Advertisment

মন্দিরে যৌন ভাস্কর্য - বিশ্বাসের সেকাল একাল

শুধু যৌন ভাবনার জন্যই নয়, আসলে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যৌনদৃশ্য বিহীন অনেক কিছুও নিজস্ব বিশ্বাস, ধর্মভাবনা, সামাজিক ভাবনার নিরিখে অশ্লীল বিবেচিত হয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
indian temple erotic sculpture khajuraho

শ্লীল-অশ্লীল ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। বিশেষত শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। একজনের কাছে যা হয়তো সৃষ্টিসুখের উল্লাস, ভাবনার উন্মুক্ত প্রতিফলন, সত্যম শিবম সুন্দরম, শিল্পের স্বাধীনতা, সেটাই আবার হয়তো অন্য মনের কাছে চূড়ান্ত অশ্লীলতা-কদর্যতার ভাণ্ডার। আসলে পুরো ব্যাপারটাই নির্ভর করে ব্যক্তি মানুষের বোধ বা দর্শনের ওপর। এই দর্শন ক্ষেত্রবিশেষে মানবিক-রাজনৈতিক, কখনও বা ধর্মীয় দর্শন।

Advertisment

আমাদের দেশ স্বাধীনতা লাভের পর এক রাজনৈতিক নেতা দাবি তুলেছিলেন যে ভারত সরকারকে মধ্যভারতের একটি মন্দির ভেঙে দিতে হবে। যিনি দাবি তুলেছিলেন, সেই নেতা কিন্তু অন্য কোনও ধর্মাবলম্বী ছিলেন না। তিনিও হিন্দু। মন্দির ভাঙার দাবির পিছনে তাঁর বক্তব্য ছিল যে মন্দিরগাত্রে খোদিত যৌন ভাস্কর্য ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতির সাথে মেলে না। ওইসব ভাস্কর্য নাকি প্রকাশ্যে যৌনতার বিজ্ঞাপন। যা সমাজের পক্ষে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। অতএব...। প্রবীণ ওই নেতা কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে 'দেশের স্বাধীনতা' এবং 'শিল্পের স্বাধীনতা' প্রসঙ্গে তাঁর ভাবনা ভিন্ন ছিল।

প্রায় একই রকম দাবি তুলেছিলেন কিছু মানুষ, পূর্ব ভারতের 'ইরোটিক স্কাল্পচার' সমৃদ্ধ প্রসিদ্ধ এক মন্দিরের ক্ষেত্রে। মন্দির ভাঙার কথা না বললেও তাঁরা বলেছিলেন মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যগুলি সিমেন্ট দিয়ে, নিদেনপক্ষে কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়ার কথা। যাতে মন্দিরে আগত দর্শনার্থীদের সামনে ওইসব যৌন দৃশ্য উন্মুক্ত না থাকে। বলা বাহুল্য, মধ্যভারতের মন্দিরটি ভাঙার দাবি যাঁরা তুলেছিলেন, পূর্ব ভারতের মন্দিরগাত্রে যৌন ভাস্কর্য ঢেকে দেওয়ার দাবি যাঁরা করেছিলেন, উভয় দলের যুক্তি ছিল একই - অশ্লীলতা। তবে সরকার সঙ্গত কারণেই মধ্যভারতের খাজুরাহোর কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দির বা উড়িষ্যার কোনার্ক মন্দিরের ক্ষেত্রে সেসব দাবি মানতে রাজি হন নি।

মজার ব্যাপার হলো, এই ধরনের ভাস্কর্য নির্মাণের পিছনে কিন্তু সে সময় কাজ করেছিল নানা লৌকিক বিশ্বাস, ধর্মভাবনা, অথবা রাজনৈতিক কারণ। আপনি যদি কোনোরকম মন্দির দর্শন করতে যান একজন সাধারণ দর্শনার্থী হয়ে, তবে দেখবেন এইসব মিথুন ভাস্কর্য নির্মাণের কারণ হিসাবে স্বল্পশিক্ষিত গাইডের দল প্রায়শই বলেন যে - এ মন্দির যখন নির্মাণ হচ্ছিল তখন শিল্পীদের ঘরে ফেরার অনুমতি ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে নারীসঙ্গহীন ভাস্কর-মজুরের দল নাকি তাঁদের অতৃপ্ত কামেচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছিলেন এই মন্দিরগাত্রে তাঁদের ছেনি-হাতুড়ির মাধ্যমে। এ বক্তব্য সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, এবং শিল্পের সম্বন্ধে বিরূপ ধারণার জন্ম দেয়।

