Advertisment

দীঘিপুকুরের আয়নায় জীবন

একটু গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়, সবকিছুর পরও, এই বইটি কেবল জলসংরক্ষণ বিষয়ে একটি অসামান্য বই নয়, এর বীক্ষণ থেকে ক্রমশ একটি পুষ্পের মত ধীরে ধীরে দল মেলে দেয় একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

সমস্ত প্রাপ্ত জিনিসের যত্ন করায় অভ্যস্ত এই ছোট গ্রামটিতে আজও প্রতি একশ’ জন লোকপিছু একটা করে পুকুর আছে (ছবি- উইকমিডিয়া কমনস)

কলকাতা বইমেলার বয়েস হয়ে গেল চুয়াল্লিশ। এটাই ছিল আমাদের প্রথম বইমেলা। উৎসবের উৎসমুখ। কত রোমাঞ্চময় আনন্দের স্মৃতি। প্রায় প্রতিটি বইয়ের সঙ্গে জড়ানো কিছু স্মৃতি। ভাবছি এই বইপার্বণের দু-সপ্তাহ তাই প্রিয় বই প্রসঙ্গেই লিখব, যদি পাঠকেরা সহ্য করে নেন।

Advertisment

উনিশশো সাতানব্বই সালের ১৫ই জানুয়ারি একটা বই হাতে পেলাম। পুকুরের কথা নিয়ে লেখা কিংবা ঠিক লেখা বলা যাবে না, অতি যত্নে তৈরি করা একটা আস্ত বই। লেখকের নাম শ্রী অনুপম মিশ্র।

publive-image এই বইটি অনূদিত হয়েছে ফরাসি, সোমালি, ইংরিজিসহ পৃথিবীর অনেককটি ভাষায়

পুকুর, যা কিনা আমরা নিতান্ত ছোটবেলা থেকে একটা স্বাভাবিক জিনিস মানে প্রায় প্রাকৃতিক কোন সংস্থানের মত স্বতঃসিদ্ধভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি, সেই পুকুরের আয়নায় কীভাবে ধরা আছে আমার এই দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক বিবরণ অর্থাৎ আমার দেশের প্রকৃত ইতিহাস, তারই কথা বলা বইটির নাম,  ‘আজ ভী খরে হৈ তালাও’- আজও পুকুর সর্বশ্রেষ্ঠ। ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ কী?- না, জলের অভয় পাবার উপায়। কম জল আর অধিক জল, অনাবৃষ্টি আর অতিবৃষ্টি, দুই থেকেই রক্ষা পাবার সবচেয়ে স্থায়ী, সবচেয়ে কল্যাণকর সম্মেলক রাস্তা হচ্ছে পুকুর। এই কথাটি যে কতোদিক থেকে কী মায়া আর সৌন্দর্যে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়েছে সে কথা বুঝিয়ে বলা যাবে না।

মনোরঞ্জন ব্যাপারী ও অরুন্ধতী রায়, শেষ পর্যন্ত দুজনেই…

এইবই সেই সব বিরল বইয়ের মধ্যে একটি যারা বদলে দিয়েছে পাঠকের জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী, ইতিহাসবোধ, এককথায় যাকে বলা হয় দার্শনিকতা। আমার আগেও বহুবার মনে হয়েছে সংস্কৃতভাষায় আর যারই অভাব থাকুক, শব্দের অভাব নেই। ‘কাদম্বরী’ উপন্যাসের অন্যতমা নায়িকা মহাশ্বেতা যে কী অমলিন গৌরাঙ্গী তার বর্ণনায় কুড়িটির বেশী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যাদের প্রতিটির অর্থ ভিন্ন।

তাহলে সেই ভাষায় ‘দেখা’ আর ‘বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী’- এই দুটো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোঝাতে একই শব্দ ব্যবহার করা হল কেন,- দর্শন? তাকি এইজন্য যে সেই শব্দস্রষ্টারা কোথাও মনে করতেন দেখবার অর্থাৎ প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ জানবার সঙ্গে বিশ্ববিষয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি হয়ে ওঠার কোন যোগ আছে? তাই আমাদের মত দেশগুলির সংস্কৃতিতে প্রকৃতি সম্পর্কে গভীর উপলব্ধির ভাবনাই কখনও কখনও ধর্মের রূপ নেয়? বা অন্তত ধর্মীয় আচারসমূহ মিলে মিশে থাকে প্রকৃতির নানা নিয়মের সঙ্গে?

এইসব কত আচারনিয়মের মধ্যে যে মিশে থাকে পুকুর বিষয়ের নানান বিষয়, তা আমরা কখনও খেয়াল করিনা। এই খেয়াল না-করা থেকে, অন্যমনস্ক জীবন কাটানো থেকে আমাদের এক নতুন আশ্চর্য মায়ার জগতে নিয়ে যায় অনুপম মিশ্রের বইটি। সারা ভারতবর্ষ থেকে দীর্ঘকালের আগ্রহ আর অনুসন্ধিৎসা দিয়ে তুলে এনেছেন পুকুর-বৃত্তান্ত-

হর্নশূন্য আইজল,  কলকাতা কি সপ্তাহে একটা দিনও হর্নশূন্য হতে পারে?

