Advertisment

মর্যাদা হারাচ্ছে ভারতের আইনব্যবস্থা?

হাস্যকর, অন্ধ, যুক্তিহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন  এবং প্ররোচনামূলক মন্তব্য যখন আইন ও প্রশাসনিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী কোনও মানুষ নির্দ্বিধায় করেন, তখন সেটা একটা বৈধতা পেয়ে যায়

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
indian legal system

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

এটা তো একবিংশ শতাব্দী! ঠিক ভাবছি তো? মাঝে মাঝে গায়ে চিমটি কেটে দেখতে ইচ্ছে করে, এটা সত্যিই ২০২০ সাল, নাকি টাইমমেশিনে করে পৌঁছে গেছি আদিম কোনও যুগে।

Advertisment

তবে তাতেও তো ঠিক স্বস্তি মিলছে না। সভ্যতার আলো না পাওয়া সেদিনের সমাজও তো মেয়েদের এমন অসম্মানিত করত না। কুসংস্কার এমন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেনি সেদিন আমাদের। এক সভ্য সমাজে দাঁড়িয়ে আইনের ধারক ও বাহকরা যে সব মন্তব্য করছেন ইদানীং, তাতে তো মনে হয়, আদিমেরও আদিম যদি কিছু থাকে, আমরা এখন সেই কালেই চলে গেছি।

সম্প্রতি কর্ণাটক আদালতের একজন বিচারক যেভাবে যাবতীয় সভ্যতা, শালীনতা ও মানবিকতার বেড়া ভেঙেছেন, তাতে স্তম্ভিত সারা দেশ। বিষয়টি ইতিমধ্যেই প্রবলভাবে সমালোচিত। বিক্ষোভ, প্রতিবাদও শুরু বহু জায়গায়। 'কুৎসিত মেয়েকে কেউ ধর্ষণ করে নাকি?', 'ভারতীয় মেয়েরা ধর্ষণের পর ঘুমিয়ে পড়তে পারে না', 'মহিলা হয়েও রাত ১১টায় অফিস গিয়েছিলেন কেন? মদই বা কেন খেয়েছিলেন?' ধর্ষিতার অভিযোগের ভিত্তিতে বিচার চলছে আদালতে। সেখানে ধর্ষিতাকে এহেন প্রশ্ন ও মন্তব্য করেছেন কর্ণাটক হাইকোর্টের বিচারপতি কৃষ্ণা এস দীক্ষিত। ধর্ষণকারীদের জামিনও দিয়ে দিয়েছেন তিনি। অভিযোগকারিনী মিথ্যে বলছেন, এমনটাই দাবি তাঁর। বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার সঙ্গে সঙ্গে আইনজীবিদের একটি বিরাট অংশ, আইন শিক্ষার্থীসহ সমাজের ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষ প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।

আরও পড়ুন: ঘরোয়া হিংসার শিকার পুরুষও, তবে কেন আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত?

প্রসঙ্গত, পাঠক স্মরণ করুন নির্ভয়াকাণ্ডের কথা। মামলায় অভিযুক্ত চার আসামীর পক্ষের আইনজীবী এ পি সিংয়ের সওয়ালেও ছিল ঠিক এই ধরনের বক্তব্য। এই মামলা চলাকালীনই রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন তিনি। মক্কেলদের নির্দোষ প্রমাণ করতে বার বার আদালতে বিতর্কিত মন্তব্য করেই খবরের শিরোনামে আসেন এই আইনজীবী। তাঁর সওয়ালগুলি ছিল এইরকম, 'আমি যে সমাজ থেকে এসেছি, সেখানে এই বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সম্পর্ক প্রশংসনীয় নয়। মেয়েটি এত রাত পর্যন্ত একজন পুরুষের সঙ্গে বাইরে ঘুরছিল কেন?' বিচারশেষে চার অপরাধীর ফাঁসির আদেশ হয়ে যাওয়ার পর তিনি বিচারককে বলেন, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির চাপে এই সিদ্ধান্ত। রায় বের হওয়ার পর সাংবাদিকদের বলেন, "আমার মেয়ে বা বোন বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করলে খামারবাড়িতে নিয়ে গিয়ে পরিবারের সবার সামনে তাদের গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিতাম।"

