বিশ্ব, বাংলা, এবং শেষে সেই দিল্লি, অর্থাৎ জেএনইউ। বর্ষবরণে খানকয়েক খবর শালপাতার শঙ্কুতে গরম কচুরির মত বিক্রি হচ্ছে। ওপরে ঝোলঝোলে আলু-মটর। আঙুলের ডগা দিয়ে কচুরির গরম স্তর ফুটো করার সময় ধোঁয়া একটু উড়বেই। সংবাদ থাকলেই তা নিয়ে বিভিন্ন ব্যাখ্যা থাকবে, থাকবে বিতর্ক, এবং সত্যি মিথ্যের বিভিন্ন ছায়া। সেরকম কয়েকটি খবর এবং তার ব্যাখ্যা নিয়ে এই লেখা। সত্যতা বিচারের স্বাধীনতা পাঠক-পাঠিকাদের হাতেই রইল, কারণ আজকের দিনে মনের চেয়ে হাতের জোর বেশি।
~ ১ ~
শুরু করতে হবে তেহরান বিমানবন্দরের কাছেই বিমান দুর্ঘটনা নিয়ে। গত বুধবার স্থানীয় সময় ভোরবেলায় ১৭৬ জন যাত্রী এবং বিমানকর্মী নিয়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের দিকে রওনা দেয় বিমানটি। ইমাম খোমেইনি বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করার মিনিটখানেক পরেই ঘটে দুর্ঘটনা। সকলেই জানেন, ক'দিন আগেই বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছেই মার্কিন বিমান হানায় নিহত হন ইরানের প্রখ্যাত সেনাপ্রধান কাশিম সোলেইমানি। অতটা পরিচিত না হলেও আর এক সেনাধ্যক্ষ আবু মাহদি আল-মুহান্দিসও নিহত হন সেই আক্রমণে। তার প্রতিশোধ নিতে ইরাকে অবস্থিত দুটি মার্কিন সেনাছাউনি গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইরান। যথারীতি ট্রাম্প সাহেব জানিয়েছেন যে মার্কিন সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। এর মধ্যে সোলেইমানির শেষযাত্রায় প্রচুর মানুষের উপস্থিতিতে পদপিষ্ট হয়ে মারা গেছেন বেশ কিছু মানুষ। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুবই ঘোরালো।
সেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যে এদিক-ওদিক থেকে উড়ে আসা দু'একটা মিসাইল বেজায়গায় ধাক্কা মেরে ফেলতে পারে, তা জানাই ছিল। ঠিক সেই সময়েই শক্তপোক্ত বোয়িং বিমান ধ্বংস হওয়ায় অনেকেই মনে করছেন যে ইরানের মিসাইল হানাতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুরুতে বেশি হইচই না হলেও এক দিন কাটতে না কাটতেই অন্য মাত্রা নিয়েছে বিষয়টি। তার কারণ, বিমানটিতে ছিলেন ৬৩ জন কানাডার নাগরিক। তাঁদের বেশির ভাগই আদতে ইরানের অধিবাসী। ছুটি কাটাতে দেশে এসেছিলেন। মনে রাখতে হবে, ৮২ জন ইরানের নাগরিকও ছিলেন বিমানে। ফলে এরকম একটি ক্ষেত্রে জেনেশুনে যে ইরান থেকে মিসাইল ছোঁড়া হয় নি, সেটুকু মানতে অসুবিধে হয় না।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাই মিসাইল আক্রমণের ইঙ্গিত দিয়েও 'অনিচ্ছাকৃত' শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর এর মধ্যেই অনেকগুলো কথা বলে রেখেছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। স্বভাবতই তাঁরা পুরো বিষয়টির গভীর তদন্তও দাবি করেছেন। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে একটা কথা কিছুতেই আলোচিত হচ্ছে না যে মিসাইলটা অন্যপক্ষও ছুড়ে থাকতে পারে। আপাতত যা খবর, তাতে বিমানের টুকরো খুঁজে আন্তর্জাতিক আদালতে ইরানকেই দোষী সাব্যস্ত করা হবে।
বিষয়টি কিন্তু ভারতবর্ষ পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইরানের চাবাহার বন্দরে প্রচুর লগ্নি করেছে ভারত। দেশের বর্তমান সরকার ইরানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। দেশের দক্ষিণপন্থীরা তাই এর মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন তুলেছেন, ইরানের ওপর মার্কিন আক্রমণের প্রতিবাদে বাংলার দুই নোবেলজয়ী দেশে ফিরে আসছেন না কেন?
