গাছ-লতা-গুল্ম-ঘাস নিয়ে যে বন, বারে বারে তাকে বলা হয় পৃথিবীর পোশাক। ভারতের বেদ-এ কতোবার কতো সুন্দর করে যে এই বর্ণনা করা হচ্ছে সে আমাদের ধরে ধরে দেখিয়ে দিয়েছেন আচার্যা গৌরী ধর্মপাল, তাঁর ‘বেদের কবিতা’তে। বেদ, বিশেষত প্রাচীনতম ঋগ্বেদ যে তথাকথিত ‘ধর্মগ্রন্থ’ নয়, মূলত সেটি অপূর্ব সব প্রকৃতি বন্দনা মূলক কবিতাগুচ্ছ, গৌরী দি-র ‘বেদের কবিতা’ আর শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী শুভেন্দু গুপ্তের ‘প্রাচীন ভারতে পরিবেশ চিন্তা’- এই বইদুটি ছাড়া সাধারণ বাঙালী পাঠক বোধহয় সে কথা স্পষ্ট করে জানতে পারতেন না। পৃথিবী আর বৃক্ষদলকে বন্দনা করে অসামান্য সব মন্ত্র চারটি বেদেই অনেক। ঋষি অথর্বার রচিত অথর্ববেদে দেখি যজ্ঞকুণ্ড খননের কালে পৃথিবীকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে- আমি একান্ত দৈব প্রয়োজনে তোমাকে খনন করছি। এই আঘাত যেন তোমার মর্মস্থলে না পৌঁছায়। সেই মন্ত্রেরই প্রতিধ্বনি যেন শুনতে পাই আজকের আধুনিক ভারতেও। উত্তরবাংলা সহ নানা পাহাড়ি অঞ্চলে দেখেছি গ্রীষ্মের শেষদিকে যখন চাষের কাজ শুরু হয়, পুরো গ্রাম চাষের জায়গায় বা কাছাকাছি জঙ্গলে গিয়ে দীর্ঘ প্রার্থনা জানিয়ে ভূমির অনুমতি ও আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। তাদের গান বা প্রার্থনার মূলকথা থাকে একটাই- হে মা, আমরা তোমার পোশাক একটু সরাচ্ছি। তুমি অসন্তুষ্ট হয়ো না, আমাদের খুব দরকার বলেই আমরা এমন করছি। কিছু কিছু জায়গায় এই প্রার্থনা জানানোর পর নারীপুরুষ মিলে হাতে করে চাষজমি থেকে অপ্রয়োজনীয় ঘাস-গুল্ম ছিঁড়ে ফেলেন, কোনো অস্ত্র বা যন্ত্র ব্যবহার করেন না। কীটনাশক ব্যবহারের বিপক্ষে রাচেল কারসনের দুনিয়া কাঁপানো সুবিখ্যাত বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ গাছপালাকে বলছে ‘আর্থ’স গ্রীন ম্যান্টল’, পৃথিবীর সবুজ চাদর। এই সবগুলোই নিছক কাব্য, সুন্দর করে বলার একটা ধরন- এমনটা আমার মনে হয় না।
ক্লাস ফোরে পড়া বাচ্চারাও এখন জানে যে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে নিজেদের খাদ্য আর পুষ্টি অন্য কোথাও থেকে জোগাড় করতে হয়, একমাত্র গাছই নিজে খাদ্য তৈরি করে, তার থেকেই বাকি বিশ্ব নানাভাবে খাবার পায়। এই সবুজ পোশাকটির সঙ্গে পৃথিবীর মাটির সম্পর্ক কিন্তু আরো অনেক গভীর ও বিচিত্র। আজ বিশ্বজোড়া সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা সেই সম্পর্কের অন্যদিকগুলোও দেখতে পাচ্ছি। গাছপালা মাটির কেবল আবরণমাত্র নয়, এরা মাটির শরীরের অচ্ছেদ্য অংশ। জীবদেহের যেমন চামড়া। ঘাসের অন্যতম প্রধান কাজ হল মাটিকে নিজের জায়গায় বেঁধে রাখা। জল ও বাতাসের নিরন্তর ঘর্ষণে পাথর থেকে মিহি মাটি তৈরি হয়। নানান আকরিক আর প্রাকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ সেই উর্বর মাটিতে জন্মানো ঘাস ও ঘাসের শিকড় মাটির ওপরের হালকা মিহি স্তরটিকে সযত্নে জড়িয়ে রাখে। এরপর জল বা বাতাসের ঘষায় তা আর স্থানচ্যুত হয় না বরং আরো আরো উদ্ভিদের জন্মঘর হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন, জয়া মিত্রের কলাম: জল মাটি (প্রথম পর্ব)
