Advertisment

জেএনইউ কী শেখাল? হয় বশ্যতা, নয় ধ্বংস

এভাবে একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠী তৈরি করে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আপামর ছাত্রের স্বার্থহানি করার জন্য চোরাগলি বানানোর চিত্রনাট্য নিঃসন্দেহে আগে দেখিনি আমরা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
jnu violence aishe ghosh

জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষ। ছবি: তাশি তোবগিয়াল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র!

প্রাতিষ্ঠানিক সন্ত্রাস!

সম্পূর্ণ এক প্রজন্মকে হয় গলায় বকলস পরাও, নাহলে ধ্বংস করে দাও!

Advertisment

আর কী কী বললে ঠিক মনের ক্ষোভ, জ্বালা, ধিক্কার, নিন্দা এবং সর্বোপরি অসহায়তা প্রকাশ করা যায়, জানি না। অসহায়ই তো। কলমও কখনও কখনও ভাষা হারিয়ে ফেলে, অসহায় হয়ে যায়। আর এটাই বোধহয় তাদের চাওয়া। মানুষ বলার ভাষাটুকুও হারিয়ে ফেলুক আতঙ্কে, ঘেন্নায়, বিভ্রান্তিতে। 'গণতন্ত্র' শব্দটাই হারিয়ে যাক দেশের অভিধান থেকে। কোনও রাখঢাক না রেখেই বলে দেওয়া হচ্ছে শাসনের অন্তিম বাণী। বকলস পরে, বশ্যতা স্বীকার করে, শর্ত মেনে, নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে বাঁচো। নাহলে মরো।

বিশেষভাবে টার্গেট এখন ছাত্রসমাজ। বেছে বেছে দেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণের লক্ষ্য করা হচ্ছে। রীতিমতো পরিকল্পনা করে, রাজনৈতিক চতুরতার সঙ্গে চালানো হচ্ছে সন্ত্রাস। এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন যাবতীয় প্রতিবাদী আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এভাবে কি সত্যিই কোনও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন বন্ধ করা যায়? ইতিহাস সাক্ষী। এতে আগুনে ঘি ঢালার কাজটাই বেশি করে ঘটে। এহেন সব আক্রমণ কোনও না কোনওদিন বুমেরাং হয়ে ফেরে।

আরও পড়ুন: জেএনইউকাণ্ড: হোয়াটসঅ্যাপই কি মুখোশ খুলল এবিভিপির?

রবিবার রাতের অন্ধকারে হামলা জেএনইউ ক্যাম্পাসে। হামলাকারীদের মুখ ঢাকা ছিল কালো কাপড়ে। মূলত গার্লস হোস্টেল ছিল লক্ষ্যে। আরও কয়েকজনের সঙ্গে আক্রান্ত জেএনইউ ছাত্র সংসদের সভাপতি ঐশী ঘোষ। আহত হন এক মহিলা অধ্যাপকও। তান্ডব এতটাই চলে যে আতঙ্কে পড়ুয়ারা একে একে হোস্টেল ছেড়ে পালিয়ে যায়। আঘাত গুরুতর থাকলেও শারীরিকভাবে আপাতত স্থিতিশীল ঐশী। সোমবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন প্রতিবাদী এই কন্যা। এসেই মুখোমুখি হয়েছেন সাংবাদিকদের। বেশ বোঝা গেল, এই আক্রমণ এতটুকু কাবু করতে পারেনি তাঁকে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সাংবাদিকদের জানিয়ে দিলেন, আরএসএস-এর গুন্ডারাই এই হামলা চালিয়েছে। শুধু তাই নয়, বেছে বেছে আক্রমণ চালানো হয়েছে। হামলাকারীরা খুঁজে খুঁজে মেরেছে তাঁদের।

দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এইমস) জানিয়েছে, অন্তত ১৮ জন ভর্তি মাথার আঘাত নিয়ে। ঐশীর অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত চলবে কিনা জানা নেই। তবে, দিল্লি ক্রাইম ব্রাঞ্চ মাঠে নামার পরেও গ্রেফতার শূন্য (এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত)। সাম্প্রতিক খবর, উল্টে ঐশীর বিরুদ্ধেই জেএনইউ কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর হয়েছে। তদন্ত করছে দিল্লি পুলিশ। আরও ১৯ জন পড়ুয়ার নামও রয়েছে এফআইআর-এ।

