ভারতের বাজেট অর্থনীতি মোদির সামনে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত এক চূড়ান্ত আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে চলেছে। এক প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে চলছে নরেন্দ্র মোদীর ভারত নামক জাহাজ। মনে হচ্ছে জাহাজে অনেকগুলো ছিদ্র ধরা পড়েছে। অন্ধকার রাত ঝমঝম বৃষ্টি। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। জাহাজের মধ্যে জল ঢুকছে। প্রধানমন্ত্রী হাল ধরেছেন। খরস্রোতা সমুদ্রের মধ্যে কাণ্ডারী নাবিক মোদি দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ হাতে একটা বালতি নিয়ে জাহাজে বসে ঢুকে পড়া জল ভরে বাইরে ফেলতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু এত সহজে কি জাহাজে জমে থাকা জল বের করা সম্ভব?
এই রকম একটি ব্যঙ্গচিত্র দেখে মনে হল ১ ফেব্রুয়ারি আবার ভারতের আর একটি বাজেট পেশ হতে চলেছে। কিন্তু মোদী সরকার কি পারবে এবারের বাজেটের মাধ্যমে দেশের আর্থিক সংকট মোচন করতে? শুধু একটা বাজেটের মাধ্যমেই দেশের অর্থনীতির সংকট ঘুচে যায়, এমনটা কখনোই মনে হয় না। কিন্তু ভারতে নানা সময়ে নানা ধরনের বাজেট দেশের আর্থিক অভিমুখ নির্ধারণ করেছে, এ ব্যাপারে তো কোনও সন্দেহ নেই।
১৯৯১ সালের বাজেট তো এক যুগান্তকারী সন্ধিক্ষণ। এই বাজেটের মাধ্যমে দেশের আর্থিক সংস্কারের দরজা খুলে যায়। আজ দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এর আর্থিক উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যাল। তিনি নিজেই লিখেছেন যে ৯১ সালের এই আর্থিক সংস্কার যেন ৪৭ সালের পর দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। পৃথিবীর সামনে আর্থিক বৃদ্ধির ইতিবাচক সম্ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই বাজেট ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭৩ সালে ওয়াই বি চবন অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে বাজেট পেশ করেন তাতে কয়লা খনির ক্ষেত্রে জাতীয়করণ করা হয়। করের ভাগ ও তিনি ৯৭.৫ থেকে ৭৭ ভাগ কমিয়ে আনেন। অবশ্য মোরারজি দেশাই ৬৮ সালে দক্ষিণপন্থী বাজেট পেশ করেন। তিনি প্রশাসনিক বোঝা কমানোর জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। বিশেষত শুল্ক ক্ষেত্রে। যশবন্ত সিনহা ১৯৯৮–২০০০ সালে টেলিকম বিভাগের ওপর থেকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে দেন। টেলিকম বিভাগকে বাজারে উন্মুক্ত করা এবং বেসরকারি লগ্নি বিনিয়োগ করা, সেই সময়কার রাজনৈতিক পটভূমিতে ছিল এক বড় ঘটনা। পেট্রোলিয়াম ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কমান যশবন্ত সিনহা। কিন্তু ৯৭ সালে চিদাম্বরমের বাজেট বর্ধিত ব্যাজারের প্রাতিষ্ঠানিক এবং নিয়ন্ত্রক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী হলেন অরুণ জেটলি। তিনি ডিজিটাল ইন্ডিয়া গঠনের কথা ঘোষণা করেন। স্মার্ট সিটি তৈরি করার কথা বলা হল। আর প্রধানমন্ত্রীর নামে বেশকিছু সামাজিক প্রকল্প ঘোষণা হল যেমন প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনা, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, শৌচালয় ও গরিব মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ও সিলিন্ডার দেওয়া। তখনই আমরা বুঝেছিলাম মোদি ক্ষমতায় এসেও সামাজিক জনকল্যাণমূলক নীতি থেকে আদৌ সরছেন না। ওইসব থ্যাচার পন্থী পুঁজিবাদের সংস্কারমূলক কড়া দাওয়াই জগদীশ ভগবতীর বক্তৃতাতেই শুনতে ভালো লাগে। এসব কর্মসূচি বাস্তবে প্রয়োগ করা সহজ নয়। এমনকি স্বপ্ন দেখালেন ২০৭৫ ট্রিলিয়ন ডলারের ভারতীয় অর্থনীতি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে দেবেন ২০২৪ সালে। তার ঠিক ছমাস পরেই সীতারমণ ১ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় বাজেট তৈরি করছেন। সেই বাজেট পেশের মাত্র কয়েকদিন আগে মনে হচ্ছে এই লক্ষ্য পূরণ কার্যত অসম্ভব। ২০১৯ সাল শেষ হলো শতকরা ৫ ভাগ বৃদ্ধির পরিসংখ্যানে, এত কম বৃদ্ধি ভারতের অর্থনীতিতে সাম্প্রতিককালে আর পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার হয়নি। বৃদ্ধিতে ২০২৪ সালের মধ্যে পৌঁছতে গেলে এ দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হওয়া দরকার শতকরা ৫ থেকে ৯ ভাগ। করপোরেট কর কমানো এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে সহজ ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের এর মধ্যেই নিয়েছে। কিন্তু এইসব সরকারি সিদ্ধান্তে যে খুব ভালো হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখনও দেখানো যাচ্ছে না।