আকাশ থেকে নামা বৃষ্টিজল মাটির ওপর দিয়ে নিচদিকে গড়িয়ে যাওয়ার যে পথ তৈরি করে সেইসব পথই ছোটবড় নদী। নদীরা নিজেদের স্রোতে নিজেদের পথকে আরও গভীর করে কেটে নেয় ভূমিক্ষয় করে। তাই স্বাভাবিক অবস্থায় নদীতীর গুলি বেশির ভাগই থাকে ঘাসে ঢাকা।
শহরের মধ্যেকার জায়গা ছাড়া সর্বত্রই নদীর কিনারে ঘাসের ওপর বসে থাকা সাধারণ মানুষদের কাছে, তরুণ-বয়স্ক নির্বিশেষে একটা খুবই পরিচিত ব্যাপার ছিল। লোকেরা শোকে, আনন্দে, নিজের ভাবনায় মগ্ন কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগাছায় নদীর ধারে যেতেন। গ্রামের দিকে মেয়েরা, গৃহিণীরা, বাচ্চারা দিনের বিভিন্ন সময়ে নদীর পাড়ের ঘাস কিংবা বড়ো ছায়াফেলা গাছকে নিজেদের দৈনন্দিনের অংশ হিসাবে ব্যবহার করতেন।
পাহাড়ের ঢালে বা সমতলে ভূমিক্ষয় আটকানো ছাড়া গাছ আরেকটা বড় কাজ করে- জোর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো সরাসরি মাটির ওপর পড়লে মাটির উপরিতল, খুব ছোট ছোট করে হলেও, ভেঙে যায়। এই ভেঙে আলগা হয়ে থাকা মাটি সহজেই স্থানচ্যুত হয়। কিন্তু ঘাস এই সরাসরি জলের ফোঁটার আঘাত থেকে মাটিকে বাঁচায়। বড় গাছও করে তাই- জোর বৃষ্টির সময়ে জল গাছের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, মাটি ভাঙে না। বরং ওই জল, ধীরে ধীরে নামার দরুন, মাটির ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। এই ভাবে জঙ্গল ভূতলস্থ জলের ভান্ডার ভরে দেবার কাজ করে। বড় গাছ তার নিচেকার ঝোপঝাড়ে ভরা পুরোনো জঙ্গলে বছরের পর বছর যে ঝরা পাতা, শুকনো ভাঙা ছোট ডাল, মৃত পাখি পোকামাকড়ের দেহ জমা হয়, দীর্ঘকাল ধরে পচে পচে সেগুলো একটা মোটা লেপের মত পুরু আস্তরণ তৈরি করে, যাকে বলে হিউমাস। বৃষ্টিকাল শেষ হয়ে যাবার পরও এই হিউমাসের মধ্যে অনেকখানি জল জমা থাকে যা চুঁইয়ে মাটির নিচে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বছরের অন্য সময়ও বনের আশপাশ অঞ্চলে জলের প্রবাহ বজায় রাখে। বনের আশপাশ এলাকায় যেসব ছোট নদী বা জলাশয় থাকে, হিউমাসের জল সারাবছর চুঁইয়ে সেগুলিতে গড়িয়ে যায়, তাই এইসব জলের জায়গা গুলো শুকোয়না। উপরন্তু বনের যে নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিমণ্ডল, যাকে আমরা ইকোলজি বলি, তা প্রতিদিন এইসব সম্পদের পরিমাণ আর বৈচিত্র বাড়িয়ে চলে। তাতে কেবল বন্যপ্রাণী বা জল উৎসগুলির সুবিধা হয় তাই নয়, বাতাস সুন্দর স্নিগ্ধ আর টাটকা থাকে। বনের