জঙ্গলের সঙ্গে মানুষের সভ্যতার সম্পর্ক তার শুরু থেকে। কিংবা হয়তো বলা যায়, শুরুরও আগে থেকে। জল এবং অরণ্যের সম্পর্ক এমনই অঙ্গাঙ্গী যে এই দুইয়ের কাছাকাছিই নিশ্চয় মানুষ থাকতে আরম্ভ করে। খাবার সংগ্রহের জন্য তাকে নির্ভর করতে হয়েছে প্রথমাবধি অরণ্যেরই ওপর - ভয়ে হোক বা নির্ভয়ে। তাই হয়ত আরও পরে যখন মানুষ ভাষা ব্যবহার করতে শিখছে, তার সমস্ত প্রাচীন সাহিত্য অরণ্যের স্তবে, অরণ্যানীর প্রশংসায় ভরা।
বহু পরবর্তী কালেও, বাড়িঘর তৈরি হোক বা কৃষিকাজ, অরণ্যই মানুষের আদি নির্ভর। সমস্ত পুরোনো সমাজই বনকে দেখেছে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে, তা কেবল নিজেদের জীবনধারণের কারণেই নয়। পুরোনো দিনের মানুষরা যেহেতু প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করত অনেক বেশি, বনের মধ্যে ছোটবড় নানা প্রাণী ও গাছপালার মধ্যেকার সম্পর্ক তারা খুঁটিয়ে খেয়াল করেছে, অত্যন্ত জটিল অথচ মনে হয় যেন অতি সাবলীলভাবে ঘটে চলা সেই পারস্পরিক জীবনচক্র মানুষের প্রথম রহস্যবোধ বা ধর্মভাবনার আধার। বিজ্ঞানভাবনারও। দীর্ঘ মনোযোগী নিরীক্ষণের মধ্যে দিয়ে, মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দিয়ে, প্রাকৃতিক নিয়মকে বোঝবার নানারকম চেষ্টাই বিজ্ঞানভাবনার ভিত্তি।
আরও পড়ুন, জল মাটি: ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে
বহু পরবর্তীকালে বনের ওপর বিশ্বের নির্ভরতা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত প্রাচীন সমাজের লোকেরা নিজেদের মতো করে বনকে রক্ষা করার নিয়ম মেনে চলেছেন। পাইন এবং রেডউড গাছ ছিল আদি আমেরিকানদের কাছে পবিত্র। এদের কাটা যায় না। আফ্রিকার অনেক জাতির কাছে দীর্ঘজীবী মহাবৃক্ষ বাওবাবকে আঘাত করা সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশে অ্যামাজনের প্রাচীন জঙ্গল সেখানকার মানুষদের কাছে চিরকাল ছিল সর্বতোভাবে রক্ষণীয়।
আমাদের এই ভারতবর্ষে অরণ্যরক্ষার এক দীর্ঘ বিচিত্র সংস্কৃতি কমবেশি আজও আছে। সার্বিকভাবে যে পাঁচটি গাছকে আমাদের দেশে বনস্পতি বলা হয়, তাদের কাটার কেন, আঘাত করার কথা পনেরো বছর আগেও ভাবা যেত না। লক্ষ্য করার বিষয় যে নানা দেশেই এই ‘পবিত্র’ বলে রক্ষণীয় গাছগুলি কিন্তু মানুষের প্রতিদিনের কাজে লাগবার নয়। যেমন আমাদের বট, অশত্থ, নিম, বেল, ডুমুর। অথচ এই গাছদের ক্ষতি করার বিরুদ্ধে বারবার লোককে সতর্ক করা হয়ে এসেছে। বরং দেখা যায়, অন্যান্য প্রাণীদের, বিশেষত পাখি বা ছোট প্রাণীদের জীবনরক্ষায়, এই গাছগুলি জরুরি। গ্রীষ্মকালে যতদিন অন্য ফল থাকে না, মূলত এইসব গাছের ফলের ওপরই ওই ছোট প্রাণীরা অনেকাংশে নির্ভর করে।
এই ছোটবড় প্রাণীদের অস্তিত্বের সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষের জীবনও ঘনিষ্ঠভাবে জড়ানো। বিজ্ঞানে অনেক অগ্রসর হলেও এই সত্যের কোনো ব্যত্যয় নেই। বরং যত দিন গিয়েছে, বিজ্ঞান মানুষকে আরো বেশি করে শিখিয়েছে, বন কীভাবে এই গ্রহে মানুষের অস্তিত্বের নিয়ামক। যেভাবে ‘সভ্যতার বিস্তার’এর নামে ঘন বন ধ্বংস করা হচ্ছে, তাতে পৃথিবী অমোঘভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এক মৃত্যুবিস্তারের দিকে - একথা আজ আর কারো অজানা নেই। চল্লিশ বছর আগেকার মত আজ আর 'ভবিষ্যতের সম্ভাবনা'ও নেই তা। তবু অল্প কিছু শিক্ষিত মানুষ পৃথিবী জুড়ে তাণ্ডব নামিয়ে আনছে।
