Advertisment

জেএনইউ-র জয়ে শিক্ষা জোটশক্তির

শাসকদলপুষ্ট ছাত্রপরিষদ রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির মতো অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ দখল করতে পারলেও, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি কিন্তু থেকে গেছে সেই বিরোধিতায়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

জওহর লাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (ছবি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)

পরপর তিনবার দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) ছাত্রসংসদ দখলে রেখে বামপন্থী ছাত্রজোট বুঝিয়ে দিল, ধর্মীয় সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জোটশক্তির প্রাসঙ্গিকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার চূড়ান্তে থেকেও বিজেপি-র ছাত্রশাখা অখিল ভারতীয়  বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) এবারও গোহারা হেরেছে নির্বাচনে। ভোটের আগে ক্যাম্পাসে দিল্লির তাবড় নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের দিয়ে সাড়ম্বর প্রচারসভা করে, মারদাঙ্গা করেও শেষরক্ষা করতে পারেনি গেরুয়াপন্থী ছাত্ররা। গত-রবিবার বামপন্থী জোটের জয়ে লাল-আবিরের উৎসবে ঢেকে গেছে প্রাঙ্গণ। এই জয় কেবল রাহুল-মায়া-মমতার পক্ষেই নয়, জেএনইউ-র সুবিখ্যাত প্রাক্তনী প্রকাশ কারাটদের কাছেও তাত্ত্বিক-শিক্ষা হতে পারে। কেননা, অতীতে ছাত্র-আন্দোলনে প্রসেনজিৎ বসুদের জোটতত্ত্ব কেবল খারিজই করেননি কারাট, পরিণতিতে দল থেকে বহিষ্কৃতও হতে হয়েছে প্রসেনজিৎকে। তারও আগে কংগ্রেসের সঙ্গে মাখামাখির অভিযোগে দল ছাড়তে হয়েছিল সইফুদ্দিন চৌধুরীর মতো প্রাক্তন-ছাত্রনেতাকে। পরে কারাটের অবিমৃশ্যকারিতায় ভেঙে গিয়েছিল ইউপিএ-সরকার। তাঁরই জেদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে পারেননি জ্যোতি বসু। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে দলের জোটেও সিলমোহর দেননি তিনি। সেবার অবশ্য বেসরকারি জোটেও ভোট জোটেনি বঙ্গব্রিগেডের। কিন্তু, জেএনইউ-র জয় নতুন করে বোঝাল, দেশে ধর্মীয় মৌলবাদী তথা মিথ্যাচারী ও ফ্যাসিবাদী দলটিকে রোখার চেষ্টায় বিরোধী দলগুলির সার্বিক জোটবদ্ধতার অপরিসীম গুরুত্বও।

Advertisment

জেএনইউ-র ছাত্রসংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষিতটি বিশেষ তাৎর্যপূর্ণ। দু-বছর আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকেই কানাহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্যরা রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসা ও জম্মু-কাশ্মীর ও মণিপুরে সেনা-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। কানাহাইয়া অভিযোগ করেছিলেন, কাশ্মীরে সেনার ভূমিকা কেবল খুনির নয়, ধর্ষকেরও। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী সরকার বিষয়টি স্বভাবতই রাষ্ট্রদ্রোহিতার নিরিখে মোকাবিলা করার ব্যর্থ-চেষ্টা করেছিল। তখন কানাহাইয়াদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলাও রুজু হয়। তা অবশ্য ধোপে টেকেনি। প্রমাণিত হয়েছিল,  এবিভিপি-র সমর্থনপুষ্ট বহিরাগতরাই সংসদহামলার জঙ্গি আফজল গুরুর পক্ষে স্লোগান তুলেছিল, কানাইহারা নন। গেরুয়াবাদী ছাত্ররা গত-বছরের মতো এবারও কানাহাইয়া কুমারদের সঙ্গে বর্তমান বামপন্থী ছাত্রনেতৃত্বকে দেশবিরোধী হিসাবে দেগে দিয়ে নিজেদের দেশপ্রেমিক প্রতিভাত করে ছাত্রদের সমর্থন চেয়েছিল। কিন্তু, ছাত্রসংসদের প্রাক্তন সভাপতি কানাহাইয়া কুমারের নীতি-আদর্শ যে ছাত্রদের মধ্যে এখনও প্রভাববিস্তারী, তা বোঝা গেছে এই নির্বাচনী ফলে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৩)