কাছাকাছি অঞ্চলের মানুষদের খাবারে অনেক সুস্বাদ ও পুষ্টিকর জিনিস যুক্ত হয় যেগুলো বাইরে টাকা দিয় কিনতে পারা যায় না। নব্বইয়ের দশকে কেরালার দরিদ্র আদিবাসী গোষ্ঠীর মেয়ে জানু বলেছিলেন, ‘জঙ্গল আমাদের মায়ের থেকেও বেশি। জঙ্গলে যতক্ষণ থাকি, খিদে কী, তা আমরা বুঝতে পারি না’। আমলাশোলে না-খেয়ে মারা যাওয়া শবরদের স্বজনেরা বলেছিলেন তাঁরা দিনের পর দিন না-খেয়ে থাকতে বাধ্য হতেন কারণ জঙ্গলে ঢোকা বারণ হয়ে গিয়েছিল। পাকা রাস্তা, বড় বাড়ি এধরণের জিনিস নিশ্চয়ই দরকারি, কিন্তু তার চেয়েও তো বেশি দরকারি পরিষ্কার নিঃশ্বাসের বাতাস, সুন্দর মিষ্টি জল আর টাটকা সুস্বাদ সাধারণ খাবার। সবচেয়ে বেশি জরুরি হল পৃথিবীর মাটি- মানুষ আর জীবজগতের এই পরম আশ্রয়, কোটি কোটি বছর ধরে নানা শৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে এ মাটি যেমনটি তৈরি হয়েছে, তাকে রক্ষা করা। চাষের ক্ষেতে, নদী-পুকুরের জলে, বনতলে, নানারকম রাসায়নিক মিশে মাটির বুনিয়াদি গঠনকে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না করে, সেই সুরক্ষার দিকে অ-মনোযোগী হওয়ার অর্থ নিজেদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবনের প্রতি অমনোযোগী হওয়া।
আরও পড়ুন, চলছে চলবে: আমাদের ওপর ভরসা হারাচ্ছে আমাদের সন্তানরা
বন বলতে যদিও আমাদের সাধারণভাবে মনে হয় বড় বড় গাছের ছাওয়া অনেকখানি ছড়ানো জায়গা, গ্রামের বা জনপদের বা ক্ষেতের কাছাকাছি ছাড়া ঝোপজঙ্গলও কিন্তু একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। আগে এইসব ঝোপঝাড়েও অনেকরকম বুনো ফুলফল হত, নানা পাখি ছোট প্রাণী পোকামাকড় থাকত। গ্রামের বা ছোট শহরের পাড়ার বাচ্চারা জানত যে ওইসব গাছপালায় কবে কি পাওয়া যায়। আজকাল সকলেই সারাদিনরাত এত ব্যস্ত থাকে যে ছোটরাও আর এই গাছের ঝোপ, পাখি, পোকা চেনে না। বড়রাও মনে রাখেন না, বাচ্চাকে প্রকৃতির সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দেবার কাজ তাঁদেরই। একটা গাছকে প্রথম দেখা, প্রতিদিনের সূর্যের আলো, একটা ফড়িঙের স্বচ্ছ চকচকে ডানা কিংবা একটা বীজ থেকে বীজপত্র বের হওয়া – এই প্রতিটি আপাততুচ্ছ বস্তুর মধ্যে আসলে যে বিপুল রহস্য আছে, তাকে দেখার শিক্ষাই একজন মানুষের জীবনে প্রথম সবচেয়ে দরকারি শিক্ষা। ওই ঘটনাগুলির মধ্যে সেই ‘বিশ্বনাচের ছন্দ’ লুকিয়ে আছে, যা না থাকলে জীবনের সব অর্থকরী শিক্ষাই নিষ্ফলা শুকনো হয়ে থাকবে। বিশ্বের প্রতিটি ঘটনার মধ্যেকার যোগসূত্র নিহিত আছে, তাকে সে সারাজীবনেও আর বুঝতে পারবে না।
একা জীবনের ভারকে কোনো উপকরণ দিয়ে ভরে তোলা যায় না, এই সত্য সে মানুষের কাছে অধরা রয়ে যাবে যে তার চারিপাশে বিস্তৃত হয়ে থাকা প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্যকে দেখতে শেখে নি।