ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এন এম সি) বিলের ৩২ নং ধারার সৌজন্যে আবার শহুরে আলোচনায় প্রাসঙ্গিকতা পেয়েছেন গ্রামীণ চিকিৎসকেরা। সাধারণত 'হাতুড়ে চিকিৎসক' নামে অভিহিত এই বিধিবদ্ধ প্রশিক্ষণহীন চিকিৎসককুল অবশ্য প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চিরকালই প্রাসঙ্গিক ছিলেন। ভুল বললাম। শুধু গ্রামাঞ্চলেই নয়, ভারতের বিভিন্ন নগরাঞ্চলেও এঁদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। খাস দিল্লি শহরে এঁরা 'বাঙ্গালি ডক্টর' নামে পরিচিত এবং রীতিমতো কর্মব্যস্ত। কেউ কেউ নামের পাশে কাল্পনিক ডিগ্রি লিখে প্র্যাকটিস জমান (শহরাঞ্চলে পাশ করা চিকিৎসকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে এই প্রবণতা বেশি), কেউ বা সৎভাবে 'গ্রামীণ চিকিৎসক' লিখে রাখেন প্যাডে। এঁদের প্রশিক্ষণ, বাণিজ্যিক সততা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও গ্রামীণ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থায় এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এঁদের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে ভাবাও তাই আবশ্যক।
এন এম সি বিলের কারণে বিতর্ক তৈরি হয়েছে 'আয়ুষ' চিকিৎসকদের ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়েও। এঁরা কিন্তু সকলে পাশ না করা গ্রামীণ চিকিৎসক নন, বরং আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি পদ্ধতির চিকিৎসায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অতি সংক্ষিপ্ত ব্রিজ কোর্স করিয়ে এঁদের দিয়ে অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা করানোর সরকারি সিদ্ধান্তটি অবশ্যই সমস্যাজনক। গ্রামীণ চিকিৎসক এবং আয়ুষ চিকিৎসকদের ভূমিকা এই এনএমসি বিলের আগেও আলাদা ছিল, তাই তাঁদের দুই দলকে এক করে না ফেলে তাঁদের নিয়ে পৃথকভাবে আলোচনা করা উচিত। আজ শুধু প্রথম দলের কথা।
আরও পড়ুন, জয়া মিত্রের কলাম: জল মাটি (প্রথম পর্ব)
স্বীকৃত কলেজে প্রশিক্ষণ না পাওয়া পসার সম্পন্ন চিকিৎসক সব 'প্যাথি'তেই আছেন। নিজে নিজে বই পড়ে শেখা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক সর্বত্র দেখা যায়। আয়ুর্বেদিক ওষুধের ভাণ্ডার নিয়ে অনেকে রেল প্ল্যাটফর্মের অস্থায়ী দোকান থেকে সদর বাজারের জমজমাট দোকান অনেককিছুই চালান, আয়ুর্বেদের ডিগ্রি ছাড়াই। এঁদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হলেও আজ মূলত সেই গ্রামীণ চিকিৎসকদের ('হাতুড়ে' শব্দটি অসম্মানজনক, তাই ব্যবহার করব না) নিয়ে কথা বলব, যাঁরা তথাকথিত 'মডার্ন মেডিসিন' (ভাষান্তরে 'অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিন') প্র্যাকটিস করেন। আধুনিক চিকিৎসার সব নীতি এঁদের পক্ষে জানা বা মানা সম্ভব না হলেও এঁদের ব্যবহৃত ওষুধগুলি অ্যালোপ্যাথিক।
প্রশ্ন হল, ন্যূনতম প্রশিক্ষণ ছাড়া এঁরা কি সঠিকভাবে আধুনিক চিকিৎসা করতে সক্ষম, যেখানে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান প্রতিদিন জটিলতর হচ্ছে এবং অগুন্তি গবেষণাপত্রের তোড়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের জ্ঞান ও ধ্যান-ধারণাও ভেসে যায় বছর বছর? প্রশ্নে 'সঠিক' শব্দটা জুড়ে দেবার ফলে সহজ উত্তর হল, "না"। এই শব্দটিকে বাদ দিলে উত্তর এত সহজ হত না, কারণ জ্বর-জারি, ব্যথা-বেদনা, পেট খারাপের কাজ চালানো লক্ষণভিত্তিক (symptomatic) চিকিৎসা এঁরা অনেকেই করে দেন। যেহেতু অনেক রোগ নিজে থেকেই কিছুদিন পর সারে (auto control), তাই রোগজনিত কষ্ট খানিক চাপা দিতে পারলেই কাজ চলে যায়। কিন্তু কিছু রোগের চরিত্র অন্যরকম। সেগুলো সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিহ্নিত না করতে পারলে অচিরেই জটিল আকার ধারণ করতে পারে। চিকিৎসকের প্রশিক্ষণের অভাব সেক্ষেত্রে সমস্যাজনক হতে পারে। কোন রোগ আদতে জটিল চরিত্রের তা যেহেতু রোগীর পক্ষে আগে থেকে বোঝা কঠিন, তাই তাঁর পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন কোন রোগের জন্য তিনি গ্রামীণ চিকিৎসকের কাছে যাবেন আর কখন পাশ করা ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন।
