ছিল। তখন বলা হতো 'গণধোলাই'। চোর-পকেটমারের ভাগ্যে ধরা পড়লেই জুটত উত্তমমধ্যম। তা নিয়ে রসিকতা ইত্যাদিও হতো। কিন্তু এর ফলে কেউ মারা গেছে বলে কখনও শুনিনি। আসলে মেরে ফেলা বিষয়টাকেই অত্যন্ত অমানবিক ও নিন্দনীয় ভাবা হতো। একজন মানুষ একেবারে মরেই যাবে, এটা গ্রহণ করাটা এমন জলভাত ছিল না। আর এখন? চুরি-ছিনতাই-পকেটমারি ছাড়ুন, শুধু এক ধর্মীয় স্লোগান বলা বা না বলার জন্য পিটিয়ে মেরে ফেলা যেতে পারে মানুষকে যখন তখন, যত্রতত্র।
এই নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে দেশ জুড়ে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো সমাজের পক্ষে অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। কিন্তু এখানে তো সব কিছুই ঘুরেফিরে রাজনীতির পাকচক্রে জড়িয়ে যায়। গুলিয়ে, ঘুলিয়ে এমন কিছু ঘটতেথাকে , তাতে উপলক্ষের থেকে উপাচার বড় হয়ে ওঠে। সদিচ্ছা কিছু থাকলেও সেটা চাপা পড়ে যায়। দেশ জুড়ে গণপ্রহারের ঘটনার প্রেক্ষিতে কলকাতা ও মুম্বইয়ের বিশিষ্টজনেরা চিঠি লিখলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। ওঁর প্রতিক্রিয়া জানার আগেই আর একদল বিশিষ্ট প্রতিবাদপত্র লিখে ফেললেন। তাঁরাও সর্বভারতীয় স্তরের। এই সব চিঠিচাপাটি চালাচালির মধ্যেই আবার গণপিটুনির ঘটনা খোদ রাজধানীর বুকে। দিল্লীর আদর্শনগরে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হলো এক নাবালককে।
আরও পড়ুন: আধারের আঁধারে আলোর হদিশ
এইরকম একটা মারাত্মক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা প্রতিদিনই খবরের শিরোনামে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকা খুব স্পষ্ট নয়। সর্বস্তরে এ নিয়ে যা চলছে, তাকে তুমুল অরাজকতা ছাড়া আর কী বলা যায়? ধর্ম যেখানে রাজনীতির হাতিয়ার, সেখানে আম জনতার উপরেও যে তার প্রভাব পড়বে, এতে আর আশ্চর্য কী? সেই অনুসরণেই সঞ্চরণশীল এখন পুরো সমাজের গতিপ্রকৃতি। যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই যে কোনও মানুষের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানো এখন রাজনৈতিক স্মার্টনেসের পরিচয়।
এইসবের প্রেক্ষিতে টানাপোড়েনের জটিল জালে জড়িয়ে পড়ছে সংবাদ মাধ্যমও। উল্লেখ্য, সাংবাদিক সম্মেলনে অভিনেত্রী অপর্ণা সেনের এই গণপ্রহারের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার মুহূর্তটি। সম্মেলন চলাকালীন জনৈক টিভি চ্যানেলের এক সঞ্চালকের তাঁকে প্রশ্ন করার নামে একপ্রকার আক্রমণের চেষ্টা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু মনে হয়। আরে, প্রশ্ন করে তাঁকে জবাব দেওয়ার সুযোগ তো দিতে হবে! এই প্রশ্নের নামে চিৎকৃত আস্ফালন যেন খুব আরোপিত মনে হয়। ওই সাংবাদিক যে কোনও এক দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত, সেটা সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।
