Advertisment

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ও শিক্ষকরা

অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক নিতাই বসুর বয়স এখন প্রায় নব্বই। যে রাজনীতি তিনি করেছেন সারা জীবন, যা দেখেছেন, অপকটে নির্ভয়ে তা লিখে ফেলেছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
jadavpur university

যাদবপুরের উপাচার্য আচার্যের মুখের উপর বলে দিলেন, পদ থেকে ইস্তফা দেবেন তিনি তবু ছাত্র পেটাতে পুলিশ ডাকবেন না। এটাই রীতি ছিল পশ্চিমবঙ্গে, যদিও মাঝে মধ্যে তা ভেঙেছেন কেউ কেউ।  নতুন করে সেই রীতি ফের প্রতিষ্ঠা পেল সুরঞ্জন দাসের হাত দিয়ে। রাজনৈতিক কারণে, আদর্শগত কারণে,  কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ঢুকতে দেব না, এমন আন্দোলন যাদবপুরে মোটেই নতুন নয়।

Advertisment

১৯৪৮ সালের কথা। যাদবপুরে সমাবর্তনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ভাষণ দেবেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী সর্দার বলদেও সিং। সবার সহযোগিতা চেয়ে মিটিং ডাকলেন উপাচার্য ত্রিগুণা সেন। ছাত্র ইউনিয়ন বলল, বলদেও সিং নয়, তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের কী সম্পর্ক! ডাকা হোক কোনও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা শিক্ষাবিদকে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষা দফতর গবেষণার জন্য উপাচার্যকে বিপুল অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়েছে। ত্রিগুণা সেন অনুরোধ করলেন, পড়ুয়াদের বললেন মেনে নিতে। ছাত্ররা অনড়। সেই সময়, একদিনের ঘটনা। ছাত্ররা কলেজের গাছের গায়ে আঠা দিয়ে বলদেও বিরোধী পোস্টার সাঁটছেন, হঠাৎ দেখা গেল পেছন পেছন পোস্টারগুলি ছিঁড়তে ছিড়তে আসছেন ত্রিগুণা সেন। ছাত্ররা বলল, ‘আমরা কষ্ট করে পোস্টার লাগাচ্ছি, আর আপনি সেসব ছিঁড়ে ফেলছেন?’ ত্রিগুণা সেন বললেন, তোমাদের পোস্টার লাগানোর স্বাধীনতা যেমন আছে, আমারও তেমনি অধ্যক্ষ হিসেবে স্বাধীনতা আছে কলেজের স্বার্থে ওই পোস্টার ছিঁড়ে ফেলার। আমি তো তোমাদের বাধা দিচ্ছি না।

আরও পড়ুন, যাদবপুরে বাবুল সুপ্রিয় ও নতুন বাম নেতার সন্ধান

সমাবর্তনের দিন সকালে হঠাৎ ছাত্রদের দাবি নিয়ে আলোচনার জন্য আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা-নেত্রীদের একটি ঘরে ডেকে পাঠালেন ত্রিগুণা সেন। ছাত্রনেতারা সেই ঘরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরে ঘরটিতে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। কনভোকেশন শেষ হলে তালা খুলে ছাত্রদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দেন ত্রিগুণা সেন। পরে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘তোমাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য আমি তোমাদের আটকাইনি, কলেজের সম্মান রক্ষার স্বার্থে  আমি বাধ্য হয়ে এটা করেছি’।  এই ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত যাদবপুরের প্রাক্তন ছাত্র, অর্থনীতির অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক নিতাই বসুর বই ‘অশীতিপর চোখে ফিরে দেখা কমিউনিস্ট জীবন’-এ। নিতাই বসুর একটু পরিচয় জরুরি।

অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক নিতাই বসুর বয়স এখন প্রায় নব্বই। যে রাজনীতি তিনি করেছেন সারা জীবন, যা দেখেছেন, অপকটে নির্ভয়ে তা লিখে ফেলেছেন। বাবা ছিলেন লেখক এবং গান্ধীবাদী। দাদা কম বয়সে জেলে যান, বলশেভিক পার্টি করার জন্য। আদি বাড়ি খুলনার গ্রামে। দুই বিধবা বোনকে কলকাতায় নার্সিং পড়তে পাঠিয়ে পরিবার গ্রামে বেশ চাপের মুখে পড়েছিল, তবে এর থেকে বাড়ির পরিবেশ আন্দাজ করা যায়। নিতাই ভর্তি হলেন বঙ্গবাসী কলেজে।

সেই সময়ে বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যক্ষ প্রশান্ত বসু তাঁর কলেজের রাজনীতি করা ছাত্রদের প্রতি কতটা দরদী ছিলেন, তা নিয়ে এক অসাধারণ ঘটনার কথা নিতাইবাবু তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।  ভিয়েতনামের মুক্তি যুদ্ধের সমর্থনে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করে গ্রেফতার হলেন নিতাই সহ এক দল ছাত্র।  সাল ১৯৪৬।  পরের দিন দেখা গেল ছাত্রদের হয়ে কালো কোট গায়ে মামলা লড়ছেন বঙ্গবাসীর  কেমেস্ট্রির এক বিশিষ্ট অধ্যাপক ল্যাডলিমোহন মিত্র। রায় হল ছাত্ররা ৫০টাকা জামিনে ছাড়া পাবে। ছাত্ররা বলল, তারা কোনও দোষ করেনি, ফলে তারা টাকা দেবে না। মুক্তি চায় না তারা। তারা জেলেই থাকবে। কিন্তু তা হল না। কলেজের অধক্ষ প্রশান্ত বসু প্রতি ছাত্রের জন্য ৫০ টাকা করে জমা দিয়ে ছাত্রদের ফিরিয়ে আনতে বললেন ল্যাডলিমোহন মিত্রকে। হলও তাই। ছাত্ররা মুক্তি পেয়ে অবাক। পরে তারা জানতে পারল অধ্যক্ষ এই কাজ করেছেন। তারা দল বেঁধে অধ্যক্ষকে বলল, কেন আপনি টাকা দিয়ে আমাদের ছাড়িয়েছেন? আমরা কোনও দোষ করিনি। কেন আমরা টাকা দেব! প্রশান্তবাবু বললেন, ‘তোমরা তো জরিমানা দাওনি। কলেজ টাকা দিয়েছে। কলেজে ছাত্ররা না এলে কলেজের তো কষ্ট হয়, তাই কলেজ তোমাদের ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে’।

কলেজ থেকে পাশ করে নিতাই বসু গিয়েছিলেন যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। তবে সেই পড়া তাঁর শেষ হল না। মাঝপথে পড়া ছেড়ে সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী হয়ে চলে গিয়েছিলেন কৃষক সংগঠন করতে। পরে অবশ্য তিনি ফিরে এসে বিদ্যাসাগর কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়েন।  শিক্ষক আন্দোলনের নেতা এবং অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

Babul Supriyo Jadavpur University
Advertisment