প্রসঙ্গত, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এটা দু'দল ছাত্রের গন্ডগোল। তারও আগে আছে একটি প্রতিবাদের কাহিনী। সেখানেও বকলমে এটাই বলা হচ্ছে, প্রতিবাদের নামে অশান্তি করেছে এসএফআই সমর্থিত ছাত্র ইউনিয়ন। যেন সেই প্রতিবাদের এক্সটেনশন এই তথাকথিত দু'দলের ঝামেলা। তাহলে যুক্তিমতে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা? একটি দল আন্দোলন করছিল, আর অন্য দলটি তা প্রতিহত করতে রাতের অন্ধকারে মুখ ঢেকে এসে হামলা চালাল? দেশের প্রথম সারির এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলঙ্কিত রক্তঝরা অধ্যায়টিকে এভাবেই ব্যাখ্যা করবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ?

আরও পড়ুন: ‘ও যখন শুনবে না, তখন আর বলে কী হবে?’, দুর্গাপুরের বাড়িতে উদ্বিগ্ন ঐশীর দিদিমা

সে যাই হোক, প্রশাসন কী ক'রে কী করে তা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামানোই ভালো। কিন্তু যেটা নিয়ে ভাবার, সেটা তো ভাবতেই হবে। সারা দেশ জুড়ে যে প্ৰতিবাদের ঝড় উঠেছে, তাকে কী করে নিয়ন্ত্রণ করবে প্রশাসন? জেএনইউ-এর পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদে পথে নেমেছে জামিয়া মিলিয়া, যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি, বিশ্বভারতী, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সারা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়ারা। ছাত্রছাত্রীরা রাগে ফুঁসছে। তারা তাদের ভাষাতেই উত্তর চাইছে। প্রতিকার চাইছে এই অন্যায়ের।

প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনও। তীব্র নিন্দা করেছেন জেএনইউ-র প্রাক্তনী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। "হিটলারের জার্মানির পথে এগোচ্ছে ভারত," বলেছেন তিনি। অন্যদিকে শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, ক্রীড়াবিদ (ভারতীয় দলের প্রাক্তন ক্রিকেটার বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীর সহ), রাজনৈতিক নেতা (বিরোধীরা তো বটেই, সরকার পক্ষেরও কেউ কেউ), সকলেই সমালোচনায় মুখ খুলেছেন দ্বিধাহীনভাবে। একইভাবে বলিউড ও টলিউডের প্রবীণ ও নবীন অভিনেতা, প্রযোজক ও পরিচালকরাও বলেছেন, এটা ঘোর অন্যায়! এর যথাযথ তদন্ত এবং দোষীদের বিরুদ্ধে চরমতম ব্যাবস্থা নিতে হবে।

কথা হলো, এইসব নিন্দা, প্রতিবাদ, সমালোচনার শব্দগুলি সেই কঠিন বধির দেওয়ালটিতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসবে না তো? জেএনইউ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য সেদিকেই ইঙ্গিত করে। আর একটা বিপজ্জনক বিষয় হলো, আমরা এখন 'স্বভাবত সবভুলো' এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। যে কোনও ইস্যু ঠান্ডা হলেই তার গুরুত্ব হারিয়ে যায় আমাদের কাছে। সে যত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা সমস্যাই হোক। বলা বাহুল্য, এই সুযোগটাই নেয় প্রাতিষ্ঠানিক মুখোশের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অভিজাত অপরাধীরা। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিত ভাবে মানুষের আবেগে সুড়সুড়ি দেওয়া কোনও একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে তারা।

আরও পড়ুন: জেএনইউকাণ্ডের ২৪ ঘন্টা অতিক্রান্ত, শনাক্ত করা গেল না আক্রমণকারীদের, হল না গ্রেফতার

ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, ছাত্র আন্দোলন প্রতিহত ও প্রতিরোধের ঘৃণ্য পদ্ধতি অতি পুরোনো। এটা যুগ যুগ ধরেই হয়ে চলেছে। তবে সেই ঘৃণ্য পদ্ধতিরও চরমতম রূপটি বোধহয় দেখছি আমরা এখন। রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে, ছাত্রদের মধ্যে 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' পলিসি প্রয়োগ করে, আন্দোলন ভেঙে দেওয়া আগেও ঘটেছে। কিন্তু এভাবে একটি নির্দিষ্ট ছাত্রগোষ্ঠী তৈরি করে, তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে আপামর ছাত্রের স্বার্থহানি করার জন্য চোরাগলি বানানোর চিত্রনাট্য নিঃসন্দেহে আগে দেখিনি আমরা। গত এক বছরে দেশে রেকর্ড পরিমাণ ছাত্র আন্দোলনের ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা জনসমর্থন পেয়েছে। আর সব ক্ষেত্রেই তাদের দাবিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক নির্মমতার চূড়ান্ত রূপ খবরে উঠে এসেছে। এতটা বাড়াবাড়ি অবশ্যই এ যাবৎ কখনও দেখেন নি দেশের মানুষ।

একটা কথা গভীর ভাবে ভাবা জরুরি। সেটা হলো, এই আন্দোলন ও তাকে কেন্দ্র করে অশান্তি, সবটাই কি নিছক ছাত্র আবেগ? পুরোটাই কি তাদের তাৎক্ষণিক ভাবনাজনিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফসল? মনে হয় না। যে ঘটনা বারবার ঘটে, তার পিছনে আবেগ নয়, কিছু উর্বর ও পরিণত মাথার জটিল, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুপরিকল্পিত দীর্ঘস্থায়ী ভাবনা কাজ করে।

আরও পড়ুন: জেএনইউ হামলার জের, কমিটি ছাড়লেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক

এক তো গোড়াতেই মারো হাতুড়ি। এমন ভয় দেখাও, যেন ভুলেও আর কেউ প্রতিবাদ না করে। তারই সঙ্গে একের পর এক নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন মারাত্মক গন্ডগোল হওয়ার পর অনেকেই ধীরে ধীরে তাঁদের পরিবারের ছেলেমেয়েদের এখানে পড়তে পাঠানো বন্ধ করে দেবেন। সেখানেও ওই আতঙ্কই অনুঘটকের কাজ করবে। তাহলে এই সব জায়গায় পড়বে কারা? উত্তরটা সোজা! কিছু পেটোয়া লোকের বাড়ির ছেলেমেয়েরাই পড়তে যাবে এখানে। তারা আর কিছু না হোক, খুব ভালো তোতাপাখি হতে পারে। আর কী চাই? একটা প্রজন্মকে তোতাপাখি বানিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে!

কিন্তু সত্যিই কি তাই? ফর্মুলাটা কি এতটাই সহজ? দেশের মানুষ কি দেখেই যাবেন এসব? ধর্মের আফিম খেয়ে অমানবিক ধর্মের জয়গান কোনও একদিন তাঁদের কানেও বেসুরো লাগবে না কি? মানুষ গড়ার কারখানায় মানুষের বদলে পুতুল বানানোর চেষ্টা যদি সত্যি সফল হয়, তবে তো পুরো জাতিটাই একদিন কয়েকজন ক্ষমতাশালীর হাতের পুতুল হয়ে যাবে।

কালের গর্ভে আছে এই সব যাবতীয় সংশয় ও প্রশ্নের জবাব। ইতিহাস বলে, সব কিছুরই শেষ হয়। ক্ষমতার আগ্রাসন, লোভ, দম্ভ, সেকথা মনে রাখে না। হিটলারও মনে রাখেন নি। ইতিহাস ক্ষমা করেনি তাঁকে। এদেশের ক্ষেত্রেও আগামী দিন কী দেখায়, আপাতত তার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া আমাদের হাতে আর কিছু নেই। আমরা মানে দেশের সেই সব অগণিত সাধারণ মানুষ, যাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন না। নিয়ন্ত্রিতই হন বরাবর।

JNU
Advertisment