বেলা দুটোয় বৃষ্টি নামল। ভারি আনন্দ হল। মানে বেশ শান্তি হল বলা যায়।
আজ ঘুম ভেঙেছিল সূর্য ওঠার একটু আগেই। জানলা দিয়ে সোজা যে একচিলতে আকাশ দেখা যায় সেখানে দেখি স্তরে স্তরে শাদা মেঘের টুকরো সাজানো। কিন্তু, জানি যে নীল আকাশে এই শাদামেঘ ঠিক শরতের নকশা নয়, বহুবছর ধরে জানতে শিখেছি যে ওই মেঘ হল বৃষ্টির পূর্বাভাস। ‘কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা/আজ না হলে হবে কাল/ যারে চাষা ধর গা হাল’ এ যে কতোদিন ধরে চলে আসা সংকেতবাণী, কে জানে। প্রথম লাইনদুটিই যথেষ্ট ছিল বৃষ্টিবাচনের পক্ষে কিন্তু তৃতীয় লাইন স্পষ্ট বলে দিল যে এ কোনো নিছক পূর্বাভাস নয়, কাদের জন্য এই জানাটা জরুরি।
একটি কৃষিসংস্কৃতির দেশের পক্ষে অবশ্যই বছরের এই দুটি সময়- ফসল বোনা আর ফসল তোলা, অতি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিজীবী মানুষদের কাছে। তাই কচি চারা তুলে বসানোর কালে খুব দরকারি বৃষ্টির খবর জানা। মুখে মুখে একে লোকে বলে ‘খনার বচন’। কে যে খনা, কেনই বা তিনি এমন বিশুদ্ধ লৌকিক বাংলায় বাংলার কৃষি বিষয়ে এমন আশ্চর্য সব কথা বলে যাবেন, কোনো ধারণাই নেই আমার। ধারণা করাই তো মুশকিল। হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল! জনশ্রুতিমত বরাহমিহিরের কোনো পুত্রবধূ, ছিন্নজিহ্বা কোনো নারী যদি এসেও থাকেন এই ধান্যদেশে, কী করে তিনি জানবেন প্রথমত এখানকার লৌকিক ভাষা, দ্বিতীয়ত, এখানকার স্থানীয় কৃষিপদ্ধতি! কেবল তো বহুশ্রুত ‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ/ পুণ্য রাজা ধন্য দেশ’ ধরণের বৃষ্টিশাস্ত্রই নয়, চাষের আরো খুঁটিনাটি শুনতে পাই এই সব ‘বচনে’- ‘ষোলচাষে মূলা তার অর্ধেকে তুলা/ তার অর্ধেকে ধান/বিনাচাষে পান’- খাঁটি বাংলা চাষের নিয়ম এমন ‘লোকাল’ ভাঁজফেলা বাংলা ভাষায় কে বা কারা সংকলন করে রেখেছিলেন- এ এক রহস্য।
শুধু বাংলাতেই নয়, ভদলি পুরাণ বা বদলি পুরাণ, অর্থাৎ কি না বাদল-পুরাণ প্রচলিত আছে বিহারে, গুজরাটের রাজস্থানের কিছু অঞ্চলেও। বেশিরভাগ লোক ভুলে গেছেন, কিন্তু কিছু কিছু ‘পিছিয়ে থাকা’ গ্রামে কিছু বয়স্কদের মুখে হয়ত এখনো বেঁচে আছে তা। চাষের দেশে কতোখানি দরকারি যে এই মেঘবৃষ্টির শাস্ত্র জানা তার আরেকটা আশ্চর্য উদাহরণ দেখেছিলাম। একাদশ শতাব্দীর একটা সংস্কৃত বই, তার নাম ‘কৃষি পরাশর’ বা ‘পরাশর সংহিতা’। ছোট বইখানা পুরোটাই কেবল ধান্যকৃষি সম্পর্কে লেখা। ঠিক রচনা বলা নাও যেতে পারে কারণ সংহিতা অর্থ তো আদর্শ বিধি-সংকলন। মানে, যা আছে বা ছিল সে সম্পর্কেই কিছুটা গুছিয়ে বলা। তো সেই কমপক্ষে নয়শো বছরের পুরোন বইয়ে ধানচাষের বিধি বলা আছে বটে কিন্তু, মনে হয়, এম এ ক্লাসের ছাত্রীকে কোনো শিক্ষক যেমন বর্ণপরিচয় পড়াবেন না, ঠিক তেমনই ও বইয়ে ধানচাষ কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা নেই। বরং অনেকটা অংশ ধরে বিস্তারে বলা আছে মেঘ চিনবার কথা- কোন মেঘে কী ধরণের বৃষ্টিপাত হতে পারে, সেই শিক্ষাটি দেওয়া হচ্ছে ।
এ দেশের জল-মাটি-সূর্যতাপ উদ্ভিদপ্রাচুর্যেরই সবচেয়ে অনুকূল। বিশাল আর অতি বৈচিত্রপূর্ণ ভূ-ভাগ ঠিক ততোটাই বৈচিত্রময় কৃষিজ্ঞানের লীলাস্থল। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস ২০১২ সালে বলেন ভারতবর্ষে চাষের ইতিহাস প্রায় দশ হাজার বছরের পুরাতন। জানতে এত ইচ্ছে করে নাগার্জুন কোন্ডার নব্যপ্রস্তর যুগ থেকে মধ্যপ্রদেশের ভীমবেঠকা কিংবা উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর হয়ে কীভাবে, কোন কৃষিপথ ধরে সেই ইতিহাস এগিয়েছে!