ধর্ষণের মতো মারাত্মক এক অপরাধ। যার ক্রমবৃদ্ধি গোটা দেশের লজ্জা। দিকে দিকে প্রতিবাদের ঝড়। প্রশাসনের তাবড় তাবড় কর্তাব্যক্তি থেকে অপরাধ বিজ্ঞানীরা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না, কেমন করে এই পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। সেক্ষেত্রে আইনের দন্ড যাঁদের হাতে, তাঁরাই এই জাতীয় মন্তব্যের মাধ্যমে পরোক্ষে প্রশ্রয়ই দিচ্ছেন অপরাধকে। এ তো সত্যিই খুব দুর্ভাগ্যজনক। এক শ্রেণীর আইনজীবী যেন প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছেন, যাঁরা ধর্ষিত হচ্ছেন, দোষী তাঁরাই। এ যেন সেই লক্ষ্মণের গন্ডি কেটে দেওয়া। গন্ডির বাইরে গেলেই রাবণের বাড়ানো হাত। তখন আর সীতাকে কে বাঁচাবে? আর রাবণ ছুঁলে অগ্নিপরীক্ষা দিয়ে মরো।

মোদ্দা কথা, কোনও মেয়ের ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি হলে, যারা সেটা করবে, দোষী তারা নয়, দোষ ওই মেয়ের। সে যে গন্ডির বাইরে পা রেখেছে। যদিও আইন বলে, একজন স্ত্রীকে তাঁর স্বামীর বা একজন দেহপোজীবিনীর ক্ষেত্রেও, কারও অধিকার নেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার। সেটা ধর্ষণ বলেই বিবেচিত হয়, যা অবশ্যই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। সেক্ষেত্রে কোন মহিলা কত রাতে কোথায় গেছেন, রাস্তায় না অফিসে, বারে না সিনেমা হলে, সে প্রশ্ন তাঁর ধর্ষণের প্রেক্ষিতে অবান্তর।

ধর্ষণকান্ড ছেড়ে মেয়েদের পক্ষে আর এক উচিত অনুচিতের পরাকাষ্ঠা বিচারে যাওয়া যাক। একটি বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে গুয়াহাটি হাইকোর্টে। বিচ্ছেদ চাইছেন স্বামী। আদালতে জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন মহিলার স্বামীর অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, তাঁর স্ত্রী শাঁখা-সিঁদুর পরেন না। এই প্রেক্ষিতেই বিচারকের মন্তব্য, "শাঁখা-সিঁদুর পরেন না মানে আপনি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিকেই মানেন না।" এবং এই অজুহাতেই স্বামীর করা বিবাহ বিচ্ছেদের মামলায়, স্বামীর পক্ষেই রায় দেন ওই বিচারক। "অথচ হিন্দু বিবাহ আইনে শাঁখা-সিঁদুর পরার ব্যাপারটা বিবাহিত মহিলাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়," জানান একজন আইনজীবী। তাহলে একজন বিচারকের এই জাতীয় মন্তব্য কি সংবিধান বিরোধী নয়? যাঁরা আইন প্রয়োগ করবার অধিকার পেয়েছেন, তাঁরা কী করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন, আইন-বহির্ভূত মন্তব্য করেন?

publive-image বাইকে সওয়ার ভারতের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবড়ে

দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে বছর তিনেক আগের একটি মন্তব্য। রাজস্থান হাইকোর্টের বিচারপতি মহেশচন্দ্র শর্মা 'গরুকে কেন জাতীয় পশুর স্বীকৃতি দেওয়া হবে না', এই প্রসঙ্গ বোঝাতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, "ময়ূর হলো আজন্ম ব্রহ্মচারী এক পাখি। ময়ূরীর সঙ্গে অশ্রুর মাধ্যমে তাদের মিলন ঘটে। আর এভাবেই তাদের সন্তান জন্মায়। কৌমার্য বজায় রাখে বলেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ময়ূরের পালক তাঁর মাথায় ধারণ করেন।" আর হ্যাঁ, তাঁর মতে এইজন্যই ময়ূরকে জাতীয় পাখির তকমা দেওয়া হয়েছে।

এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর ঠাট্টা-তামাশা হয় তখন। সংবাদ মাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও বিষয়টি মোটেই নিছক মজা করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। অবৈজ্ঞানিক ও অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা সমাজে ছড়িয়ে দেওয়াটা তো এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। সাধারণ মানুষ হলেও কথা ছিল। তাঁরা নানা কারণে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু সময় বেহিসেবি ও ভুল মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু আইনী পেশার সঙ্গে যুক্ত উচ্চ পদাধিকারী একজন ব্যক্তি কি এটা করতে পারেন?