সোশ্যাল নেটওয়ার্ক। আমাদের আজকের মানুষের শয়ন-স্বপন-জাগরণ এখন এখানেই। সেখানেও বিপুল ভাবে ঘৃণা-বিদ্বেষ-জিঘাংসার বিষ ছড়ানো হচ্ছে। প্রবল প্ররোচনামূলক এমনই এক গান, 'জো না বোলে জয় শ্রীরাম', যা কম্পোজ ও আপলোড করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে চারজনকে। তবু ভালো! এতে অন্তত এই জাতীয় কাজকর্ম বন্ধ হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি গণপ্রহার প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রশ্ন তুলেছে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও বিভিন্ন রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে যে আইন, তার প্রয়োগের ক্ষেত্রে কতদূর সৎ ও সচেষ্ট। দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্মরণ করিয়েছে জুলাই ২০১৮-র সেই রায়, যেখানে স্পষ্ট ছিল একগুচ্ছ আইনি পরামর্শ, যার দ্বারা গণপ্রহার নামক মহামারীর প্রতিরোধ ও সমাধান সম্ভব। যারা এটা ঘটাচ্ছে তাদের জন্য শাস্তির বিধানও ছিল এই রায়ে।
আরও পড়ুন: অসহায় প্রবীণদের পাশে থাকতে হবে
কিন্তু শুধুই কি আইন ও প্রশাসনের দায়িত্ব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা? আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই? এই যে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক জুড়ে সর্বক্ষণ কিছু মানুষ নানা ইস্যুভিত্তিক উস্কানিমূলক পোস্ট ছড়াচ্ছে, আমরা কি তার প্রতিবাদ করি? প্রতিবাদ দূরের কথা, আমরা তথাকথিত শিক্ষিত, বুদ্ধিমানরাও ওই উস্কানির ফাঁদে পা দিয়ে তর্কে মেতে উঠি। সুস্থ পরিবেশকে অসুস্থ করি। আমাদের তর্কবিতর্ক হাওয়া গরম করে। সেই গরম হাওয়া মাথায় নিয়েই পথে বেরিয়ে পড়ে পাষন্ডরা।
একটা ছোট্ট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে প্রতিবেদন শেষ করব। বহু বছর আগে কোনও এক রাজনৈতিক দলপুষ্ট, একাধিক অসামাজিক কাজে লিপ্ত এক তরুণকে হাতের নাগালে পেয়ে মারতে উদ্যত হয়েছিল পাড়ার একদল তরুণ। ছেলেটি বহু অপকর্মের নায়ক। তার সেইসব কর্মের শিকার অনেকেই । কার্যকারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেখি ছেলেটি মাটিতে পড়ে আছে। আর তাকে বাঁচাতে ছেলেটির ওপরে পড়ে তার গর্ভবতী স্ত্রী। সবাইকে হাতজোড় করে কাকুতিমিনতি করছে সে। জনতা স্বভাবতই কিছু শোনার মুডে নেই। সকলেরই হাতে হয় লাঠি, নয় ক্রিকেট ব্যাট বা হকি স্টিক।
এক সেকেন্ডের মধ্যে ছবিটা দেখতে পেলাম, প্রথম আঘাতটা নেমে আসবে ওই গর্ভবতী মেয়েটির ওপর। তার পরের ও পরেরটাও। কারণ, ছেলের দল রাগের চোটে বোধবুদ্ধি হারিয়েছে। সেদিন আমি বাধা দেওয়ায় অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত ঘটে ওঠেনি। কৃতিত্ব নেওয়া নয়, পরিস্থিতির পার্থক্য পর্যালোচনা। সেদিন চরম অনিচ্ছাতেও ওরা আমার কথা শুনেছিল। আজ কি শুনবে? বরং আমিই হয়তো দু'ঘা খেয়ে যাব, অপমানিতও হব। আর এই আতঙ্কেই হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিবাদের মুখগুলিও। আতঙ্ক! এমন এক শব্দ, এমন এক অনুভব, যা তাড়িয়ে বেড়ায় বহুদূর পর্যন্ত। গণপ্রহারের আতঙ্ক যারা ছড়াচ্ছে তারা আমাদের মধ্যেই আছে। চিনে নেওয়াটা খুব জরুরি। শুধু চিনলে হবে না। তাকে বা তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সুস্থ ভাবনার অনুকূল স্রোতে।