স্বাস্থ্য নিয়ে যখন আমরা কথাবার্তা বলি, তখন আমরা সাধারণত শরীর নিয়েই কথা বলি। শরীর বলতে হাত-পা, হৃদপিণ্ড, যকৃৎ, বৃক্ক, রক্ত, অস্থি, নাক-কান-গলা সবকিছু। বাদ যায় মাথার খুলির ভেতরটা। না, ঘিলুর দু'একটা সমস্যা আজকাল শরীরের সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত, যেমন স্ট্রোক ইত্যাদি। কিন্তু "মন" থেকে যায় হিসেবের বাইরে। যাঁরা মনের রোগে কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁদের কেউ হয়ত আমাদের শরীরকেন্দ্রিকতা দেখে হতাশ হয়ে প্রশ্ন করতে পারেন, "শুধু শরীর? তোমার মন নাই?"
স্বাস্থ্যের আলোচনায় মন অবহেলিত থেকে যাবার অন্যতম কারণ হল এই যে আমরা মনকে শরীরের অংশ ভাবি না। প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ভিত্তিতে মনকে শরীরের থেকে আলাদা ভাবা মানুষের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া শরীর তো সব প্রাণীর, এমনকি উদ্ভিদ ও জীবাণুরও আছে। মানুষ গর্বিত নিজেদের মেধা ও মনের জন্য। "মন" হল সেই অদ্ভুত ব্যাপার, যা মানুষকে অন্য সবার থেকে আলাদা করেছে। সুতরাং মনকে কখনওই শরীরের মতো 'সাধারণ' করে দেওয়া যাবে না। এই ব্যাপারে শিল্প-সাহিত্য-চারুকলা বা সমাজতত্ত্ব-দর্শন জাতীয় বিশিষ্ট বৌদ্ধিক চর্চার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের অনেকে একটু বেশি স্পর্শকাতর এবং মনকে কবিতার জগতে, শিল্পের জগতে সিংহাসনে সুস্থিত রাখার প্রচেষ্টায় এঁরা অনেকেই শরীরের মতো করে মনের চিকিৎসা করার বিরোধিতা করে এসেছেন। সেটা ভালো হয়েছে না খারাপ, সেই বিষয়ে শেষ কথা বলে দেবার যোগ্যতা আমার নেই। এই ক্ষেত্রে যে দীর্ঘ টানাপোড়েন চলেছে, তার ইতিহাসও আজকের পরিসরে বিবৃত করা সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন, জল মাটি: ছোটনদীর বড় কথা
এমনকি চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যেও শরীর-মনকে আলাদা ভাবার প্রবণতা মজ্জাগত। হিপোক্রেটাসের প্রাচীন লেখায় স্পষ্ট দেখা যায় যে তিনি দুটিকে ভিন্ন রাজ্য ভাবছেন। বহু পরবর্তী কালে রেনে দেকার্তের কাজে দেখা যায় ভাবনাটিকে সংহত করার চেষ্টা। এই দুই ভিন্ন রাজ্যের মধ্যে কোথাও নিশ্চয় যোগাযোগ হয়। কোথায়? তিনি ধরে নিলেন মস্তিষ্ক সংলগ্ন পিনিয়াল গ্রন্থিতে এদের দেখাশোনা বৈঠক হয়। অর্থাৎ দেহ ও মন ভিন্ন, এই প্রতীতির সঙ্গেই ছিল এই বোধ যে এদের মধ্যে যোগাযোগ আছে।
