একুশ শতকের সবে এক পঞ্চমাংশ পার হল। বিশ শতকে এ সময়ের মধ্যে একটা বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গিয়েছে, হয়ে গিয়েছে বলশেভিক বিপ্লবও, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা তো ছেড়েই দিলাম। এই শতক শুরু হয়েছে ৯-১১ দিয়ে। আর তারপর ইসলামপন্থী সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে গিয়ে বিশ্বের রাজনীতিই পাল্টে গিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে লাগাতার যুদ্ধ চলছে ইরাক-সিরিয়া হয়ে ইরান-আফগানিস্তান পর্যন্ত।
গত শতাব্দীতেই ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয়েছে। এখন সমস্ত মহাশক্তিধর দেশগুলি মুসলিম দেশগুলির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে চেচনিয়ার লড়াই হচ্ছে, চিন নিজের দেশে উইঘুরদের সঙ্গে যুদ্ধে রত। ফ্রান্সে এ শতকেই নাগরিকদের উপর একাধিক সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সারা বিশ্বের মুসলিমদের প্রতি শত্রুমনোভাবাপন্ন এবং সদ্য সদ্য ইরানের বিরুদ্ধে নিজের অপ্রসন্নতা ব্যক্ত করেছেন। ফলে খুব সম্ভাবনা না থাকলেও, এমনটা হতেও পারে যে এ শতকের দ্বিতীয় পঞ্চমাংশে একটা বিশ্বযুদ্ধ হয়েই গেল।
কেন এমনটা ঘটল! ২১ শতক কীভাবে এত চরম মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠল! একবার ১৯২০-র দিকে ফিরে তাকানো যাক। ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো সাম্রাজ্য, অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ল। শেষ হল ১২০০ বছর ধরে ইসলামের বিশ্বশাসন। পশ্চিমি বিশ্বের পূর্ব ফ্রন্টে ইসলাম নিয়ে আর ভয়ে ভয়ে থাকা শেষ হল।
বিশ শতকের বাকি সময়টা চলে যায় পশ্চিম ইউরোপের ধ্ংসের কারণে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করতে করতে। অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, রাশিয়ানরা বলশেভিক মতবাদের জন্ম দেয়। জার্মান সাম্রাজ্য ভেঙে যায় ফ্যাসিবাদের উত্থানে। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত লেগে যায় বলশেভিক ব্যাপারটার সমাধানে। এর মধ্যে পশ্চিম ইউরোপের সাম্রাজ্য মিলিয়ে গিয়েছে। চিনের হাতে হংকংকে তুলে দেওয়ায় শেষ হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।
কিন্তু অটোমান সাম্রাজ্যের সমস্যার সমাধান হয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্স গোপন চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের দখল নিয়েছিল। সেগুলোর নামও দেওয়া হয়েছিল। যথা প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, লেবানন। পশ্চিমি শক্তির বেসরকার উপনিবেশ হিসেবেই থেকে গিয়েছিল এগুলি। কেবল তুর্কি প্রজাতন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, আরব দেশগুলি তুলনামূলক কম স্বাধীন রাজন্যশাসিত হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রসংঘের সৌজন্য যখন ইজরায়েল তৈরি হয় তখন এই আরব রাষ্ট্রগুলি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে তিন তিন বার যুদ্ধজয়ের ব্যর্থ চেষ্টা করে। ১৯৭৩ সালে হতাশার করাল গ্রাস তৈরি হয়ে যায়। আরব সমাজতন্ত্র ও প্যান আরববাদ আবেদন হারায়। জনতার কাছে ধর্ম হয়ে ওঠে সান্ত্বনাস্বরূপ। তেল সমৃদ্ধ সৌদিতে ওয়াহাবিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ইরানে শাহের জায়গায় ক্ষমতায় আসে আয়াতোল্লারা। সুন্নি ও শিয়া দু পক্ষের হাতেই তেল সমৃদ্ধ দেশ, যার জেরে তারা গোঁড়া ইসলামি মতবাদকে উৎসাহ দিতে থাকে। ইরান-ইরাকের যুদ্ধ নিষ্ঠুরতম যুদ্ধে পরিণত হয়।
ইসলামতন্ত্র একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। সংকটের প্রত্যুত্তরে এর জন্ম, কিন্তু এর ছিল রাক্ষুসে মুখ। ইসলামতন্ত্রের রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল গোটা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে মুসলিম সরকারগুলো ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। মার্কিনরা আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে হঠানোর জন্য একে ব্যবহার করেছিল, যার ফলে জন্ম হয়েছিল তালিবান ও আল কায়েদার। এ নিয়ে যদিও বিতর্ক হতে পারে, তবে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ইসলামতন্ত্র সম্ভবত অন্যদের থেকে মুসলিমদের বেশি হত্যা করেছে। এটা একটা ট্র্যাজেডি। এর কোনও শেষ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।