তথাকথিত পাশ করা ডাক্তারেরাও সকলে সব রোগের চিকিৎসা করেন না। গ্রামীণ চিকিৎসকদের মতোই তাঁদেরও শিক্ষার সীমাবদ্ধতা আছে এবং প্রয়োজনানুসারে তাঁরা রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করেন, কিন্তু কোন রোগটির চরিত্র কীরকম, তা শুরুতে আন্দাজ করার (শতকরা একশ ভাগ সঠিকভাবে না হলেও) প্রশিক্ষণ তাঁদের থাকে। ওষুধের গুণ এবং প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধেও প্রশিক্ষণ থাকে। ফলে অপচিকিৎসায় রোগ জটিল হবার সম্ভাবনা তুলনায় কম থাকে। তাহলে সব রোগের ক্ষেত্রেই রোগীরা কেন প্রথমেই প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের কাছে যাবেন না? না যাবার অন্যতম বড় কারণ বিভিন্ন এলাকায় উপযুক্ত চিকিৎসক এবং পরিকাঠামোর অভাব। সরকারি বা বেসরকারি কোনো ব্যবস্থাতেই গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট চিকিৎসক বা হাসপাতাল নেই। অথচ গ্রামের যেকোনো বুদ্ধিমান বেকার যুবক-যুবতীর পক্ষে কাজ চালানোর মতো ওষুধপত্রের নাম ও ডোজ, ইঞ্জেকশন ও স্যালাইন দেওয়া ইত্যাদি শিখে নিয়ে স্থানীয়ভাবে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব। কোনো চিকিৎসকের কাছে বা মফস্বলের নার্সিং হোমে কিছুদিন সহকারীর কাজ করে অনেকে হাত পাকান। গ্রামের কেউ শহরে গিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে দেখিয়ে এলে এঁরা নজর করেন কোন উপসর্গে (রোগে নয়, উপসর্গে) কোন ওষুধ দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তীকালে সেরকম সমস্যায় সেই ওষুধ প্রয়োগ করেন। যেহেতু একাধিক রোগের ফলে একই উপসর্গ হতে পারে, তাই কিছু ক্ষেত্রে রোগ বুঝতে না পারার কারণে ভুল হয়ে যায়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে রোগী আরামও পান। অস্বীকার করার উপায় নেই যে গ্রামাঞ্চলের দৈনন্দিন চিকিৎসা অনেকাংশে এঁদের উপর নির্ভরশীল।
আরও পড়ুন, এখন সময় প্রতিযোগিতামূলক সামরিক জাতীয়তাবাদের
কোনো দেশে ভালো চিকিৎসা পরিষেবা বজায় রাখতে গেলে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য অন্তত একজন চিকিৎসক প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলিতে রোগী অনুপাতে চিকিৎসকের সংখ্যা আরও বেশি। ভারতে চিকিৎসকের সংখ্যা ছিল অনেকটাই কম। গত কয়েক বছরে দ্রুত গতিতে মেডিক্যাল কলেজগুলির আসনসংখ্যা বাড়িয়ে এবং নতুন কলেজ খুলে (কিছু ক্ষেত্রে গুণমানের ব্যাপারে আপোষ করে) চিকিৎসকের সংখ্যা খানিকটা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও প্রতি ১৪৫৬ জনে একজন চিকিৎসক। এর মধ্যে অনেকেই শহর বা মফস্বল কেন্দ্রিক, তাই গ্রামাঞ্চলের ছবিটি আরও করুণ। যেসব চিকিৎসক গ্রামাঞ্চলে কাজ করার ব্যাপারে উৎসাহী হন, তাঁদের অনেকেই ন্যূনতম পরিকাঠামোর অভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েন। পড়াশুনার জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়, বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ থাকে না, এমনকি অধীত বিদ্যাটুকু রোগীর কল্যাণে যথাযথভাবে প্রয়োগ করার সুযোগও পাওয়া যায় না।