বাস্তবে একথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের যেমন অ্যানাটমিকাল (ভৌগোলিক) মানচিত্র এঁকে প্রত্যেকের অবস্থান অক্ষাংশ দ্রাঘিমা সহ চিহ্নিত করা সম্ভব, মনের ক্ষেত্রে তেমনটা হতে পারে না। বস্তুত মন কোনো 'বস্তু' নয়, বরং এক বোধগ্রাহ্য ঘটমানতা (ফেনোমেনন)। স্বভাবতই তাকে শরীরের অংশ ভাবা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। তাহলে দেহের উষ্ণতাকে আমরা কী বলব? সেও তো এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অবস্থামাত্র, তবু তাকে আমরা শারীরিক মনে করি। উষ্ণতা তো তাও অন্য মানুষ ছুঁয়ে টের পাবে, কিন্তু যন্ত্রণা/ ব্যথা? যন্ত্রণার অনুভূতি যার হচ্ছে, সে ছাড়া আর কেউ তা সরাসরি অনুভব করতে পারবে না। বড়জোর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষটির কথা শুনে, তাঁর মুখভঙ্গি দেখে এবং যন্ত্রণা সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করতে পারি আমরা। তবু একে আমরা একটা শারীরিক ব্যাপার বলেই মানি, যদিও শারীরিক যন্ত্রণা আদতে একটা স্নায়বিক অনুভূতি মাত্র। অ্যানেস্থেশিয়ার সময় অজ্ঞান করে দিলেই আর ব্যথার অনুভূতি থাকে না, রোগ বা আঘাতের ক্ষত যথাস্থানে থাকা সত্ত্বেও। আবার "ফ্যান্টম লিম্ব"-এর যন্ত্রণার ক্ষেত্রে কষ্ট অনুভূত হয় সেই হাত বা পায়ে, যা আর শরীরে নেই, হয়ত ছ'মাস আগে কাটা পড়েছে।
এসব ব্যাখ্যা সত্ত্বেও আমরা মানি এবং মানব যে ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চুলকানি, জ্বালা-যন্ত্রণা, শীত জাতীয় শারীরিক অনুভূতির থেকে ক্রোধ, দুশ্চিন্তা, প্রেম, বিরহ, দুঃখ, আনন্দ জাতীয় মানসিক অনুভূতিগুলো আলাদা ধরণের। যদিও প্রেমের সঙ্গে জড়িত থাকে যৌনতা এবং যৌন অনুভূতি একইসঙ্গে শারীরিক এবং মানসিক। উত্তেজনায় বা ক্রোধে হাত-পা কাঁপতে থাকে, পালসের গতি বেড়ে যায়, বেড়ে যায় রক্তচাপও। বিমর্ষচিত্তে শরীরও দুর্বল মনে হয়। একথা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত যে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা অবসাদে (ডিপ্রেশনে) ভুগছেন, তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা (ইমিউনিটি) কমে যায় এবং বেশ কিছু হরমোনের তারতম্য সৃষ্টি হয়। এতে বোঝা যায় যে শারীরিক অনুভূতিগুলো যেমন মানসিক স্তরেই অনুভূত হয়, তেমনই মানসিক অনুভূতিগুলোও স্পষ্ট শারীরিক ছাপ রেখে যায়। দেহ এবং মন যদি ভিন্ন হয়, তবু তারা পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। খারাপ শরীর নিয়ে মন ভালো থাকা অথবা গভীর অবসাদ বা ঘোর দুশ্চিন্তার মুহূর্তে শরীরে ভালো অনুভূতি হওয়া খুবই কঠিন।
আরও পড়ুন, সংকটে অর্থনীতি, পরিত্রাতা আছেন কেউ?
