'প্রজা' কথাটির প্রাথমিক অর্থ সন্তান। অন্তত ঋগ্বেদে ও মনুস্মৃতিতে তেমন কথা পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দটির অর্থ পালটে গিয়ে দাঁড়ায় 'রায়ত'। অর্থপরিবর্তনের এই দিকটি ভাববার মতো। আজকের যে প্রজাতন্ত্র, তার অর্থ অবশ্য গণতন্ত্র কিংবা নাগরিকতন্ত্র করা হলেও অরাজক রাষ্ট্রে শাসকতন্ত্রের রাঘববোয়ালরা অপেক্ষাকৃত দুর্বল মাছকে গ্রাস করলে তা হয়ে দাঁড়ায় শাসকতন্ত্র। এই তন্ত্রে দুর্বল সন্ত্রস্ত হয়ে কাল কাটায়, নিশ্চিন্তমনে তার কিছু করার উপায় থাকে না। শাসক বা রাজা রাষ্ট্রের রক্ষক - এই প্রাচীন প্রবাদ এখন হাস্যকর প্রবচনে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভারতের মতো দেশে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে 'অপর' ঘোষণা করে প্রতিনিয়ত তাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা হয় একটিই লক্ষ্যে, শাসনতন্ত্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান - যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাত থেকে জনগণের দৃষ্টিকে ঘৃণার দিকে নিবদ্ধ করা। এই যে অপরের প্রতি ঘৃণা, একে সঙ্গে করে সমাজের অন্য অংশ (যাঁরা ঘৃণিত নন) তাঁদের মানসিক ভূগোলকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করছেন। খোলা মনে ভাবলে দেখা যায়, ঘৃণিত ও ঘৃণাকারী উভয়েই শাসকের চক্রান্তের শিকার। ঘৃণাকারী তাঁর মনকে রক্তাক্ত করছেন আর ঘৃণিত-র মানসিক ও শারীরিক উভয় অস্তিত্বের উপর সরাসরি আঘাত নেমে এসেছে।
মানুষের পরিচয়ের অনেকগুলি স্তর থাকে। একই সঙ্গে একজন সংখ্যালঘু, আবার তিনি মহিলা, অন্য পরিচয়ে তিনি কর্মহীন - এমন মানুষের পক্ষে শান্তিতে বসবাস ক্রমশই অসম্ভব হয়ে পড়ছে। এই প্রজাতন্ত্র তাই কোনও ভাবেই পিছু হেঁটে সন্তানতন্ত্র কিংবা সামনে এগিয়ে নাগরিকতন্ত্র হয়ে উঠতে পারছে না। স্বাধীনতার এত বছর পরে এ আমাদের কাছে ভয়ঙ্কর দুর্ভাগ্যের।
এই বছরের প্রজাতন্ত্র অন্যান্য বছরের থেকে কিঞ্চিৎ পৃথক। সম্প্রতি নতুন নাগরিক আইন এসেছে মাসাধিক কাল আগে। সেই আইনে প্রজাতন্ত্রের রক্ষাকবচ যে সংবিধান, তার মূলে কুঠারাঘাত হেনেছে শাসক। কীভাবে? নতুন নাগরিক আইন হলো নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধি, কেড়ে নেওয়ার নয় - এমন প্রচার শোনা গেলেও আদতে কী আছে ওই নাগরিক সংশোধনী আইনে? ভারতে যে সমস্ত শরণার্থী এসেছেন নানা কারণে অত্যাচারিত হয়ে, কেউ বা অর্থনৈতিক কারণে, কেউ বাক স্বাধীনতার কারণে, কিংবা লিঙ্গ অসাম্যের কারণে অত্যাচারিত হয়ে। তাঁদের মধ্যে বাছাই করে শুধু ধর্মীয় অত্যাচারকে নতুন নাগরিক আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, ওই আইনে বাদ দেওয়া হয়েছে মুসলমানদের। এমনকি শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তামিল হিন্দুরাও ঠাঁই পাননি ওই আইনে। স্পষ্টতই তা সংবিধানে ১৪ নং অনুচ্ছেদ বা সাম্যের অধিকারের পরিপন্থী। যে কোনও ব্যক্তি যদি অন্য দেশ থেকে, এমনকি অন্য গ্রহ থেকেও ভারতে আসেন, তিনি ভারতীয় সংবিধান মতে সাম্যের অধিকার ভোগ করবেন। প্রত্যেকে আইনের সুরক্ষা পাবেন এবং কেউ বেশি বা কম পাবেন না। স্পষ্টতই যে আইন সংবিধান-বিরোধী, তা সমস্ত ন্যায় ও সাম্যের পরিপন্থী বলেই বিবেচিত।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ভারতের সংখ্যালঘু মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে তা হলো এনআরসি। বলা উচিত, এই জনগণতন্ত্রে 'এনআরসি' নামক বিভীষিকা ভারতীয় মুসলমান সমাজে মাস ডিপ্রেশনের সৃষ্টি করেছে। সংখ্যালঘু মানুষের একটি বড় অংশ হলো দলিত, হতদরিদ্র। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেই সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই সব হতদরিদ্র মানুষদের বেশির ভাগেরই কোনও কাগজপত্র নেই। জন্মমৃত্যুবিষয়ক নথির ধারণা আমাদের দেশে বেশ নতুন। মা-বাবার নথি বহু মানুষের নেই, বহু মানুষের থাকার বাড়িই নেই, বাড়ির দলিল অনেক পরের বিষয়। যেহেতু একটা বড় অংশের কাছে ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড রয়েছে এবং সরকারের কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন ওগুলো নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়, তাই বিপন্নতা বেড়েছে মানুষের, তাঁরা অস্তিত্বের সমস্যায় পড়েছেন।