‘আজকাল বড়ো শহরের হিসাব করা হয় তার জনসংখ্যা দিয়ে। একসময় ছিল যখন একটি জনপদ কতোটা বর্ধিষ্ণু তার সাক্ষ্য দিত সে জনপদের জলাশয়ের সংখ্যা। শহর বা গ্রামটিতে কত লোক বাস করে-র জায়গায় খোঁজ নেওয়া হত- কটা পুকুরের গ্রাম?

ছত্তিসগড়ে বলা হয় আদর্শ জনপদ হল যেখানে ‘ছৈ আগর ছৈ কোড়ি’ অর্থাৎ ছয় কুড়ি ছ’টা পুকুর। বিলাসপুর জেলার খ্রিষ্টপূর্ব আমলের গ্রাম মলহার-এ এখনও ছয় কুড়ি মানে একশ কুড়ি আর ছয়, পুরো একশ’ ছাব্বিশটা পুকুর আছে।  ওইখানে রতনপুর (দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী), খরৌদী(সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতক), রায়পুরের আরঙ্গ, কুবরা আর সরগুজা জেলায় এখনও আট শ’ হাজার বছরের পুরোন জলাশয় দেখা যায়।‘

এই বিবরণ দেবার সঙ্গেসঙ্গেই, একনিঃশ্বাসে অনুপম মিশ্র চলে যান তাঁর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টিতে- ‘এইসব জলাশয়ের দীর্ঘজীবনের এক রহস্য ছিল – এদের প্রতি মমত্ব। এ আমার, আমাদের নিজের। এই বিশ্বাসের সামনে রক্ষণাবেক্ষণের মত শব্দ তুচ্ছ হয়ে যায়। ‘ভুজলিয়া ব্রতকারিণীর অষ্ট-অঙ্গ যেন জলে ডুবে থাকে’ এতটা জল পুকুরে রাখবার প্রার্থনাগীত গাওয়া মেয়েদের পেছনে তো তাদের সমাজও থাকত, যে সমাজে এই মনোকামনা পূর্ণ করার প্রচেষ্টা ছিল...।’

জল যার নিত্যপ্রয়োজন, সেই সমাজের সঙ্গে তার জলাশয়ের একান্ত সম্পর্ককে প্রকাশ পাচ্ছে সমস্ত বইটি জুড়ে। কীভাবে এই দেশের সমাজ নিজের প্রয়োজনীয় জলের ব্যবস্থায় স্বনির্ভর ছিল তার বাস্তব হিসাব দিচ্ছেন লেখক আর বলছেন তার কারণ, ‘(মধ্যপ্রদেশের)রীওয়া জেলার জোড়ৌরী গ্রামে ২৫০০ মানুষের বাস ছিল, তাদের বড়ো জলাশয় ১২টা। কাছাকাছি তাল মুকেদান- লোকসংখ্যা ১৫০০, পুকুরের সংখ্যা দশ। সমস্ত প্রাপ্ত জিনিসের যত্ন করায় অভ্যস্ত এই ছোট গ্রামটিতে আজও প্রতি একশ’ জন লোকপিছু একটা করে পুকুর আছে।

যখন এই পুকুরগুলো তৈরি হয়েছিল, তখন লোক ছিল আরো কম... গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে রাজ্যস্তরে যদি দেখিয়াবার ফিরে আসি (মধ্যপ্রদেশের)রেওয়া রাজ্যের কথায়। আজকের হিসাবে একে ‘পিছিয়ে থাকা’ই বলা হয়, কিন্তু জলের ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গত শতাব্দীতে ছোটবড় মিলিয়ে এখানে প্রায় ৫০০০ জলাশয় ছিল।

‘নিচে দক্ষিণের রাজ্যগুলোকে দেখলে স্বাধীনতার একশ বছর আগেও মাদ্রাজ রেসিডেন্সিতে ৪৩,০০০ পুকুরের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে। এখানে ১৮৮৫ সালে কেবল ১৪টা জেলাতেই দেখা যাচ্ছে ৪৩,০০ জলাশয়ে কাজ চলছে। মহীশূর রাজ্যে...১৯৮০ সালেও দেখা যাচ্ছে প্রায় লোকেদের সেবা করছে প্রায় ৩৯,০০০জলাশয়। এধার ওধার ছিটিয়ে থাকা সমস্ত হিসেব একত্র করে দেখলে একথা বলাই যায় যে এই শতাব্দীর পয়লা আষাঢ় থেকে ভাদ্র-সংক্রান্তি পর্যন্ত সারাদেশে এগারো থেক বারো লক্ষ জলাশয় সেই জল কোল পেতে নিত’।

