গত মঙ্গলবার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের ১০ উইকেটের হারকে এতটুকু সমালোচনা না করেও কয়েকটা কথা উল্লেখ করা দরকার। ক্রিকেট একটা খেলা, যা ভারতীয় সমর্থকদের কাছে ধর্মের সমান। খেলায় হারজিত থাকতে পারে। এই প্রথম ভারত ১০ উইকেটে হেরেছে, সেও যেমন নয়, তেমনই এর পরে অন্য কোনও টিমের কাছে ১০ উইকেটে হারবে না, এমন কথা অতি তীব্র সমর্থকও বলতে পারবে না।
ভারত এই নিয়ে পাঁচবার কোনও দলের বিরুদ্ধে ১০ উইকেটে হারল। অস্ট্রেলিয়া যেমন ১০ উইকেটে জিতেছে, তাদেরকে কোনও দলের বিরুদ্ধে ১০ উইকেটে নতিস্বীকারও করতে হয়েছে। মুম্বইতে টসে জিতে সঙ্গত কারণেই ভারতকে ব্যাটিং করতে আমন্ত্রণ জানায় অস্ট্রেলিয়া। শুরুতে বিশ্রাম থেকে ফিরে আসা রোহিত শর্মাকে হারালেও ১২৪ রানের একটা পার্টনারশিপ গড়ে ওঠে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা কে এল রাহুল ও শিখর ধাওয়ানের মধ্যে। দুই ব্যাটসম্যানই আউট হন অত্যন্ত সাদামাটা শট খেলে, এবং সেট হয়ে।
তারপরে একটি ৪৯ রানের পার্টনারশিপ হয় ঋষভ পন্থ ও রবীন্দ্র জাদেজার মধ্যে। বিরাট কোহলি এবং ভারতীয় মিডল অর্ডার রান না পাওয়াতে স্কোর গিয়ে দাঁড়ায় ২৫৫। অস্ট্রেলিয়া ভারতের রান তাড়া করতে এসে কোনও উইকেট না খুইয়ে সিরিজের প্রথম একদিনের ম্যাচটি জিতে নেয় অনায়াসে। অস্ট্রেলিয়ার দুই ওপেনার, অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ ও ডেভিড ওয়ার্নারের দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং ও পেশাদারিত্ব অস্ট্রেলিয়াকে পৌঁছে দেয় তাদের লক্ষ্যে।
অস্ট্রেলিয়া হোমওয়ার্ক ছাড়া নামে না
২০১৯-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল বাদ দিলে বছরটা মোটামুটি দুর্দান্ত কেটেছে ভারতের। টেস্ট ম্যাচেও এই একই কথা বলা যায়। শুধুমাত্র টি-২০ আন্তর্জাতিকে ভারতের 'স্ট্যান্ডার্ড' তুলনায় কিছুটা ম্লান। অপরপক্ষে অস্ট্রেলিয়া ওয়ার্নার ও স্মিথের নির্বাসন থেকে ফিরে আসার পর তাদের দল গুছিয়ে নিয়েছে, সেই অ্যাশেজ সিরিজ থেকেই। ভারতের বিরুদ্ধে নতুন বছরের প্রথম একদিনের ম্যাচেই বেশ বোঝা গেল, ভালো হোমওয়ার্ক করে এসেছে তারা। বোলারদের 'হাফ-ভলি' বা 'ওভারপিচ' প্রায় নেই বললেই চলে, 'ব্যাক অফ গুড লেংথ' বল ঠুকে গায়ের দিকে নিয়ে এসে শট খেলার জায়গা না দেওয়া, 'উইকেট টু উইকেট' বল করা, যাতে 'স্কোয়ার অফ দ্য উইকেট' বেশি ব্যাটসম্যান খেলতে না পারে।
দুই স্পিনার অ্যাশটন এগার ও অ্যাডাম জাম্পা তাঁদের নির্ধারিত ২০ ওভারে মাত্র ১০৯ রান দিয়ে কোহলির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতীয় মিডল অর্ডারের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। জোরে বোলারদেরও প্রশংসা করতেই হবে। মিচেল স্টার্ক, প্যাট্রিক কামিন্স, ও কেন রিচার্ডসন নিজেদের মধ্যে সাতটি উইকেট ভাগাভাগি করে নেন, এবং ২৯.১ ওভারে রান দেন মাত্র ১৪৩। অতিরিক্ত স্রেফ ১১টি, তার মধ্যে নো বলের সংখ্যা শূন্য। এতটাই নিয়মানুবর্তিতা ছিল অস্ট্রেলিয়ার বোলিংয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিংও যে বিশ্বমানের, বলাই বাহুল্য।
বিরাটকে খেলতে দিন
ভারত ফর্মে থাকা ব্যাটসম্যান খেলিয়েছে, খুব ভালো কথা। রোহিত শর্মা দলে ফিরে আসাতে প্রথম তিনজন ব্যাটসম্যানকে একধাপ করে পিছোতে হয়েছে। অর্থাৎ রোহিতের সঙ্গে ওপেন করেন ধাওয়ান, তিন নম্বরে আসেন রাহুল, এবং চার নম্বরে আসেন অধিনায়ক, একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান, বিরাট কোহলি। এর ফল হলো, ২৯ তম ওভারের শেষ বলে স্ট্রাইক নিতে এলেন বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান, যখন অর্ধেকের বেশি ইনিংস সমাপ্ত। সাধারণভাবে আমরা জেনে এসেছি, টিমের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক নেবেন, বা বল খেলবেন। তিন নম্বরে তাঁর জায়গা, তিনি কেন সরবেন সেখান থেকে?