গ্রামের চিকিৎসা তাই থেকে যায় গ্রামীণ চিকিৎসকদের হাতেই। অতএব এঁদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেবার কথাটি না ভেবে উপায় থাকে না। আমরা অনেকেই ব্যক্তিগত বা সমবেত প্রচেষ্টায় এঁদের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছি। অনেক গ্রামীণ চিকিৎসক এসব শেখার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি, কিন্তু কেউ কেউ উল্লেখযোগ্য উৎসাহের সঙ্গে ক্লাস করেছেন, প্রশ্ন করে জানার চেষ্টা করেছেন, যা প্রশংসার্হ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি এঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আরেকজনের জ্ঞান, বিচারক্ষমতা ইত্যাদির পার্থক্য বিস্তর। নির্দিষ্ট পাঠক্রম এবং পরীক্ষার মধ্য দিয়ে না আসার ফলে মানের এই তারতম্য। সরকারিভাবে এঁদেরকে স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্ব দেবার আগে এই তারতম্য কিছুটা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত।
সাম্প্রতিক ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন বিল জানাচ্ছে যে গ্রামীণ চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত ব্যক্তিদের একাংশকে স্বাধীনভাবে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের সরকারি ছাড়পত্র দেওয়া হবে। কোন যোগ্যতার ভিত্তিতে কাকে কোন অঞ্চলে কতটা কাজের দায়িত্ব ও অধিকার দেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করে বলা নেই। সরকারিভাবে ছাড়পত্র দেবার পর চিকিৎসার মান বজায় রাখার দায় কিছুটা সরকারের ওপর বর্তায়, কিন্তু সেই ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনার কথা বলা নেই।
আরও পড়ুন, কাশ্মীর, ৩৭০ ও ম্যাকিয়াভেলি বনাম কলহন
অবশ্যই আমাদের সামনে চীন, তাইল্যান্ডের মতো কিছু উদাহরণ আছে যেখানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের আংশিক প্রশিক্ষণ দিয়ে গ্রামীণ চিকিৎসকদের কাজে লাগানো হয়েছে। এই মডেলটি আদর্শ কিনা বা সব দেশকালে সমানভাবে প্রযোজ্য কিনা, সেই তর্কে যাচ্ছি না। এটুকু বলা কর্তব্য যে সেসব দেশে গ্রামীণ চিকিৎসকদের তৈরি করার প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি তন্নিষ্ঠ ছিল। সেই সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়াটি এড়িয়ে তাড়াতাড়ি অনেককে প্র্যাকটিস করার ছাড়পত্র দিয়ে দেবার মধ্যে বিনা আয়াসে রোগী-চিকিৎসক অনুপাতের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেবটুকু মিলিয়ে দেবার চেষ্টা প্রকট। এই মনোভাব সমর্থনযোগ্য নয়। স্পষ্টত সরকার গ্রামের মানুষকে সঠিক গুণমানের চিকিৎসা পরিষেবা দেবার দায়িত্বটি ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন।
এভাবে ক্রমশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে দুটি সম্পূর্ণ পৃথক গোত্র তৈরি হবে চিকিৎসার ক্ষেত্রে। একদল শহুরে সচ্ছল মানুষ, যাঁরা পাশ করা ডাক্তারদের দেখাবেন। এঁদের চিকিৎসা হতে হবে সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্যাদি মেনে। পান থেকে চুন খসলে কোটি টাকার মামলা হবে। অপর মেরুতে থাকবেন প্রান্তিক মানুষেরা, যাঁদের চিকিৎসার দায়িত্ব থাকবে এমন পেশাদারদের হাতে, যাঁদের কাছে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক প্রত্যাশা রাখা যাবে না। চিকিৎসা পাবার ক্ষেত্রে এমন তারতম্য এখনও আছে, কিন্তু এতদিন সেটা আইনসিদ্ধ ছিল না, তাই সব নাগরিককে সমমানের স্বাস্থ্যসেবা দেবার একটা নৈতিক দায় সরকারের ছিল। সহজে সংখ্যা মেলানোর খেলায় সেই নৈতিক দায়টি লুপ্ত হবে। বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত। খোঁজা উচিত সঠিক পথটি। সে পথ ঈষৎ বন্ধুর হলেও তা আমাদের নিয়ে যাবে সঠিক দিশায়।
(কৌশিক দত্ত আমরি হাসপাতালের চিকিৎসক, মতামত ব্যক্তিগত)