পাঠক একটু একটু করে অনুপম মিশ্রের তোলা প্রশ্নগুলোর মধ্যেকার দর্শনটিকে বুঝতে পারেন। তার কারন সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন আর তাঁর ভিতরে জন্ম নেয় এক অপরিচিত নতুন দেখা। যা কিছু চোখের সামনে খোলা পড়েছিল, একেবারে সাধারণভাবে, সেই দর্পণে ক্রমশ ভেসে ওঠে এক নতুন সর্বব্যাপী ছবি। যে সমাজের ‘ভালো করা’র জন্য আমরা বহু কথা, অনেক প্রচেষ্টা, ব্যয় করেছি অথচ ইপ্সিত ফল পাই নি, স্বনির্ভর হবার বদলে তা ক্রমশই হয়ে পড়েছে ‘সমাজসেবী’দের প্রজেক্টের ওপর বেশি বেশি নির্ভরশীল, ধীরে ধীরে আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার প্রকৃত চেহারা, তার নিজস্ব মুখ। ‘হঠাৎ কোন শূন্য থেকে তো নেমে আসে নি এই শতসহস্র দীঘিপুকুর! এর পেছনে একভাগ অংশ যদি থেকে থাকেন তৈরি করানোর মানুষরা, তার সঙ্গে আছেন দশগুণ লোক যাঁরা তৈরি করতেন। এই একক দশক মিলে শতসহস্র হত।  গত মাত্র দুশো বছরের সামান্য কিছু নতুন শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ বহুকালের সেই শতসহস্রের সমাজকে শূন্য বানিয়ে ফেলেছে।’

অনুপম মিশ্র এমন কোন পাঠ দেন না যেটি আয়ত্ত করলে আমাদের শিক্ষা সমাপ্ত হবে, রাস্তাটা দেখিয়ে দেন কেবল। ‘এরকম করতে হবে’ নির্দেশ নয়, ‘আমি এরকম ভাবে চলেছি’- এই যাত্রাপথের নব নব হয়ে ওঠা বিবরণ যার মধ্যে দিয়ে জলের দর্পণে দেখা যায় সমাজের নিজের মুখ, ‘জোর থাকত এই কথাটার ওপর যে নিজেদের এলাকায় ঝরে পড়া বৃষ্টির জলের প্রতিটি বিন্দু যত্ন করে সংগ্রহ করে নিতে হবে আর সংকটসময়ে আশপাশের যতদূর অবধি পারা যায় তা ভাগ করে নিতে হবে। প্রতিটি গ্রাম বরুণদেবতার প্রসাদে নিজেদের অঞ্জলি পূর্ণ করে নিত।’

একটু গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে বোঝা যায়, সবকিছুর পরও, এই বইটি কেবল জলসংরক্ষণ বিষয়ে একটি অসামান্য বই নয়, এর বীক্ষণ থেকে ক্রমশ একটি পুষ্পের মত ধীরে ধীরে দল মেলে দেয় একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। সেই দৃষ্টির কাছে উন্মোচিত হয় ‘প্রতিদিনের পথের ধুলায়’ পড়ে থাকা এক চিরনবীনার মুখ, যে আমাদের সমস্ত দেশ, সমগ্র সমাজের সঙ্গে জুড়ে দেয় আমার ব্যক্তিগত অস্তিত্বকে। যেখানে মনের গভীর থেকে সত্য হয়ে ওঠে এই বিশাল ভুবনের পশুপাখিগাছলতার সঙ্গে, বিবিধ মানুষের বিচিত্র সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে একজন মানুষের ক্ষুদ্র অস্তিত্বের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের স্বরূপ। সে যে কোন ভিন্ন আধ্যাত্মিকতা নয়, সাধারণ জীবনযাপনের স্তরে স্তরেই মেলা আছে সেই সংলগ্নতা যার বিহনে দুনিয়া জুড়ে লক্ষলক্ষ মানুষ একাকীত্বের বিষণ্ণতার শিকার।

এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ অনুপমের বইটি ধারণ করে আছে নিজের সর্বাঙ্গে। এই প্রথম দেখেছিলাম একটি বই যার পরিশিষ্টটি সাজানো হয়েছে অবিকল মূল লেখাটির মতই যত্নে। সেখানে কী সম্মানে উল্লিখিত আছে পুকুর বিষয়ে যে কোন কাহিনী, লোককথা, প্রাচীন জ্ঞানের কোন প্রথা বা আচারের  বিবরণ- যে কোন গ্রামে, যে কোন পথের ধার থেকে, জঙ্গলের কিনার থেকে, কোন গ্রামবৃদ্ধ/বৃদ্ধার কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে সে সকলের খুঁটিনাটির সশ্রদ্ধ উল্লেখ। প্রথম দেখেছিলাম একটি প্রচন্ড পরিশ্রমসাধ্য গবেষণায় তৈরি বইয়ের প্রিন্টার্স পেজে লেখা ছিল ‘এই বইয়ের যে কোন অংশ কেউ নিজের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারেন’।

এটা খুব আশ্চর্যের নয় যে জলচর্চার মধ্যে দিয়ে জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখানোর  এই বইটি অনূদিত হয়েছে ফরাসি, সোমালি, ইংরিজিসহ পৃথিবীর অনেককটি ভাষায়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মিলিয়ে বিক্রি হয়েছে প্রায় একলক্ষ কপি।

এই কলামের সব লেখা একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Jol Mati
Advertisment