কেবল তা-ই নয়। দেশে মেধাবী ছাত্রদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির যে কোনও ঠাঁই নেই, তা ফের সমঝে দিল জেএনইউ-র ছাত্ররা। রাজ্যে যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই রাজধানীতেও জেএনইউ-র ছাত্রসংসদে বাম-ঐক্য গোষ্ঠীর জয় রাষ্ট্রীয় বিক্রমের বিরুদ্ধে নিঃসন্দেহে এক চপেটাঘাত বলেই চিহ্নিত হবে। গেরুয়া-ব্রিগেডের কী কর্মসূচি ছিল নির্বাচনে? তারা বলেছিল, বামপন্থীরা দেশ ও জাতীয়তাবাদবিরোধী। তারা গোমাংসভক্ষণ সমর্থন করে। বিদেশি মতবাদের প্রচার করে সনাতন ভারতীয়ত্ব ধূল্যবলুণ্ঠিত করার চক্রান্তে লিপ্ত। এবিভিপি ক্ষমতায় এলে ক্যাম্পাসে আমিষ-খাবার বন্ধ করবে। লাভজেহাদি বন্ধ করবে। মেধাবী ছাত্রদের কাছে এমনধারা ফ্যাসিস্ট-কর্মসূচি নিয়ে যারা ভোট চাইতে যায়, তাদের ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। ৪-০ গোলে গোহারা হয়েছে তারা। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক দলগুলির এই ফলাফল থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে। রাজ্যে শিক্ষা নেওয়ার আছে আধিপত্যবাদী শাসকদল ও তাদের তোলাবাজ ছাত্রদলেরও।

জেএনইউ দেশের বৃহত্তর-রাজনীতির আঁতুড়ঘর।  প্রকাশ কারাট, মানেকা গান্ধী, নির্মলা সীতারামন, যোগেন্দ্র যাদব, প্রসেনজিৎ বসু থেকে কানাহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্যরা বিভিন্ন সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি করেছেন। ফলে, জেএনইউ-র নির্বাচনে চিরদিনই নজর থাকে রাজনৈতিক মহলের। এবার আরও বেশি ছিল। ২০১৯-এর লোকসভা-ভোটের আগে জেএনইউ-তে গেরুয়াপন্থীদের পরাজয় তাই ভাঁজ ফেলবেই অমিত শাহর কপালে। বিপরীতে, ফ্যাসিবাদের সামগ্রিকতায় বামপন্থীদের জয় নিশ্চিতভাবেই একটি রুপালি-রেখা। কেননা, কেবল কানাইহাদের অতীত-আন্দোলন নয়, দেশে একের-পর-এক আর্থিক দুর্নীতি, গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুনিধন থেকে দেশ জুড়ে বিদ্বজ্জনদের গ্রেফতার ও প্রতিবাদীদের ‘নাগরিক নকশাল’ হিসাবে চিহ্নিত করার মতো ঘটনাপ্রবাহ ছিল এই নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিত। অহং-ঘোরে-আচ্ছন্ন শাসকদল ভেবেছিল, দেশের আকাশেবাতাসে এখনও কেবল মোদীমন্ত্রই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। মোদীজাদু, মোদীমিথ্যা দিয়েই পার হওয়া যাবে জেএনইউ-র বৈতরণীও। কিন্তু, সাম্প্রতিককালের উপ- নির্বাচনগুলির মতো ছাত্ররাও বুঝিয়ে দিয়েছে, মোদীম্যাজিক আসলে একটি গুজব, ফোলানো-বেলুন মাত্র। সামান্য-আলপিনেই তার হাওয়া বেরিয়ে যায়।