আম জনতা থেকে সেলেব্রিটি, স্বঘোষিত ধর্মগুরু থেকে রাজনৈতিক নেতা - এঁদের তরফে এমন উক্তি শোনার অভ্যাস আমাদের আজকাল হয়ে গেছে, বলা যায়। সমস্যা হলো এহেন হাস্যকর, অন্ধ, যুক্তিহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন  এবং প্ররোচনামূলক মন্তব্য যখন আইন ও প্রশাসনিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী কোনও মানুষ প্রকাশ্যে, নির্দ্বিধায় করেন, তখন সেটা একটা বৈধতা পেয়ে যায়। এই বিষয়টা কতখানি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে সমাজে, তা সহজেই অনুমেয়।

আরও পড়ুন: ‘কালো’ বনাম ‘ফর্সা’: সমাজ কি নেবে এই চ্যালেঞ্জ?

কিন্তু কেন এই প্রবণতা? এ প্রসঙ্গে এক আইনজীবীর বক্তব্য, "এটা আসলে চূড়ান্ত পর্যায়ের ঔদ্ধত্য। আইনের উর্দ্ধে যাওয়ার একটা প্রবণতা। আজকাল সবাই নিয়ম লঙ্ঘন করছে। অতএব আমিও তেমনটাই করব। এতে যে পুরো পরিস্থিতিটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটা বুঝছেন না এঁরা।" শুধু তাই নয়, হালকাও তো হয়ে যাচ্ছে পরিবেশটা। আইনকানুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে যা খুশি কি বলা বা করা যায়? "অবশ্যই না। এই যে দেশের প্রধান বিচারপতি শরদ অরবিন্দ বোবড়ের ব্যাপারটাই ধরা যাক। নাগপুরে ওঁর বাইকে চড়া ছবিটি সম্প্রতি বিপুল হারে ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। এতে তো সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিষয়ের গাম্ভীর্য ও গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে," জানান এই আইনজীবী ।

এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবটাও কি কারণ হিসেবে দেখা যেতে পারে? জবাবে, "সেটা কিছুটা হতেই পারে। তবে আমার মনে হয়, এঁদের নিজেদের মানসিকতা, আশৈশব জীবনচর্চাও একটা দিক। পরিবারের পরিবেশ আমাদের ভালো-মন্দ দুটোই শেখায়। এঁদের সুশিক্ষা, সামাজিক চেতনা, মহিলাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখানোর দিকটায় একটা অভাব রয়ে গেছে, বোঝাই যায়। ব্যক্তিগত তিক্ততা, অসন্তোষ, অপ্রাপ্তি থেকেও অনেক নেতিবাচক ভাবনার জন্ম হয়। এটাও এঁদের ক্ষেত্রে এই জাতীয় মন্তব্য করার পিছনে একটা কারণ হতে পারে।"

দেখেশুনে কোথাও কি কোনও প্ররোচনার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে? এদের এই জাতীয় কাজ কি শুধুই  দায়িত্বজ্ঞানহীন? নাকি এর পিছনে একটি সুপরিকল্পিত ভাবনা প্রচারের উদ্দেশ্যও কাজ করছে? গত কয়েক বছর ধরে উদার ও প্রগতিশীল চিন্তাকে দূরে সরিয়ে, স্বার্থান্বেষী একটি শ্রেণী যেভাবে প্রাচীন (ঐতিহ্যবাহী নয়) অন্ধ মতবাদকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে নানা ভাবে, তাতে এই সন্দেহ দৃঢ় হয়। আর আইন-আদালতকে যদি একাজে লাগানো যায়, তবে তো পোয়াবারো। ক্ষতিটা হচ্ছে  সমাজের। দেশের আইন ব্যবস্থা তার গাম্ভীর্য ও মর্যাদা হারাচ্ছে। এর প্রভাব বহু দূর প্রসারিত। তাই সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এটা এখনই বুঝতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

supreme court Justice
Advertisment