ইতিহাস বলবে, COVID-19 সম্ভবত ভারতের প্রথম প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যার জেরে ব্যাপক হারে অনাহারের সৃষ্টি হয়নি। গত শতাব্দীতে ১৯৪৩ সালে বাংলার মন্বন্তরে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। বিহারে ১৯৬৬-৬৭ সালে দুর্ভিক্ষের সময় একাধিক এলাকায় রাজ্যের দৈনিক ক্যালোরি গ্রহণের মাত্রা ২,২০০ থেকে কমে দাঁড়ায় আন্দাজ ১,২০০-তে। মহারাষ্ট্রে ১৯৭২-৭৩ সালের দুর্ভিক্ষে নথিভুক্ত হয় আনুমানিক ১ লক্ষ ৩৩ হাজার "অতিরিক্ত মৃত্যু"।
নভেল করোনাভাইরাস মহামারী এবং তজ্জনিত লকডাউনের প্রভাব আরও অনেক বেশি ব্যাপ্ত, দেশজুড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে তা। অথচ অন্যান্য বারের মতো এবার কিন্তু সেই অর্থে দেখা যায় নি তীব্র খাদ্য সঙ্কট, আকাশছোঁয়া খাবারের দাম, বা মজুতদারদের দাপট। হ্যাঁ, অনেক জায়গা থেকে আটকে পড়া পরিযায়ী শ্রমিকদের খ্যাদ্যাভাবের খবর এসেছে। তবে তার মূলে প্রধানত স্থানীয় প্রশাসনিক অবহেলা, অতীতের বিপর্যয়ের মতো সার্বিক খাদ্য সঙ্কটের কোনও চিত্র এখনও পাওয়া যায় নি।
এবার খাদ্য সঙ্কট তো নয়ই, সরবরাহের চেয়েও বেশি সমস্যা দেখা দিয়েছে চাহিদা নিয়ে। লকডাউনের প্রাথমিক পর্বে দুধ, আটা, ডাল, চিনি বা রান্নার তেলের শঙ্কা ক্রয় বা 'প্যানিক বাইং' করেছিলেন কেউ কেউ, তবে বর্তমানে হোটেল, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকান, কেটারার, মিষ্টির দোকান এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চাহিদা একরকম শূন্য হয়ে যাওয়ায় দুর্দশার মুখে পড়েছেন উৎপাদনকারীরাই। সরবরাহ ব্যবস্থা নানাভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও বাজারে, রেশনের দোকানে, কমিউনিটি কিচেনে, বা ত্রাণ শিবিরে খাবার পাওয়া যাচ্ছে না, এমনটা বড় একটা শোনা যায় নি। কিছু মানুষ ক্ষুধার্ত হলেও অভুক্ত থাকছেন না প্রায় কেউই।
আরও পড়ুন: আজ করোনা, কাল অন্য কিছু, যতক্ষণ না আমরা ‘ভালো’ হচ্ছি
এই নাতিক্ষুদ্র পরিবর্তনের আংশিক কৃতিত্ব ভারত সরকারের বহু নিন্দিত খাদ্যশস্য সংগ্রহ তথা বণ্টন ব্যবস্থার। লকডাউন শুরু হওয়ার সময় বিভিন্ন সরকারি গুদামে মজুত ছিল প্রায় ৭৭ মিলিয়ন (৭.৭ কোটি) টন চাল এবং গম, সঙ্গে আরও ২২.৫ লক্ষ টন ডাল। তবে সেইসব নেপথ্য যোদ্ধা, যাঁদের ছাড়া এই শস্য আদৌ উৎপাদন হতো না, হলেন দেশের কৃষকরা। এঁদের 'করোনা যোদ্ধা' আখ্যা না দেওয়া হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এঁরাই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা।
সাম্প্রতিক কালে আরও অনেক 'করোনার' মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁদের - ২০১৪-১৫ সালে অনাবৃষ্টি, দেশে ছাড়া গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকার ফলে খাদ্যশস্যের ওপর হামলা, উৎপাদন-বিরোধী মুদ্রাস্ফীতি টার্গেটিং নীতি, এবং নোট বাতিলের ফলে শস্যের দামে দ্রুত পতন। প্রতিবার তাঁরা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, নিজেরই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে সেই ছাই থেকে পুনর্জন্ম নেওয়া ফিনিক্স পাখির মতন। নোট বাতিলের ঝড় সামলেছেন স্রেফ নগদ টাকা দেওয়ার সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়ে। এই মুহূর্তে গম এবং আখের চাষ করছেন হয় নিজেদের পরিবারের সদস্যদের শ্রম ব্যবহার করে, নাহয় লকডাউনের ফলে কর্মহীন হয়ে পড়া অনিয়মিত শ্রমিক দিয়ে। এই কাহিনী সহনশীলতার, মানুষের সহ্যক্ষমতার।
রোদ, বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, মাথায় নিয়ে কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন এই আসল করোনা যোদ্ধারা?