কোথায় আমাদের এই সভ্যতার শিকড়, দীর্ঘ দীর্ঘ পথে কিভাবে নিজেদের চারপাশে বিস্তৃত প্রকৃতিকে ব্যাখা করার সূত্র আবিষ্কার করেছিল সেই কালের মানুষ? কী ভাবে নির্দিষ্ট হয়েছিল প্রাকৃতিক সূত্র অনুযায়ী এতগুলি উপাদানকে নিজেদের প্রয়োজনমত ব্যবহারের রীতিনীতি? কতো বিচিত্রভাবে সেই নিরীক্ষণ> পরীক্ষা করে দেখা> ব্যাখা করার চেষ্টা> সূত্র তৈরি করে প্রয়োগ করা? কতো পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এসেছিল সেই ইতিহাস? যারা এই সবকিছু করছিলেন, তাঁদেরও তো ছিল নিজস্ব কিছু শিক্ষা আর প্রয়োগপদ্ধতি? প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠার সেই তো আদি উপাখ্যান। এমনকি পাঁচ হাজার বছরের পথচিহ্ন? খুব অল্প কিছু কিছু তো রয়ে গেছে বেদে, জাতকে, প্রাচীন নানা গল্পকথায় এমনকী। তার আগের? পাথরের টুকরো থেকে যখন ধিরে ধীরে কাঠের লাঙল তৈরি হল? ব্রীহি থেকে যখন তৈরি হয়ে উঠল অজস্র রকমের ধান্যবীজ? ডাল? যবকে বলা হচ্ছে প্রাচীনতম অন্ন। সে কী এইজন্য যে যব বেঁচে থাকে সবচেয়ে অ-বন্ধু পরিবেশেও, সবচেয়ে কম জল, চাষ, ঊষরতাতেও? এ দেশের প্রাচীনতম যে পঞ্চশস্যের কথা বলা হয়, ধান তো নেই তাতে- যব, তিল, মুগ, মাষকলাই, শাদা সর্ষে। আবার, এর মধ্যে কোনো একটি না থাকলে পুজো-পাশায় তার জায়গায় ওই শাদা সর্ষে দিয়ে নিলেও চলবে। শাদা সর্ষের অন্য নাম না কি সিদ্ধার্থ! কোন সময়ের প্রথা এসব? কী ছিল শাদা সর্ষের বিশেষত্ব? এইসব বাদলি-পুরাণ, খনার বচন, ডাক- এরা কি সেই হারিয়ে ফেলা পথের কোনো ছোট ছোট চিহ্ন? কে বলে দেবে? হয়ত কোনো না কোনো লাইব্রেরি কি বিশ্ববিদ্যাভবনে রাখা আছে কোনো উত্তর কিন্তু আমায় তা বলে দেবে কে? আমাদের যে বড্ডো দরকার ছিল সেই কথাটাই জানা যেখানে এই বিক্ষত পৃথিবী আর ওই ঝকঝকে আকাশ এখনো নিজেদের ভাষায় কথা বলে। কিছু অর্থউন্মাদ মানুষ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে আমাজনের অরণ্য। মাত্র দুশো বছরে তাদের শাস্ত্র ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে পৃথিবীর মুখ। অথচ কোন নাম-না-জানা সংকেত আজও নিজের বিজ্ঞানবচনে অভ্রান্ত- কোদালে কুড়ুলে মেঘের গা...
আমাদের পড়তে শিখিয়ে দাও। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে চলো।