এর আগে আমরা ইতিহাসে দেখেছি, অনেক খেলোয়াড় বা অধিনায়ক তাঁদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন দলের স্বার্থে। কে এল রাহুলকে কিন্তু এর আগে চার নম্বরে ব্যাট করতে দেখা গেছে। তিন নম্বর এমন একটি স্থান যে, যে ব্যাটসম্যান সেখানে ব্যাট করেন তিনি দলকে স্থায়ীত্ব দেন, এবং একইসঙ্গে স্কোরবোর্ডকেও সচল রাখেন। বিরাট এই কাজটি ধারাবাহিকভাবে করে এসেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ, আগে ব্যাট করে, বা পরে।
দল নির্বাচন এবং
তীব্র বোলিংয়ের বিরুদ্ধে শ্রেয়স আয়ারকে তাঁর ব্যাটের বাঁধুনি আরও আঁটসাঁট করতে হবে। ভারতের এখনও প্রথম তিনজন আউট হলেই বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। মনীশ পাণ্ডের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ায় শতরান আছে, তার উপরে দুর্ধর্ষ ফিল্ডার। উপমহাদেশের বাইরের দলগুলোর বিরুদ্ধে 'কুলচা', অর্থাৎ যুজবেন্দ্র চাহাল এবং কুলদীপ যাদবের জুটিকে খেলিয়ে দেখা যেতে পারে। 'রিস্ট স্পিন' তাদের পক্ষে কিছুটা ভয়ের উদ্রেক করে।
শিবম দুবেকে দলের সঙ্গে না ঘুরিয়ে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চাপের মুখে তার 'রিয়্যাকশন' কী, একবার যাচাই করে নিতে হবে। ৩৬-৩৭ বছর বয়সে কেদার যাদবের স্কোয়াডে উপস্থিতি কি ভারতীয় দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? অক্টোবরে টি-২০ বিশ্বকাপে যদি কেদার যাদবের কথা ভাবা হয়, তাহলে এহেন সিনিয়র খেলোয়াড়কে স্কোয়াডে বসিয়ে রাখা কি উচিত?
মহম্মদ শামি গত দু'বছরে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন। জসপ্রীত বুমরার জুড়িদার কে হবেন, তা জানার জন্য নভদীপ সইনিকে বিশ্বের অন্যতম কঠিন দল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে খেলাতে হবে। এই দুই বোলারের সাফল্য এনে দেবে আত্মবিশ্বাস। ২০১৯-এর মার্চে অস্ট্রেলিয়া ওয়ার্নার-স্মিথ ছাড়া ভারতকে ৩-২ সিরিজ হারিয়ে গিয়েছিল, ২-০ তে পিছিয়ে পড়েও। ভারতকে এই দ্বিপাক্ষিক সিরিজ জিততে গেলে শ্রেষ্ঠ দল মাঠে নামাতে হবে।
বিশ্ব ক্রিকেটে যদি অস্ট্রেলিয়া কোনও দলকে সমীহ করে, তা হলো ভারত। প্রথম এশীয় দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জেতে ভারত। টেস্ট এবং একদিনের আন্তর্জাতিক। ভারতের রেকর্ড 'ডিসাইডার' বা নির্ণায়ক ম্যাচগুলোতে বেশ ভালো। ভারতকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। রাস্তা মসৃণ নয়। যাত্রা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়।
শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ের নিয়মিত কলাম পড়ুন এখানে