একথা ঠিকই যে সেইসব শিল্পীদের দলকে মন্দির নির্মাণের সময় বহিঃজগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন রাখা হতো, এবং নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত রাখা হতো, কিন্তু শিল্প রচনার ক্ষেত্রে তাঁদের ন্যূনতম স্বাধীনতা ছিল না। তাঁরা যা রচনা করতেন, তা করতে হতো রাজা, বাস্তুকার, বা দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান পুরোহিতের নির্দেশমতো। তাঁদের নির্দেশ ভিন্ন সামান্য ফুলপাতার অলঙ্করণ রচনা করার ক্ষমতাও ভাস্করদের ছিল না। এসব মন্দিরের ভাস্কর্যগুলি যদি তাঁদের কামেচ্ছার প্রকাশ হয়ে থাকত, শিল্পী স্বাধীনতার প্রকাশ হয়ে থাকত, তবে প্রাক মধ্যযুগ বা মধ্যযুগে বহু মন্দিরেই এই ভাস্কর্য দেখা যেত। কারণ সেসময় সর্বত্র শ্রমিক-ভাস্করদের অবস্থা ছিল একই রকম। এইসব নির্মাণকার্যের সঙ্গে যুক্ত ভাস্কর-মজুরদের বন্দীদশা কাটাতে হতো। তবে কেন এই মিথুন ভাস্কর্য নির্মাণ?

উড়িষ্যার রাজা নরসিংহদেব চন্দ্রভাগা নদীর মোহনায় ত্রয়োদশ শতকে এই সূর্যমন্দির নির্মাণ করান। কোনার্ক মন্দিরগাত্রে মিথুন ভাস্কর্য নির্মাণের কারণ হিসাবে ইতিহাস গবেষকরা বেশ কয়েকটি যুক্তি-নির্ভর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। তা হলো এই যে, রাজা নরসিংহদেবের আমলে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে পুরীধামের পুরোহিত ও ব্রাহ্মণ সমাজ। পুরীর মন্দির ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে। এমনকি রাজনৈতিক-প্রশাসনিক কাজেও হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেন তাঁরা। রাজা নরসিংহদেব চেয়েছিলেন কৌশলে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে দ্বিখণ্ডিত করতে। আর এ জন্যই সুলতানি সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের অছিলায় রাজধানী থেকে বেশ কিছুটা দূরে নতুন মন্দির নির্মাণের কথা ভাবেন।

কিন্তু অত সুপ্রতিষ্ঠিত প্রাচীন পুরীধামের মন্দিরের আকর্ষণ ত্যাগ করে মানুষ নতুন মন্দিরে ছুটে যাবেন কেন? কী আকর্ষণে? যেতে পারেন, যদি সেই মন্দিরে দর্শনযোগ্য অলৌকিক কিছু থাকে, অথবা এমন নতুন কিছু থাকে যা মানুষ ইতিপূর্বে দেখেন নি। এ ভাবনার বশবর্তী হয়ে রাজা নরসিংহদেব মন্দির রচনার ব্যাপারে যে কয়েকটি পদেক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে মন্দিরগাত্রে যৌন ভাস্কর্য নির্মাণ অন্যতম। যৌনতা, যৌন দৃশ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ অপরিসীম। অর্থাৎ এই ব্যাখ্যা অনুসারে অশ্লীলতার অভিযোগে বিদ্ধ এই শিল্প নির্মাণের পিছনে কারণটা ছিল রাজনৈতিক। যদিও পরবর্তীকালে নানা কারণে মিথুন ভাস্কর্য সম্পন্ন এই সূর্যমন্দির নির্মিত হলেও নরসিংহদেবের কৌশল ব্যর্থ হয়। ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে যায় পুরীধামের মন্দিরই।

মধ্যভারতের বহু প্রসিদ্ধ খাজুরাহোর মন্দিরগুলি নির্মিত হয় খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতে, চান্দেল রাজাদের রাজত্বকালে। কোনও একজন রাজা নন, বিভিন্ন রাজার শাসনকালে প্রায় দুশো বছর ধরে মন্দির নগরী খর্জুরবাহকের মন্দিরগুলি নির্মিত হয়। তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো যৌন ভাস্কর্য সমৃদ্ধ কাণ্ডারীয় মহাদেবের মন্দির। চান্দেলরাজ বিদ্যাধরের রাজত্বকালে কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শুধু মানব-মানবীর মিথুন দৃশ্য নয়, মানবের সঙ্গে ঘোটকী প্রভৃতি ইতর শ্রেণীর প্রাণীর মিলন দৃশ্যও অদ্ভুত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল এই মন্দিরগাত্রে।