যে প্রাকৃতিক সম্পদের আশ্রয়ে অন্য সব প্রাণীর সঙ্গে মনুষ্য প্রজাতিও বেঁচে আছে, তাকে এমন উন্মত্ততায় ধ্বংস করার পেছনে কোন মনোবৃত্তি কাজ করে, বোঝা অসম্ভব। যখন নিঃশ্বাসের বাতাস কম পড়ছে, তাপ বাড়ছে হু হু করে, নদীর পর নদী শুকিয়ে যাচ্ছে আর সমুদ্রের জলতল বাড়ছে - তখনও অবিরাম মাটির তলার জল টেনে তুলে খরচ করে দেওয়া, নিজেদের খেয়ালখুশি মত নদীর সঙ্গে নদীকে জুড়ে দেওয়ার প্রকল্প, মানুষের বাস করার সহায়ক বায়ুস্তরের শেষ আশ্রয় ঘন বনগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে সেখান থেকে খনিজ তেল আর আকরিক তোলার ব্যবসা - এই অবিমৃশ্যকারিতার যুক্তি কী, একথা জানা তো পৃথিবীর সমস্ত মানুষের অধিকার।
আরও পড়ুন, জল মাটি: ছোট ছোট নদীগুলি
মাঝে মাঝেই সন্তর্পণে শোনানো হচ্ছে, "অরণ্যে আগুন লাগানো তো বরাবরই হয়েছে, মনে নেই খাণ্ডবদাহনের কথা?" যেন একটা অন্যায় কাজ সেরকম অন্য অনেক আরো ভয়ানক কাজের যুক্তি হতে পারে! ভয় হচ্ছে, কেউ যদি কোনোদিন কোনো বিশেষ জনগোষ্ঠীকে পীড়নের যুক্তি হিসেবে হিটলারের উদাহরণ দেন! তাছাড়া আমরা ভুলে যাই যে খাণ্ডবদাহনের ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে একটি। কিন্তু তার আগে-পরে হাজার বছর ধরে কোটি কোটি মানুষ কিন্তু তার বিপরীত সংস্কৃতি পালন করে এসেছেন।
ভারতের বিশনোই সম্প্রদায়ের মানুষদের গাছ রক্ষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার উদাহরণ আমাদের চট করে মনে পড়ে না। আদিবাসীদের কাছে অরণ্য দেবতা। সাঁওতাল, মুন্ডা, হো সহ অনেক জাতির কাছে ‘জাহের’ অর্থাৎ পবিত্র বন রক্ষণীয়, তার সব জীবজানোয়ার পশুপক্ষী সমেতই। আফ্রিকার অধিকাংশ রিজার্ভ ফরেস্টে পোচিং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ, কিন্তু আরণ্যগ্রামের মানুষরা বনে নিজেদের অভ্যাসমত খাদ্য, প্রয়োজনীয় সবকিছুই সংগ্রহ করতে পারেন। এমনকি শিকার করতেও। তাতে বন ধ্বংস হয় না কখনও। যে কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ ধংস হয়ে যায় বেহিসাব খরচে। বেহিসাবের মূল হল অতিরিক্ত লোভ। যা কিছু সকলের, তাকে দখল করার চেষ্টা।
হিমালয়ের প্রাচীন অরণ্যানী কেবল ভারতের জলবায়ু, ভূগোল, এমনকি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিয়ামক নয়, ভারতীয় সভ্যতারও ধারক। ভারতীয় বন বিভাগের আগুনলাগা ঠেকানোর কাজ যেমন বৈজ্ঞানিক, তেমন সফল। গত দশ বছরের মধ্যে দুবার সেই জঙ্গলে একই অঞ্চলে ভয়াবহ আগুন লাগল - ২০১২ আর ২০১৯-এ। প্রথমবার ঠিক তার পরেই নতুন করে সেখানে বিরাট চওড়া পাকা রাস্তা করা শুরু হয়। এর দরুন যে বিপুল এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়, তার জন্য কারো শাস্তি হয় না। এমনকি প্রশ্নও ওঠে না।
সাম্প্রতিক অ্যামাজনের ভয়ংকর আগুন মানুষের সভ্যতার ওপরে যে বিপদ নামিয়ে আনল, তা আমাদের কাছে হয়ত একটি সাময়িক, বৌদ্ধিক আলোচনার বিষয় হয়ে রইল, কিন্তু একে কী চোখে দেখছে সেই মানুষরা যারা এখন সদ্যতরুণ, যাদের ভবিষ্যত নিহিত রয়েছে ওইখানের উদ্গীরিত ধোঁয়া আর ধ্বংসে?
আরও পড়ুন, বজ্রপাতে মৃত্যু এড়াতে রাজ্যগুলির সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন কেন, কী বলছেন বিশেষজ্ঞ
এই প্রশ্ন থেকে আমাকে পালাতে দিচ্ছে না সদ্য হাতে আসা কয়েকটি ছবি। শিল্পীর বয়স ষোল। সেই বয়স, যাকে পৃথিবী মেনে নিয়েছিল সবচেয়ে মধুর স্বপ্ন দেখার বয়স বলে। আসানসোল শিল্পাঞ্চলে বসে এই ছবিগুলো এঁকেছে একাদশ ক্লাসের ছাত্রটি। দগ্ধ বিকৃত পাখি, গাছ, জঙ্গলের ছবির নিচে সে লিখেছে, ‘আমাজনের জন্য প্রার্থনা - আর কখনো জন্ম দিওনা এই অসহায়, যন্ত্রণাক্ত, নিষ্পাপ প্রাণীদের’। একটি কিশোরের মনের থেকে উঠে আসা এই তীব্র কষ্ট, অভিযোগ, ভয় - এর উত্তরে তাকে কী বলবে এই উন্নয়নশীল বড়দের পৃথিবী?
(জয়া মিত্র পরিবেশ আন্দোলনের সংগঠক, মতামত ব্যক্তিগত)