প্রথমত, তাঁদের কাজের ধরন, যা বিশ্রাম বা গড়িমসির বিশেষ সুযোগ দেয় না। মোটামুটি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু করে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত কৃষকদের পক্ষে ব্যস্ততম সময়, যখন তাঁরা ঘরে তোলেন গম, সর্ষে, চানা, আলু, পেঁয়াজ, এবং আখ। তারপরেই শুরু হয়ে যায় ধান, তুলো, সয়াবিন, ভুট্টা, এবং বাজরা চাষের প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কিছুটা হালকা চালে চলে, এসময় কাজ মূলত প্রত্যহ ফসলের ওপর নজর রাখা এবং জল, সার, কীটনাশক দেওয়া, সঙ্গে আগাছা সাফ করা। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ফের চলে খারিফ শস্য ঘরে তোলা এবং বিক্রি, সঙ্গে রবি শস্য বপনের কাজ। তবে দুগ্ধচাষি বা 'ডেয়ারি ফার্মার'-দের এইটুকু বিশ্রামও জোটে না, যেহেতু তাঁদের রোজই পোষ্যদের খাওয়ানো, স্নান করানো, এবং দুধ দোয়ানোর কাজ থাকে।
প্রকৃতির বিধান মেনে এই যে সারাবছর ধরে উৎপাদন এবং বাজারদরের ওঠাপড়া নিয়ে থাকা, তা সঙ্কটের মোকাবিলায় চরিত্রে এনে দেয় কাঠিন্য, এবং স্থৈর্য। গত বছর যখন মন্দার বাজারে একাধিক গাড়ি উৎপাদনকারী সংস্থা কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছিল, জমছিল অবিক্রিত গাড়ির পাহাড়, কৃষকদের জনৈক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটি সোজাসাপ্টা মেসেজ ঘুরেছিল: "আমরা যদি ২০ টাকা কিলোর পেঁয়াজ দু'টাকা কিলো দরে বেচতে পারি, তবে ওরা কেন গাড়ির দাম ১০ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা করতে পারে না? আমরা লোকসান মাথায় নিয়েও যদি চাষের কাজ চালিয়ে যেতে পারি, তবে ওদের কারখানা চালাতে অসুবিধে কোথায়?" সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করেও টিকে থাকা তাঁদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাদের কবর খুঁড়তেই যেন করোনাভাইরাসের আবির্ভাব
কৃষকদের লড়াই না থামার আরও একটা কারণ হলো, লাভ-লোকসানের প্রতি তাঁদের মনোভাবটা একজন হিসাবরক্ষকের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ঠিক মেলে না। পরিচালন আয় (অপারেটিং ইনকাম), মূলধনের ওপর রিটার্ন, বা শেয়ার পিছু আয় - এগুলি তাঁদের অপরিচিত। কৃষকদের মূলমন্ত্র হলো 'দর'। আয় যতক্ষণ অবধি ব্যয়ের চেয়ে বেশি, সংসার চালানোর মতো নগদ হাতে থাকছে, এবং আগামী ফসলের খরচ দেওয়া যাচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা উৎপাদন চালিয়ে যাবেন।
এই করোনা যোদ্ধাদের প্রতি কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানাব আমরা? কৃষকদের আমাদের থালি বা তালির প্রয়োজন নেই। এই ঘোর দুর্দিনেও তাঁরা আমাদের পেট ভরাচ্ছেন। অন্তত সেটুকুও যদি আমরা তাঁদের জন্য করতে পারি? ওই যে আগে বললাম, এই মুহূর্তে সমস্যাটা সরবরাহের নয়, চাহিদার। প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা যেহেতু এখন অচল, এবং গৃহস্থ ছাড়া আর কোনও ক্রেতা নেই, সেহেতু সরকারের ওপরেই দায় বর্তায়, যাতে কৃষি উৎপাদনের বাজার চালু থাকে।
সরকারিভাবে রবি শস্য সংগ্রহের কাজ শুরু হয়েছে, তবে সামাজিক দূরত্ব-বিধির অজুহাত দিয়ে মাত্র কয়েকজন কৃষককেই প্রতিদিন বাজারের ক্রয় কেন্দ্রে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। কুপন বা এসএমএস-এর মাধ্যমে বলা হচ্ছে, মাত্র ৫-১০ কুইন্টাল (৫০০-১,০০০ কিলো) শস্য আনতে, ঠিক যেভাবে 'জন ধন' অ্যাকাউন্টধারী মহিলারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে মাত্র ৫০০ টাকা তুলতে পারছেন। চাল বা ডালের কারখানায়, এমনকি লকডাউনের জেরে বন্ধ স্কুলবাড়ি, কলেজ, পঞ্চায়েত অফিস, সমব্যয় সমিতি, জেলা আদালত, বা অন্যান্য সরকারি স্থানে কেন ক্রয় কেন্দ্র খোলা যাচ্ছে না? গমের ক্ষেত্রে প্রয়োজন তো শুধুমাত্র মাল নামানো, পরিষ্কার করা, ওজন করা, বস্তায় পোরা, এবং ফের গাড়িতে তুলে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদামে চালান করা। যদি ভিড় এড়ানোই উদ্দেশ্য হয়, তবে তার সহজতম উপায় হলো বাজারের ক্রয় কেন্দ্র ছাড়াও অন্যান্য কেন্দ্র খোলা।
পরিশেষে: আমার বন্ধু তথা 'আউটলুক হিন্দি' ম্যাগাজিনের সম্পাদক হরবীর সিং উত্তর প্রদেশের শামলির কাছে তাঁর গ্রামের একটি ঘটনার কথা বলছিলেন। সেটা ১৯৭৬ সাল, জেলা কর্তৃপক্ষ বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, কতটা করে সদ্য ঘরে তোলা গম রয়েছে প্রতিটি বাড়িতে। পরিবারের কতটা প্রয়োজন হতে পারে, তার একটা অনুমান করে বাকি পুরো শস্যই তাঁরা তুলে নিলেন কর হিসেবে। গ্রামের জুনিয়র হাইস্কুলে কোনোরকম হইচই ছাড়াই হস্তান্তর হয়ে গেল গম। সেসময় দেশে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা চলছে, সরকারের তখন খাদ্যশস্য প্রয়োজন। আজ, সেই কৃষকেরই সরকারকে প্রয়োজন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন