সুন্দর হে
জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে পাশের বাড়ির পেয়ারা গাছ। কালো মেঘ ঘনিয়ে আছে শ্রাবণের মাথায় পুব দিক জুড়ে। ওই বাড়িটায় বোধহয় কেউ থাকেনা। বাগানের একপাশে পেয়ারা গাছটা ফলে বোঝাই হয়ে আছে। এসে থেকে দুদিন ধরে দেখি সকালে ঝাঁক বেঁধে কতোগুলো পাখি আসে, ফলে ঠোকর দেয়। কিছুটা খায়, কিছু গাছতলায় পড়ে থাকে। সেখানেও দেখছি পাকা পেয়ারার একটা ছোটখাট হলদেটে স্তূপ হয়ে উঠেছে। দেখতে না-পেলেও জানি ওখানেও মহাভোজ চলছে- কাঠবেড়ালিদের, পাখিদের, আরো কতো যে ছোট ছোট প্রাণীদের। আরো কিছুদিন গেলে ওখানে আর ওই ঝরে পড়া পেয়ারার কোনো চিহ্নও পড়ে থাকবে না, কয়েকটা চারা বেরোতে পারে হয়ত আর বাকি সব মিশে যাবে মাটিতে।
দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মের মধ্যে যা কিছু জন্মায়, বেড়ে ওঠে তার কিছুই অতিরিক্ত হয় না। ওই পাকা পেয়ারার স্তূপ সরাবার জন্য বোলপুর পুরসভাকে ডাকতে হবে না, সমস্তটা প্রাকৃতিক নিয়মেই অন্যান্য প্রাণীদের পুষ্টিব্যবস্থায় লাগবার পর বাকিটুকু রূপান্তরিত হয়ে যাবে। সেই রূপান্তরের একটি সামান্য অংশ ফিরে আসবে আরো আরো পেয়ারা গাছ হয়েই।অনেকখানি আবার মাটিই হয়ে যাবে।
যাকে বলি মাটি, সে কি কোনো একটাই বস্তু? তা যে নয় সেকথা জানি সকলেই কিন্তু রোজকার কাজেকর্মে প্রায়ই মনে থাকে না। মাটি যে কতো বেশি জীবন্ত তা সবচেয়ে বেশি জানেন হয়ত কৃষকরা, মাটির সঙ্গে যাঁদের প্রতিদিনের সম্পর্ক।বাংলাভাষার প্রাণ, বঙ্গসংস্কৃতির নিজস্ব শ্বাসের বাতাস যেকালে কৃষিকাজের সঙ্গে জড়ানো তাই এই ভাষাসংস্কৃতির সর্বাঙ্গে মাটির গন্ধ, পায়ে পায়ে জলছাপ। বাংলায় বলি ‘ধুলোমাটি’। এই ‘মাটি’ শব্দটা আমাদের কানে ভারি মধুর। মাটি হল ধারক, ধরিত্রী। যে ধারণ করে থাকে। কেবল মানুষ নয়, সমস্ত জীবজগতকে। কেবল জীবজগত বা কেন? জড়জগতের আশ্রয়ও তো মাটিই। সে একই সঙ্গে আধার আর আধেয়, দুইই। পাথর, নানা রকম শিলা, নানান ধাতু বা আকরিক, সেই পৃথিবী সৃষ্টির কালে তৈরি হয়ে ভূগর্ভে চাপা পড়ে থাকা জল থেকে শুরু করে আকাশ থেকে ঝরে পড়া জল, এই সব অ-জৈব বস্তুর সঙ্গে নানা জীবকোষ, যা কিছু জীবিত ছিল তাদের মৃত্যুর পর জমা হওয়া শরীর, আরও কতো কী যে একসঙ্গে মিলেমিশে মাটি তৈরি করে তার ইয়ত্তা নেই। আর মাটি তৈরির এই কাজও চলে মাটিরই মধ্যে- অতি জটিল সব জৈব আর রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া মিলে ক্রমাগত কোষ আর অণুগুলির রূপান্তর ঘটায়। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াতের ভাষায় বলা যায়,
প্রথম মাটিতে গড়া হয়ে গেছে
শেষ মানুষের কায়
শেষ নবান্ন হবে যে ধান্যে
তারও বীজ আছে তায়। সমস্ত জন্মের শুরু হয় মাটিতে এবং একটি জীবিত বস্তুর মৃত্যু বা অবসানের পর সেই মৃত শরীরের রূপান্তর করে নতুন জীবিত বস্তু তৈরি করার কাজ করে মাটি। আমার ভাষায় তার এই পুনর্জন্ম দেবার ক্ষমতার এক নাম ঊর্বী। যা মাটির আরেক নাম।
নিশ্চিত বলা যায় এই অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মানুষের প্রথম জ্ঞানের পেছনে ছিল গাছপালার জন্ম দেখা।
কেবল আমার ভাষা বা সংস্কৃতের মধ্যেই যে মাটির এই পরিচয় আছে এমন নয়, মেক্সিকোর পুরাণেও দেখি এক অপূর্ব উপাখ্যান। মেক্সিকোর পুরাণে দিকগুলি চিহ্নিত রঙ দিয়ে। যেমন হলুদ হল পুবদিকের রঙ, তাই হলুদ রঙের প্রাণীরা পুবদিকের প্রাণী। হলুদ কেন তার অর্থ বোঝা সহজ- সূর্য পুব দিক দিয়ে ওঠে, তার রঙ হলুদ। বেশিরভাগ প্রাচীন সভ্যতা এই সূর্যোদয়ের কথা মনে রেখেই পূর্বদিককে শুভ দিক, জন্মের দিক বলে মনে করে। মেক্সিকোর ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত- সেখানে হলুদ রঙ সূর্যের প্রতীক বা শুভ, এতে কোনো তফাত নেই কিন্তু সেই পুরাণে জন্মের দিক হল পশ্চিম কারণ সূর্য সেদিকে অস্ত যায়, অর্থাৎ মরে যায়। কিন্তু পরদিন সে আবার পুবদিকে ওঠে, মানে পশ্চিমেই সেই জাদু আছে যা মাটির তলা থেকে মরে যাওয়া সূর্যকে তুলে, বাঁচিয়ে আবার পরদিন পুবদিক দিয়ে ফিরিয়ে দেয়।
পুরাণের কথা ছেড়ে দিলেও আমাদের এই পৃথিবীর দেখতে পাওয়া না-পাওয়া সমস্ত জীবিত জিনিস শুরু আর শেষ হয় ওই মাটির মধ্যে। অসংখ্য খুব ছোট ছোট পোকামাকড়, জীবানু, ব্যাকটিরিয়া ওই মাটির মধ্যে জীবন কাটায়। তাদের ব্যস্ত চলাফেরা কাজকর্ম মাটির মধ্যে অক্সিজেন যাবার পথ তৈরি করে দেয়। এই কাজটা কেঁচো এত ভালোভাবে করে যে কেঁচোকে বলে মহী-লতা। যে পাতারা ঝরে পড়ে, মাটিতে মিশে যায় যে অজস্র চেনা-অচেনা ফলফুল, এমনকি শুকনো কাঠ, প্রাণীশরীরের যে কোনো অংশ-সব কিছু মিলে মিশে থাকে মাটির মধ্যে আর সেই মাটিই যেন কোল বিস্তার করে সমস্ত নতুন জন্মকে ধারণ করে, লালন করে।
এই প্রাণময়, প্রাণসম্ভব মাটির মধ্যে থেকে যদি সেই জীবিত ভাব বাদ পড়ে যায়, কোনোভাবে আঘাত পেয়ে মাটির কোনো অংশ যদি মরে যায়? তখন সে হয়ে যায় কেবলি ধুলো। ধুলোমুঠি। তাতে আর প্রাণ অবশিষ্ট নেই।
মনে আছে হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরে এক বয়স্ক চাষি আমার হাত ধরে প্রায় কাঁদছিলেন, ‘আমাদের মাটি মরে গেছে, মা’। দেখাচ্ছিলেন কলের লাঙল মাটির ভেতরে নামে ঠিক আট ইঞ্চি, সেই আট ইঞ্চি পর্যন্ত মাটি চষা হয়, নড়াচড়া হয়। তার নিচের মাটি দশ বছর ধরে আর নাড়া পায় নি অথচ ওপর থেকে জমিতে ছিটোনো নাইট্রোজেন, পটাশ প্রচুর জলের সঙ্গে মিশে কর্ষিত স্তর বেয়ে সেই নিচের মাটিতে জমেছে। সেই মাটি একেবারে পাথর হয়ে গেছে- মৃত, প্রাণহীন। সে আর জল শুষতেও পারে না। ওদিকে সেই আটইঞ্চির জমিরও অণুগুলি নিষ্প্রাণ হয়ে এসেছে বছরের পর বছর ঢালা রাসায়নিক সার আর জলে। ‘আগে বৃষ্টির দিনে জমির নরম কাদায় আমাদের পা ডুবে যেত হাঁটু পর্যন্ত। এখন এই মাটি কাদাও হয়না, রবারের মত হয়ে আছে, পা ডোবে না।’ সেই পিতৃসমান মানুষটির মর্মছেঁড়া কান্না আজও আমার গলার কাছে আটকে থাকে।
শ্রাবণের বৃষ্টিহীন আকাশের দিকে চেয়ে সেই বীজকে জীবিত করে দেওয়া, গাছদের ডেকে আনা আনন্দঋতুর কথা ভাবি। মাটির কাছে প্রার্থনা করি, ‘তুমি আমাদের ধাত্রী, তুমি প্রাণের রক্ষয়িত্রী, প্রাণের আশ্রয়। আমাদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিও না। আমাদের সন্তানসন্ততিদের পায়ের নিচে থাকো। তাদের খাবারের ভাণ্ডার, জলের আধার হয়ে থাকো। তাদের তোমার রক্ষা দিও।’
প্রাণের কাছে প্রার্থনার চেয়ে বড়ো ধর্ম আর কী আছে!