/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/01/indo-bangladesh-file.jpg)
ফাইল ছবি- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ভারতের জন্য বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। এই কথাটা আমি এর আগেও লিখেছি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, ভারত এবং বাংলাদেশ এই দুই দেশের সম্পর্কের স্থায়ী সুস্বাস্থ্যের জন্যই এই কথাটা বারবার বলে যেতে হবে। এই সম্পর্কের সুরক্ষার বহু কারণ আছে। আপাতত প্রথম চারটি কারণ বলছি।
প্রথমত, উত্তরপূর্বাঞ্চলের ও পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সীমান্তে আছে বাংলাদেশ। বেশ কিছু জঙ্গিগোষ্ঠী এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সক্রিয়। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কখনো এই গোষ্ঠীগুলোকে মদত দেওয়ার সুযোগ দেননি। সরকারি যন্ত্রকে ব্যবহার করে এই পাক পন্থী জঙ্গিদের ভারত-বিরোধী কার্যকলাপে বাধা দেবার জন্য বাংলাদেশকে বন্ধু রাখা খুব জরুরি। বঙ্গবন্ধু কন্যার আগে যখন খালেদা প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন আমি দিল্লিতে, এক নবীন সাংবাদিক। ‘বর্তমান’ খবরের কাগজে কাজ করতাম তখন। কলকাতার সেই কাগজের সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত ও প্রবীণ সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত।
এক ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসারের দেওয়া খবর ছিল, বাংলাদেশের খোদ ঢাকা শহরে এক পাক সেনা অফিসার বেশ কিছু বাংলাদেশি জঙ্গিদের নিয়ে বৈঠক করেছে। আবার সে বৈঠকে কিছু আলফা ও এনএসসিএন জঙ্গিও হাজির ছিলেন। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল জঙ্গিদের একটি ছাতা উত্তর পূর্বাঞ্চলের জন্য তৈরি করা। বরুণ সেনগুপ্তের খবরটি পছন্দ হয় এবং বর্তমান কাগজের সেটি লিড খবর হিসেবে ছাপা হয়। পরদিন আমার চিফ অফ ব্যুরো প্রয়াত সুকুমার দত্তের ফোন। তিনি বললেন, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক আপনার এই খবরে খুব উত্তেজিত। ওরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। আমার ফোন নম্বর কেন ওরা তখন আমাকে সম্ভবত চেনেও না। তখন মোবাইল ফোনও ছিল না।
জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব
যাহোক বিদেশমন্ত্রকের বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত যুগ্মসচিবকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, মশাই করেছেন কি? বাংলাদেশ সরকার তো খেপে লাল। আসলে বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক বড় সংবেদনশীল বিষয়। সীমান্ত দিয়ে একটা শালিক পাখিও যদি ভারতে ঢুকে পড়ে তাহলেও কেলেঙ্কারি। আমাদের রিপোর্ট দিতে হয়। আমার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, হু ইজ ইওর সোর্স? বললাম, তা তো বলা যাবেনা। তবে এক দিনের মধ্যেই বুঝলাম এই খবরটিতে বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে বাংলাদেশ সরকার। ভারতের চাপে তখন কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতিও দিল খালেদা সরকার। আজ এতো বছর পর এটা বলতে পারি, হাসিনা প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এবং আজও তাঁর পুরো দুবছরের টার্মে এই পাক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব নিয়েছেন। তিনি অনুপ চেতিয়া, পরেশ বড়ুয়ার মত জঙ্গিদের দেশে ফেরত পাঠানো (deportation) –র ব্যাপারে সক্রিয় সহযোগিতা মূলক অবস্থান নেন।
এই কাজটা সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশেও আদালত ও নানা আইনের ফাঁক আছে। ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, মানবাধিকার ইস্যু, আইনজীবিদের পরিসর, নানা দিকের বাধা আছে। তাহলে ভারতেরও এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে চীন ও পাকিস্তান উৎসাহিত হয়ে ঢাকাকে কাছে টানতে চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে এক হিন্দুকে বাংলাদেশের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সে খবরটির কথা গত সপ্তাহে উল্লেখ করেছিলাম। তাই ভারতেরও এমন কিছু করা উচিত নয় যাতে বাংলাদেশে হাসিনা সরকার এ ব্যাপারে দেশের ভেতর চাপের মধ্যে পড়ে। হাসিনা প্রধান মন্ত্রী হওয়ার পর বাংলাদেশের সেনাছাউনিতে জঙ্গি আক্রমণের শিকার হন তিনি। আপাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। তাহলে হাসিনা যখন নিজেও বলেছেন যে বিশ্ব সন্ত্রাস মঞ্চে তিনি ঐক্যবদ্ধভাবে এসে দাঁড়িয়েছেন। সম্ভবত বাংলাদেশই একমাত্র প্রতিবেশী এক ইসলামিক রাষ্ট্র যারা সন্ত্রাস দমনে এতটা ভারতের পাশে।
দ্বিতীয়ত, পূর্ব দিকের দেশ গুলির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ। যেমন মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সঙ্গেই হতে হবে। আর্থিক দিক থেকে বাংলাদেশের শক্তিশালী অর্থনীতি ভারতের নিজের বৃদ্ধির জন্যই বেশি জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির শতকরা পাঁচ ভাগেরও বেশি। এটা খুব ভালো কথা। ভারতীয় পণ্যের বাজার দখলের জন্য এই বৃদ্ধির হার খারাপ হোক ভারত চায়না।