যাঁরা ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করেছেন, এখন নির্বাচিত সরকার এসে নাগরিক নির্বাচন করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। নাগরিকদের কাছে এই বিষম 'ফ্যালাসি' বৈধতা পেয়েছে অসমের নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি হওয়ার পর থেকেই। সেখানে বহু বাঙালি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষ বেনাগরিক হয়েছেন। সংখ্যাটা ১৯ লক্ষের বেশি। তাই প্রজাতন্ত্র দিবসে মানুষ প্রজা বা নাগরিক থাকবেন কিনা, সেই আশঙ্কায় দিন গুনছেন।
সারা পৃথিবীতে উদ্বাস্তু সমস্যা এক ভয়ঙ্কর কঠিন রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন দেশে মানুষ খেতে না পেয়ে, বিভিন্ন কারণে অত্যাচারিত হয় দেশ ছাড়ছেন, কিন্তু অন্য দেশে গিয়েও জুটছে শুধু লাঞ্ছনা। এর উপর যোগ হয়েছে দেশের মানুষকে বেনাগরিক ঘোষণা করার ধুম। ভারতের যে সব মানুষ দলিত, সংখ্যালঘু, তাঁদের আশঙ্কা (যে আশঙ্কার সারবত্তা রয়েছে) এই বেনাগরিক ঘোষণা করার প্রাথমিক লক্ষ্য যদি হয় দেশের অন্যান্য মৌল সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া, তাহলে দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো সস্তার মজুর-বাজার তৈরি করা। বেনাগরিক মানুষরা যাবেন কোথায়? দেশে কত ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হবে? সেখানে বিনি পয়সায় কতজনকে খাওয়ানো হবে! সে সব আদৌ হবে না, হওয়া সম্ভব নয়। বেনাগরিকদের শ্রম দিতে হবে, এবং শ্রম আইনের কোনও তোয়াক্কা না করে তাঁরা পর্যবসিত হবেন সস্তার শ্রমিক কিংবা ক্রীতদাসে।
সিএএ হলো সেই খুড়োর কল, যেখানে সংখ্যাগুরু মানুষকে বোঝানো হচ্ছে, তুমি এনআরসি-তে বাদ পড়লে সিএএ-র সাহায্যে নাগরিকত্ব পাবে। কিন্তু যে লোকটি ভারতের নাগরিক, নথির অভাবে এনআরসি-তে বেনাগরিক হলেন, তিনি কীভাবে পূর্বের স্বীকারোক্তি খারিজ করে বলবেন যে তিনি আফগানিস্তানের বৌদ্ধ, ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে অমুক সময়ে এসেছেন? তাহলে অমুক সময়ের পূর্বে তাঁর বাপ-ঠাকুর্দার যে উত্তরাধিকার, সে সব কি কেড়ে নেওয়া হবে? একজন মুসলমান বে-নাগরিকও অনুরূপভাবে সত্য গোপন করে বলতে পারেন যে তিনি বাংলাদেশের হিন্দু, তার যাচাইকরণই বা কীভাবে হবে? উভয় ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন হবে নাগরিকত্ব পাওয়ার শর্ত।
এত শত কঠিন প্রশ্নে যেতে চান না বা পারেনও না সাধারণ সংখ্যালঘু মানুষ। তিনি শুধু জানেন, এই যে নাগরিকতন্ত্র, এই প্রজাতন্ত্রে তিনি অপর, তিনি ব্রাত্য। তাঁকে বা তাঁদের দেশ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য শুরু হয়েছে সিএএ, এনআরপি, এনআরসি নামক তিন যজ্ঞ। তাই তিনি ভয়ে ভয়ে কাল নির্বাহ করেন।
ক্ষমাশীল শমীক মুনি তাঁর পুত্র শৃঙ্গীকে বলেছিলেন, অরাজক জনপদে সব সময় ভয়ে ভয়ে সময় কাটাতে হয়। প্রজাদের ধর্ম আচরণের মূল একমাত্র শাসক। শাসকের ভয়ে মনুষ্যসমাজ পরস্পরকে হিংসা করতে পারে না। কিন্তু শাসক যখন হিংসায় মদত দেন, তখন? শাসক যখন দেশের সংহিতা বা সংবিধানকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মানববিরোধী আইন তৈরি করেন, তখন সমাজের দুর্বল অংশের মাস ডিপ্রেশনে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
কিন্তু আশার কথা, এমন সব কালা কানুনের বিরুদ্ধে জনগণ পথে নেমেছেন। সংখ্যালঘু, দলিত এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। সেটিই প্রজাতন্ত্রের একমাত্র আশার আলো।