যেসব সুর-সুন্দরীদের নিরাবরণ দেহে দাঁড়িয়ে থাকতে অথবা মিথুনরত অবস্থায় দেখা যায়, তাঁরা কিন্তু নিছকই কল্পনা ছিলেন না। গবেষকদের বক্তব্য, মিথুন ভাস্কর্য রচনার করার জন্য কাশ্মীর, উৎকল, ত্রিগর্ভ, চালুক্য, গন্ধর্ব রাজ্যের বিভিন্ন দামের হাট থেকে নারীদের সংগ্রহ করে আনা হতো। তারপর তাঁদের দেখে শিল্প রচনা করতেন ভাস্কররা। এদেশে 'ন্যুড মডেল' ব্যবহারের ক্ষেত্রে খাজুরাহোই পথপ্রদর্শক বলে মনে করা হয়।

খাজুরাহোর কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দিরের যৌন ভাস্কর্য রচনার পিছনে সাধারণত তিনটি ভাবনার উপস্থাপনা করা হয়। প্রথম ভাবনাটি হলো এই, সে সময়ে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে মন্দিরগাত্রে মিথুন ভাস্কর্য রচিত হলে নাকি মন্দিরে বজ্রপাত হয় না। দ্বিতীয় ভাবনা, মন্দিরগাত্রে মিথুন ভাস্কর্য দেখে পরিতৃপ্ত হয়ে কামভাব পরিত্যাগ করে শুদ্ধমনে যাতে মানুষ মন্দিরে প্রবেশ করেন। তৃতীয় কারণ, চান্দেল রাজারা ছিলেন মধ্যভারতের বনচারী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অবাধ যৌনাচারকে প্রশ্রয় না দিলেও, তাঁদের কাছে যৌনাচার ছিল প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম, সত্য ভাবনা। এই সত্য ভাবনাটিকেই তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছিলেন সত্য-শিব-কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দিরে। পরবর্তীকালে কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দিরের ভাস্কর্যকে কিছু লোক যতই অশ্লীল বলে থাকুন না কেন, মন্দির নির্মাণকালে প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাসই এ ধরনের শিল্প রচনার চালিকাশক্তি রূপে কাজ করেছিল।

শুধু যৌন ভাবনার জন্যই নয়, আসলে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে যৌনদৃশ্য বিহীন অনেক কিছুও নিজস্ব বিশ্বাস, ধর্মভাবনা, সামাজিক ভাবনার নিরিখে অশ্লীল বিবেচিত হয়। ইউরোপের কয়েকটি দেশে একসময় পশুপাখির সঙ্গে মানুষ বাক্যালাপ করছে এমন কোনও ইঙ্গিতপূর্ণ ছবি বা মূর্তি রচনা করা নিষিদ্ধ ছিল, অশ্লীল ছিল ধর্মভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বিখ্যাত বামিয়ান বুদ্ধমূর্তিও ধ্বংস করা হয়েছিল কিছু মানুষের বিশ্বাস অনুসারে একই কারণে। বর্তমান পৃথিবীতে বহু-আলোচিত বিষয় সমকামিতা। এখনও ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কিছু দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা এই ধরনের সম্পর্কের ঘোর বিরোধী। সমকামিতা শুধুমাত্র যেখানে শাস্তিযোগ্য অপরাধই নয়, এ ধরনের কোনও ইঙ্গিতপূর্ণ শিল্পকলা - তা ছবি হোক, বা ভাস্কর্য, বা চলচ্চিত্র - অশ্লীল হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান আছে।

মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর 'ডেভিড' নামের বিখ্যাত নগ্ন পুরুষমূর্তির ভাস্কর্য, পনেরো শতকে ইতালিয় চিত্রকর সান্দ্রে বত্তিচেল্লির আঁকা 'বার্থ অফ ভেনাস'-এর নগ্ন নারী, বা হেমেন মজুমদারের ছবি 'সিক্তবসনা সুন্দরী' কে কী বলা যায়? শ্লীল না অশ্লীল? আসলে মনে হয়, শিল্পক্ষেত্রে শ্লীল-অশ্লীল বিচারের কোনও সার্বজনীন মাপকাঠি নেই। ব্যক্তি মানুষের ভাবনার ওপরেই ব্যাপারটা নির্ভর করে। একজনের চোখে যা প্রতিভাত হয় চূড়ান্ত সৌন্দর্য এবং সত্য হিসাবে, অন্যের চোখে তাই আবার ঘৃণ্য - চূড়ান্ত অশ্লীল।

Durga Puja 2019
Advertisment