জেএনইউ-র চারটি বাম-ছাত্রসংগঠন এসআইএফ, আইসা, ডিএসএফ ও এআইএসএফ-এর জোটপ্রার্থীর ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন সার্বিকভাবেই। সভাপতিপদে জিতেছেন এন সাই বালাজি, সহ-সভাপতিপদে সারিকা চৌধুরী, সম্পাদকপদে আইয়াজ আহমেদ রাইদুর, ও যুগ্ম-সম্পাদকপদে অমুথ জয়দীপ। জয়ের পরে নবনির্বাচিত সভাপতি এন সাই বালাজি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘এই জয় নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রতীকী জয়।’ বিষয়টির অন্যদিকও আছে।  মনে রাখা ভাল, এবিভিপি-প্রার্থীরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্ধেকের কম ভোট পেলেও, জেএনইউ-র মতো প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই প্রাপ্তিও মোটেই নগণ্য নয়। সেই পরাজয়ভাগটি থেকেও শিক্ষা নিতে হবে বামপন্থী ছাত্রদের।

আরও পড়ুন, বিজয় মালিয়ার প্রত্যর্পণে দেশ যেন বিলেতের উপনিবেশ

প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুরের ক্ষেত্রে আমরা চিরকাল প্রতিষ্ঠানবিরোধী ছাত্ররাজনীতির আলো দেখেছি। দুনিয়ার কোথাও ছাত্ররা কখনওই চলতি-হাওয়ার পন্থী হয়ে থাকে না। বিরোধিতাই তাদের চারিত্র্য। পশ্চিমবঙ্গই তার ব্যতিক্রম। বাম-ডান সব যুগেই ছাত্রযুবরা শাসকপরবশ। শাসকদলপুষ্ট ছাত্রপরিষদ রাজ্যের পঞ্চায়েতগুলির মতো অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ দখল করতে পারলেও, যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি কিন্তু থেকে গেছে সেই বিরোধিতায়। রাজ্যে ছাত্রসংসদগুলির লক্ষ্য যখন ছাত্রদের থেকে তোলাবাজিতেই সীমায়িত হয়েছে, তখন ওই-দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা বারবার নানা ছাত্রস্বার্থমুখী আন্দোলন সংগঠিত করছে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররাও সম্প্রতি সেই অটল-বিরোধিতা দেখিয়েছে। স্বভাবতই এইসব ছাত্রদের প্রতি তিতিবিরক্ত মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী। কানাহাইয়াদের পথ ছিল আরও-দুর্গম। তবু, জেল, নিগ্রহ ও আতঙ্কসঞ্চার করে যে দেশের যুবশক্তিকে দাবিয়ে রাখা যায় না, ফের তার প্রমাণ দিল জেএনইউ-র ছাত্ররা।

কিন্তু, সংলগ্ন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজয়ে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রপরিষদ। সেখানে গেরুয়াপন্থীরা পেয়েছে তিনটি পদ, ছাত্রপরিষদ একটি। এই ফলাফলও যেন প্রতীকী। জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে তুলনীয়। কংগ্রেসও যে আর একচ্ছত্র শক্তি নয়, জোটপন্থা শক্তিশালী করা ছাড়া তার কোনও উপায়ন্তর নেই, তা-ও যেন প্রতিভাত দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনী ফলে। অন্য-একটি প্রতীকও আছে এখানে। সভাপতি-পদপ্রার্থী অঙ্কিভ বৈশ্যর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি তামিলনাড়ুর তিরুভাল্লুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের জাল-শংসাপত্র দিয়ে ডিইউ-তে ভর্তি হয়েছিলেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও তা সরকারিভাবে জানিয়ে দিয়েছে। ফলে তাঁর মনোনয়নই বাতিল হওয়ার কথা। অঙ্কিভের এই জালিয়াতি তাঁর কেন্দ্রীয় নেতাদেরই পদাঙ্কিত। ডিইউ-র মতো প্রতিষ্ঠানে জাল-মানপত্রে ভর্তি হওয়া নিশ্চিতভাবেই প্রভাবশালীদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া সম্ভব হয়নি। দেশে দুর্নীতির সার্বিকতায়ও কংগ্রেস বা বামনেতাদের বিরুদ্ধে কোথাও এখনও এমন অভিযোগ ওঠেনি। বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দুর্নীতিগ্রস্ততার সমুদ্রে এই দৃষ্টান্ত হয়তো বিন্দুমাত্র। কিন্তু, এই ঘটনা থেকেও রামরাজত্বের স্বরূপটি বুঝে ওঠা কঠিন নয়।

JNU
Advertisment