মানুষের ভালো থাকার জন্যে দেহের এবং মনের ভালো থাকা আবশ্যক। তাছাড়া মানুষের জীবন যেহেতু সমাজ-জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোতো, তাই সামাজিকভাবে ভালো থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ। বেকারত্ব, সামাজিক অসাম্য বা দাঙ্গার কারণে যাঁর খারাপ থাকা, তাঁকে শুধু ওষুধ খাইয়ে সুস্থ করতে চাইলে ভুল চাওয়া হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই সবকিছুর গুরুত্ব স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞায়। "Health is a state of complete physical, mental and social well being and not merely the absence of disease or infirmity." এই বাক্যটুকুর মধ্যে আছে স্বাস্থ্য বিষয়ে সামগ্রিক ও মূল্যবান বোধের নির্যাস। স্বাস্থ্যের আলোচনায়, অতএব, মানসিক স্বাস্থ্যের আলোচনা আবশ্যক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত সংজ্ঞাটি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, মানসিক স্বাস্থ্য মানে শুধুমাত্র স্কিৎজোফ্রেনিয়া, ডিপ্রেশন বা তীব্র ও চিকিৎসাযোগ্য কোনো রোগের অনুপস্থিতিই নয়, সামগ্রিকভাবে মানসিক ভালো থাকাকে বোঝায়। এই পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি রোগের কিছু বিশিষ্ট লক্ষ্মণ চিহ্নিত থাকার পাশাপাশি কষ্ট কতটা তীব্র হলে এবং কাজকর্মে কতটা সমস্যা সৃষ্টি করলে তাকে রোগ হিসেবে ঘোষণা করা যাবে, তার কিছু নির্দিষ্ট বিধি আছে, যাকে বলা হয় "ডায়াগ্নোস্টিক ক্রাইটেরিয়া"। এই বিধি মেনে সব কষ্টকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না। বাস্তবে ওষুধপত্রের অতিরিক্ত ব্যবহার ঠেকাতে এবং অন্য বিভিন্ন আর্থিক (যেমন ইনশিওরেন্স) ও প্রশাসনিক (যেমন ছুটি, অবসর থেকে শুরু করে বন্দীত্ব বা শাস্তিযোগ্যতা পর্যন্ত) কারণে এই জাতীয় বিধিবদ্ধতা জরুরি। এই কারণেই এই বিধিগুলো কিছু মাত্রায় অনমনীয় (সম্পূর্ণ অনমনীয় নয় যদিও) এবং তার ফলে অনেক কষ্ট, চাপ বা সমস্যা রোগ ও চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায়। রোগের মর্যাদা না পেলেও তারা কিন্তু মানুষের জীবনে যথেষ্ট ক্লেশ ও সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ রোগ না থাকা আর সুস্বাস্থ্য বজায় থাকা আলাদা। তাছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিবাচক স্বাস্থ্যের (Positive Health) এর ওপর জোর দিয়েছেন। অসুখ না থাকলেও ভালো থাকার ব্যাপারে নিরন্তর সচেষ্ট হতে বলা হচ্ছে।
মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে বজায় রাখা যায়? অসুখই বা হয় কীভাবে? এসব বোঝার মডেলটি হল 'বায়ো-সাইকো-সোশাল', অর্থাৎ জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং সমাজতত্ত্ব…. তিনটিরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। জিন থেকে শুরু করে স্নায়ুর গঠন, সমন্বয়, রাসায়নিক বিক্রিয়ার ওঠা-পড়া যেমন মানসিক সুস্থিতি বা অসুস্থতার কারণ হতে পারে, তেমনি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন দর্শনও আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে। জীবনের নানা উত্থান-পতন ঘাত-প্রতিঘাত সামলানোর কোন পদ্ধতি আমরা শিখেছি, কীভাবে ঘটনাগুলোকে, দুনিয়াকে, ভবিষ্যৎকে, অপরকে এবং নিজেকে দেখি, তা অনেকাংশে প্রভাবিত করে আমাদের ভালো বা খারাপ থাকাকে। তেমনই প্রভাব ফেলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও। এই সবকিছু মিলেই মানসিক স্বাস্থ্য বা অসুস্থতা।
এবার একটু ভেবে দেখুন, শরীরের সুস্থতার শর্তগুলো কি আলাদা আদৌ? জৈবরাসায়নিক পরিস্থিতির পাশাপাশি আমাদের জীবনাযাত্রা ও মনোভাব এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা মিলে নির্ধারণ করে আমাদের দেহের ভালোমন্দ। চিকিৎসা বিজ্ঞান আসলে ভৌতবিজ্ঞান, রসায়ন, জীবনবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব আর অর্থনীতির মেলবন্ধন। দেহ আর মন নিয়ে যে মানুষ, তার ভালো থাকার জন্য সুস্থ জিন থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়বিচার… এক বিপুল অর্কেস্ট্রার সুসমঞ্জস সঙ্গত প্রয়োজন।
এই কলামের সব লেখা একত্রে পড়ার জন্য ক্লিক করুন এই লিংকে