~ ২ ~
বিষয় যখন মিসাইল এবং বিস্ফোরণ নিয়ে, তখন তেহরান থেকে সোজা নৈহাটিতে আসতেই হবে। কয়েকদিন আগেই বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ গিয়েছিল চারজনের। তারপর থেকেই রাজ্য পুলিশ কড়া হাতে (মনে নয়) বাজি খুঁজতে শুরু করেছে। ঠিক যেমন জেএনইউ-এর প্রশাসকেরা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কয়েক হাজার বিড়ি-সিগারেটের টুকরো, সারমেয়র শুকনো বিষ্ঠা এবং ব্যবহৃত আরও অনেক কিছু খুঁজে পান, ঠিক সেই মনোযোগে আমাদের রাজ্যেও ধানিপটকা খোঁজা শুরু হলো।
শুরুতেই এটা জানা গেল যে কোথাও বিপজ্জনক বিস্ফোরক নেই। সবটাই চরকি থেকে কালিপটকা, কিংবা ছুঁচোবাজি থেকে বড়জোর অশীতিপর বৃদ্ধা মায়ের চকোলেট বোম। সবশেষে সংবাদমাধ্যমের গভীর অন্তর্তদন্তে পাগলা দাশুর চিনেপটকা-র কথাও উঠে আসছে। গত কয়েকদিন ধরেই মেঘলা শীতের দুপুরে শান্তিরক্ষকরা গঙ্গার পূর্বপাড়ে উদ্ধার করা বাজি ফাটাচ্ছিলেন এবং একইসঙ্গে দেশোদ্ধার করছিলেন। খুঁজে আনা কালিপটকা ফাটানোয় আমাদের রাজ্যের পুলিশবাহিনীর দক্ষতা প্রমাণ হচ্ছিল বারবার। বেকার যুবকদের দুপুরটা বেশ ভালোই কাটছিল। একগাদা বাজি একসঙ্গে ফাটানোর পর আকাশে যে ব্যাঙের ছাতার মত ধোঁয়ার আস্তরণ তৈরি হয়, মেঘলা দিনে তার ছবিও বেশ সুন্দর ধরা পড়ছিল মুঠোফোনে।
গোল বাঁধল দিন দুই আগে। নৈহাটির বাজির শব্দ হেঁটে হেঁটে গঙ্গা টপকে চুঁচুড়ার বাড়িঘরের দফারফা করে দিল। গরীব ঘরের চাল উড়ল, পুরোনো বাড়ির দেওয়ালে ফাটল ধরল, আর হ্যাভ কিংবা হ্যাভ-নট নির্বিশেষে একাধিক জানলার কাচ ভাঙল। বিষম শব্দে ছোট বাচ্চার ঘুম ভাঙল, মায়ের হাত থেকে ছিটকে পড়ল ভাতের হাতা। বুড়ো দাদুর ছোট বাথরুম সেই যে আটকাল, এখনও ক্যাথেটারে কাজ চলছে। রাজ্য সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে। তাই জানলার কাচের দামের সঙ্গে চিকিৎসার খরচটাও দাবি করছেন একাধারে শব্দবাজি এবং শুক্রবার থেকে লাগু হওয়া সিএএ-আক্রান্ত বৃদ্ধ নাগরিক।
আজ, শনিবার, নৈহাটি পুরসভার মিটিং আছে। সেখানে বয়স্ক ভদ্রলোকের দাবি নিয়ে শুরুতে গভীর আলোচনা হবে। তারপর সময় থাকলে আর একটি এজেন্ডা আইটেম আছে। গঙ্গার ধারে ত্রিমাত্রিক দশফুট বাই দশফুট বাই দশফুট যে গর্তর সৃষ্টি হয়েছে, সেখানে নতুন সুইমিং পুল বানিয়ে নতুন পর্যটন কেন্দ্র খোলা হবে। আজ-কাল কলকাতা ভ্রমণের মধ্যে সময় সুযোগ পেলে দাদা-দিদি মিলে তার চটজলদি উদ্বোধনের সম্ভাবনা আছে। রাজভবন থেকে নৈহাটি যাওয়ার জন্যে হেলিকপ্টার তৈরি থাকছে। যে দুঃখী মানুষটি চাইলেও হেলিকপ্টার চড়ার সুযোগ পান না, তিনিও নাহয় সঙ্গী হবেন।
~ ৩ ~