নতুন বছরে পুরোনো দেশ, এবং নাগরিকত্বের বিদেশ গমন
তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দু'দেশের মধ্যে এক দারুণ সমন্বয় গড়ে উঠেছে। এই সমন্বয় নষ্ট হওয়া উচিত নয়। কারণ এই পরিবেশ পরিবর্তনে বাংলাদেশের ল্যান্ডমাসের আয়তন যদি শতকরা কুড়ি ভাগ কমে যায় তাহলে কিন্তু ইমিগ্রেশন শতকরা কুড়ি ভাগ বাড়বে, এমন একটা আশঙ্কা আছে। ভারতের উচিত বাংলাদেশকে এ ব্যাপারে সবসময় সঙ্গে রাখা। আর বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষের বিষয়টিকে শুধু কাঁটাতারের বেড়ার ইস্যু হিসেবে না দেখে মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণটির ভিত্তিতে দেখা। এব্যাপারে নাগরিকত্ব বিল ধর্মীয় মেরুকরণ এর শঙ্কা ঢাকায় তৈরি করছে, তাকে নির্মূল করা প্রয়োজন। মোদী নিজে অবশ্য বারবার আশ্বাস দিচ্ছেন হাসিনাকে। কিন্তু অমিত শাহ যখন বলছেন যে এই বিল থেকে সরে আসার কোনো প্রশ্নই উঠছে না, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন তার আন্দোলনকে এই শঙ্কার ভিত্তিতে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছেন, তখন কূটনৈতিক স্তরে আরো সক্রিয় হওয়া উচিত দিল্লির।
চতুর্থত, সম্প্রতি বাংলাদেশের উপর চীনের নজর খুব বেড়েছে। মাছ কাটা থাকলে যেমন শিকারী বিড়াল সেদিকে তাকিয়ে থাকে। চিন বাংলাদেশ নানাভাবে বিনিয়োগ শুরু করেছে, আরো বিনিয়োগ তারা বাড়াতেও চাইছে। চীন বাংলাদেশের সঙ্গে আর্থিক ও সামরিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে চাইছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কে মধুর করার পিছনে চীনের একটাই লক্ষ্য, সেটা হল ভারতের ওপর চাপ বাড়ানো। তাহলে চীনকে ক্রমাগত চটিয়ে যাওয়া হবে এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক মুর্খামি।
তবে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে যা যা জানলাম আপনাদের জানাই। কোন বিশ্লেষণ নয়, একদম হাতে গরম খবর। ৪ জানুয়ারি শনিবার দিল্লিতে বিজেপির সদর দপ্তরে বিজেপির বিদেশ বিভাগীয় সেলের শীর্ষ পর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। বৈঠকটিতে পৌরোহিত্য করেন সেলের প্রধান বিজয় চৌথাইওয়ালা। প্রধানমন্ত্রীর খুবই ঘনিষ্ঠ বিজয়। তিনি ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট বিজেপি নেতা নাড্ডার সঙ্গেও বৈঠক করলেন। এই বৈঠকে ঠিক হয়েছে যে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশেষ কোর গ্রুপ গঠন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এই গোষ্ঠী শীঘ্র ঢাকায় যাবে এবং সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করবে, যাতে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি নাগরিকত্ব বিল নিয়ে না থাকে।
নাগরিকত্ব প্রশ্নে সিএএ-এনআরসি বড় বিপত্তি
আরেকটি খবর হল, আমেরিকা থেকে রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন স্রিংলা বিদেশ সচিব পদে নিযুক্ত হতে দেশে ফিরছেন। ২৯ জানুয়ারি বিজয় কেশব গোখলে অবসর নিচ্ছেন। হর্ষবর্ধন দার্জিলিংয়ের মানুষ। দিল্লিতে বাংলাদেশের যুগ্ম সচিব ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি। ঢাকায় তার কাজকর্ম দারুন। তিনি শুধু সফল নন, ঢাকা তাঁকে আজও মিস করে। কাজেই হর্ষবর্ধন সচিব হলে জয়শঙ্কর ও হর্ষ জুটি ঢাকা নিয়ে তাদের সক্রিয় কূটনীতি শুরু করবে।
একটা কথা দ্ব্যর্থহীন ভাবে আমি বলতে পারি, দেশের ভিতর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যাইহোক, অনুপ্রবেশ নামক শব্দটি বিজেপির জন্য যতই প্রয়োজনীয় শব্দ হোক, একজন মুসলিম অনুপ্রবেশকারীও আপাতত বাংলাদেশে ফেরত যাবে না।
বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে। ৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালিরা ছিলেন। জিন্নার মুসলিম লিগে দ্বিজাতি তত্ত্বকে সোহাবর্দি সমর্থন করলেও ফজলুল হক সমর্থন করেননি। তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে প্রবল বিবাদ হয়েছিল দিল্লির সঙ্গে ফজলুল হকেরও। সেসব আজ ইতিহাস। শেখ মুজিবর রহমান ফজলুল হকের পর এক অবিস্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব যিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশের এক নিজস্ব সত্তা দিতে পেরেছিলেন। তাঁর আবস্মিক দেহাবসান বাংলাদেশের মাটিতে আবার জঙ্গিবাদকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশও অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে গেছে। আজ এত বছর পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আওয়ামি লিগ ও বিএনপি বিতর্ক বা ভারতে বিজেপি বনাম কংগ্রেস বিতর্ক ভুলে যান, আসলে অমর্ত্য সেন থেকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশ থেকে অর্থনীতিবিদ বিবেক দেব রায় সবাই বলছেন এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশের হার নজরকাড়া। শেখ হাসিনা কার্যত মরুভূমিতে ফুল ফোটাচ্ছেন। এ অবস্থায় ভারত আর যাই করুক, বাংলাদেশের মত বন্ধুকে হারাতে প্রস্তুত নয়। রাজনীতির জন্য ভারতে মোদী-অমিত শাহ যাই বলুন আর তাই বলুন।
(মতামত ব্যক্তিগত)