এদেশে বেসরকারি কনজামশন কমেছে। বিনিয়োগ কমেছে। ডমেস্টিক ডিমান্ড কোথায়? সংবাদমাধ্যমে প্রায় সর্বত্র বলা হচ্ছে ভারতের আর্থিক অবস্থা এখন নজরকাড়া। বেসরকারি বিনিয়োগ কেন আসছে না তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু এই বিনিয়োগ যে কিভাবে বাড়বে বাজেটে যে তার কোনো প্রতিফলন হবে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কর্মহীনতার সমস্যা থেকেও আপাতত ভারতীয় মানুষকে বাঁচানো যাচ্ছে না। জিএসটির দর্শনটা ছিল ভালো। একটা দেশ একই রকমের কর দান। কিন্তু এই জিএসটি রাজ্যে রাজ্যে প্রয়োগ করতে গিয়ে এসেছে অনেক রকমের জটিলতা। ফলে বহু ক্ষেত্রে জিএসটির আইন সংশোধন করে সরকারকে পিছু হটতে হয়েছে। আবার জিএসটি সংগ্রহের অংক যে খুব আশাব্যঞ্জক তাও হয়নি। ভারত এখন ঋণের দায়ে আক্রান্ত। ট্যাক্স কমানো মুশকিল কেননা তাতে রাজস্ব ঘাটতি বাড়বে। ঋণ এবং বৃদ্ধির অনুপাত ভারতে খুব বেশি।
অস্বীকার করা যায় না, শুধু ভারতে নয় গোটা দুনিয়াতেই চলছে এক চূড়ান্ত আর্থিক লোকসান। এমতাবস্থায় বাজারের চাহিদা নেই। লোকে জিনিসপত্র কিনছে না। সরকারি খরচও কিভাবে বাড়ানো হবে তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু বাজারে সচলতা দরকার বিশেষভাবে।
কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্তি, রাম মন্দির নির্মাণ, নাগরিকত্ব বিল, অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দিকে এগোনো এসব নিয়েই যতই বিতর্ক হোক, মানুষ কিন্তু বলছে শুধু রাম নয়, রুটি চাই। তাই দেশের আর্থিক সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করাই হল মোদীর এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সংসার খরচ কমিয়ে ফেলেছেন মধ্যবিত্তরা। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাদের সঞ্চয়ের পরিমাণও কমেছে। মধ্যবিত্তের এই বিতৃষ্ণাই এখন আর্থিক সংকটের প্রধান কারণ। বহু আর্থিক উপদেষ্টাও এমন কথা বলছেন। সংসার খরচ, সঞ্চয় কমছে কেন?
প্রথম কারণ, আয় কমা বা প্রত্যাশিত হারে না বাড়া। দ্বিতীয় কারণ, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মধ্যবিত্তদের এই বিতৃষ্ণা কিভাবে কাটানো যায়, বাজেটে তার রাস্তা খুঁজছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু মধ্যবিত্তের হাতে এই বাড়তি টাকাটা দেওয়া হবে কি করে? প্রত্যক্ষ কর বিধি সংক্রান্ত টাস্কফোর্স সুপারিশ করেছে ২০২৫ লাখ টাকা থাকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর ১০% করা হোক। এখন ২.৫ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা আয়ের ৫ শতাংশ হারে কর দিতে হলেও ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা আয়ে ২০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়। টাস্কফোর্সের এই সুপারিশ মানলে আয় করের বোঝা কিছুটা কমতে পারে।
আজকের এই পরিস্থিতিতে আরেকটি নজরকাড়া বিষয় হল দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতাসীন থাকলেও একের পর এক রাজ্য সরকার গুলিতে অবিজেপি সরকার গঠন হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে তো আগেই হয়েছিল, এবার মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড হারানোর পর এই প্রবণতা স্পষ্ট। দিল্লির বিধানসভা ভোট এখনো হলোই না, কিন্তু মনে হচ্ছে কেজরিওয়াল যেন জিতে বসে আছেন। কেজরিওয়াল দিল্লিতে সাধারণ মানুষের জন্য বিদ্যুতের দাম কমিয়ে দিয়েছেন, মেয়েদের জন্য বাসে যাতায়াত বিনামূল্যে করে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় মোদির পক্ষেও পপুলিজম বা জনমুখী রাস্তা নেওয়া ছাড়া আর অন্য কোন রাস্তা আছে কি?
অর্থনীতির সঙ্গে কৃষির সম্পর্ক হল গভীর।গত দুমাস ধরে কৃষিক্ষেত্রে এই সংকট চলছে। প্রান্তিক চাষিরা এদেশে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। ভারতে রিয়েল এস্টেট বা গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে শ্রমিক যোগানের সঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রের পতন একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। গৃহনির্মাণ ক্ষেত্র গত দুবছর ধরেই খুব খারাপ আর্থিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রটিতে আর্থিক উন্নতি হলে গ্রামীণ জীবনেরও আর্থিক বিকাশ হয়।
আমি নিজে অর্থনীতিবিদ নই। কিন্তু বাজার দোকান করতে যাই। রোজ শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ বা মাংস কিনতে গেলেই টের পাই বাজারে আগুন। মুদ্রাস্ফীতি মূল্যবৃদ্ধিতে আক্রান্ত দেশ। এখনো বুঝতে পারছিনা ১ ফেব্রুয়ারি কিভাবে মোদী সরকার এই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে দেবেন।
নরেন্দ্র মোদীর সামনে এ এক মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।