মিসাইল, চিনেপটকা, এসব তো আধুনিক সভ্যতার দান। সনাতন ভারতবর্ষের দিকে তাকালে বিস্ফোরক নাস্তি। সেখানে শুধুই লাঠিখেলা। পড়শী দেশের সঙ্গে লড়তে গেলে বিমান হানা। সেটা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়। কিন্তু দেশের মধ্যে যে দেশদ্রোহী, তারা তো আমাদেরই সন্তানসন্ততি। সুতরাং কানমলা বা দেড়শোবার ওঠবোসের মত শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। তার বেশি নয়। সেই জন্যেই লাঠি হাতে দেড়শো খোকার কাণ্ড দেখানো হলো।
তারপর হপ্তাখানেক ধরে দেশজুড়ে হইচই। জায়গায় জায়গায় পড়ুয়াদের মিছিল চলছে। সেটাই তো কাম্য। এই শীতে আর কত পিকনিক করবে? বনভোজনের সাদা মুরগি অরুচি ধরিয়েছে। তাই স্বাদ বদলের জন্যে মিছিল মিটিং, শীতে গা গরমও হয় ভালো। তবে সৎভাবে কাজ করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের মত দিল্লি পুলিশও অনুপ্রাণিত। তাই পোড়া বিড়ির ল্যাজ খোঁজার দক্ষতায় তাঁরা চটজলদি জেএনইউ হামলার অপরাধীদেরও চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো সব বাম নেতা-নেত্রী এবং সমর্থক। সহজ অঙ্কের উত্তর তো সহজই হবে।
দক্ষিণপন্থী কেন্দ্রীয় সরকারের দিল্লি পুলিশ বামপন্থী পড়ুয়াদের দোষী সাব্যস্ত করেছে। বামপন্থী ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত জেএনইউ-তে মিটিং মিছিল করে সেটা যেমন সত্যি, তেমনই শাসকের ইশারাতে ডাণ্ডাবাজি চলছে, সেটাও সম্ভবত মিথ্যে নয়। আর গণতান্ত্রিক দেশে জেএনইউ এর বাম আন্দোলনের পক্ষে যেমন অনেক কথা শোনা যাচ্ছে, সমালোচনাও আছে পাশাপাশি।
কোন পক্ষ নেবেন সেটা ভেবে উঠতে না পারলে খুব ক্ষতি নেই, মাঝখানে বসে থাকার অসাধারণ উদাহরণ হিসেবে আইআইটি খড়গপুরের প্রযুক্তিবিদ তো আছেন।
উপসংহার
ঠিক ধরেছেন, মধ্যপন্থায় চরম সফল ঋষি অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথা এই প্রসঙ্গে বলতেই হবে। কীভাবে রাজধানীর দেশপ্রেমীদের না চটিয়ে, এবং জেএনইউ-এর ছাত্র আন্দোলনের থেকে দূরে থেকে আসন্ন দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে নিজের ভোট বাড়ানো যায়, তা দেখিয়ে দিচ্ছেন এই বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, দিল্লি বিধানসভায় সত্তরের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি আসন পেতে পারেন তিনি। একেই বলে রাজনৈতিক পরিপক্বতা।
এ রাজ্যের নেত্রীও বাম-কংগ্রেস ধর্মঘটের পর চিনেপটকা এবং ডাণ্ডা থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখছেন। আপাতত মধ্যপন্থা অবলম্বন করে গদিটা তো বাঁচানো যাক। তারপর ডান-বাম বুঝে নেওয়া যাবে। তবে রামভাবনার সঙ্গে সঙ্গে বামভাবনা তো থাকবেই। সপ্তাহান্তের সকালে এক মিত্রোঁ মনে করিয়ে দিলেন, "ডানপন্থীরা ডানপন্থী হয়েই ক্ষমতায় আসেন। মধ্যপন্থী বা বামপন্থীরা ক্ষমতায় এলে আস্তে আস্তে ঠিক ডানপন্থী হয়ে যান। সেই জন্যেই নিত্যনতুন বামপন্থার খোঁজ চলবেই।" খবর এবং তার ব্যাখ্যা যেমনই হোক না কেন, জেএনইউ তাই প্রাসঙ্গিক, এখনও।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)