Advertisment

বনজঙ্গল ও বনছেদন

'প্রতিবছর যে বীজ বনের মাটিতে পড়ে, তা থেকে আগের বছরের চেয়ে বেশি গাছ ওঠে। আমাদের কর্তব্য কেবল সেই গাছগুলিকে না কাটা।’

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Environment, Deforestation

ফাইল ছবি

২০০৬ সাল নাগাদ উড়িষ্যার একটা অদ্ভুত জায়গায় গিয়েছিলাম, নুয়াগড় বৃক্ষবন্ধু মহাসংঘ। আশপাশের প্রায় খান পঞ্চাশ ছোটবড় গ্রাম নিয়ে একটা রূপকথার মত জায়গা। ছোট পাহাড় আছে, ছোটবড় অনেক পুকুর। গাছে ঝোপজঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ে কিছু জীবজানোয়ারও আছে। বড় বড় গাছের ছায়ায় ঢাকা শ্যামলছায়া-গ্রাম। পুকুর ভর্তি মাছ। পুকুরগুলো সমবায়ের, ওই বৃক্ষবন্ধু মহাসংঘের। পাথরখাদানে জঙ্গল হারিয়ে অসহায় পড়ে থাকা ন্যাড়া মাঠের বীরভূম-পুরুলিয়া থেকে আসা পথিক আমি, বিমুগ্ধ হচ্ছিলাম দেখে। কী করে হতে পারল এমন, যখন সব জায়গায় জঙ্গল কমে যাচ্ছে দ্রুত?

Advertisment

সন্ধ্যাবেলায় ওঁদের সঙ্গে বসে শোনা গেল পুরো কাহিনি।

বনছেদনের একই কাহিনি ছিল ওঁদেরও, বরং তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আরো অনেক ভয়ানক। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পরপর তিনবছর অনাবৃষ্টিতে ফসল হয়নি।

গ্রামের মানুষরা একে-দুইয়ে পাহাড়ের গাছ কেটে এনে বিক্রি করা শুরু করেন। এছাড়া আর কোনো জীবিকার উপায়ও চোখে পড়ে নি তাঁদের। প্রথমে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ঝোপঝাড় তারপর পুরোন গাছগুলো ন্যাড়া হতে লাগল। তৃতীয় বছরের শেষে যতদিনে বৃষ্টি নামল, ততদিনে গ্রামের লোকজন চাষের চেয়ে সহজতর উপায়ে পাহাড়ের কাঠ বেচে কোনমতে জীবিকা নির্বাহে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। ফলে তাই চলতে লাগল বছরের পর বছর। এদিকে ক্রমশ ঝোপঝারের শেকড়ের বাঁধন হারানো ন্যাড়া হতে বসা পাহাড় থেকে বর্ষায় পাথর গড়িয়ে নামতে লাগল। চাষের খেত, গ্রামের মাঠ ভরে উঠল সেই ছোটবড় পাথরে। দেখছে সবাই কিন্তু কারো যেন মনেও হচ্ছে না আসন্ন বিপদের কথা। বরং কাঠবেচা পয়সায় নেশা ঢুকতে লেগেছে গ্রামে ছেলে ছোকরাদেরও মধ্যে। সংসারে মেয়েদের দুর্দশা বেড়েছে আরো। বসে খেলে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও শেষ হয়, একসময়ে ফুরিয়ে গেল পাহাড়ের গাছ। ফুরোল ঝোপঝাড় তাই বীজ, কাঠি, শুকনো পাতাও ফুরোল। শেষে এমন হল চাল জোটালেও ভাত ফোটাবার লাকড়ি অমিল। দু-তিনজন মিলে একহাঁড়িতে ভাত ফোটায় গৃহিণীরা, তাদের আর কী উপায়! মরদদের মিনতি করে মাঠের কাজে যাবার জন্য, কিন্তু নেশা গিলে খেয়েছে তাদের। গ্রামের সর্বজনপ্রিয় মাস্টারমশাই গোপীনাথবাবুর ইস্কুল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। খালিপেট বাচ্চারা কী শিখবে ক্লাসে?

আরও পড়ুন, ‘টিক দেওয়া’ মেধার যুগে গুজরাটি ভাষায় জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রাসঙ্গিকতা

এরকমই দুর্দশায় ডুবছিল এককালের গরিব কিন্তু গৃহস্থ গ্রাম। উটের কাঁধে শেষ খড়টি পড়ল গোপীনাথবাবুর বাবার মৃত্যুর রূপে। কাঠ-নিঃস্ব গ্রামে দাহ করার কোন উপায় ছিল না, মুখে খড়ের নুটি ছুঁইয়ে নদীর চড়ায় রেখে আসতে হল জনকের শরীর। সেই যন্ত্রণা আর গ্লানি যেন মরতে বসা গ্রামের শিরায় বিদ্যুততরঙ্গ ছোঁয়াল। রাতের পর রাত আকাশের নিচে বসে থাকা শিক্ষকের পাশে জড়ো হল গ্রাম।

Aforestation, Deforestation ছবি- লেখক

গোপীনাথবাবু নিজে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গেলেন। কথা বললেন যুবো থেকে বুড়ো, মহিলা-পুরুষ সকলের সঙ্গে। নিজের অসহ্য বেদনার সাথে সাথে খুলে দেখালেন গ্রামের আসন্ন সর্বনাশের বিকট চেহারা। গাছ কাটা বন্ধ হয়েছিল আগেই, এবারে চিন্তা শুরু হল কেমনভাবে জঙ্গল ফিরিয়ে আনা যায়। যায় কি আদৌ? না কি চলে যেতে হবে নিজেদের গ্রাম, ভিটে ছেড়ে? বারে বারে একসঙ্গে বসে ঠিক হল গ্রাম থেকে, ধানের খেত থেকে পাথর তুলে ফেলা যাতে বর্ষায় চাষ দেওয়া যায়। কিন্তু তার আগে, সবচেয়ে আগে ব্যবস্থা করতে হবে গাছ ফেরাবার।

এ দেশের প্রকৃতির এমন মায়া, এই সময়টুকুর মধ্যেও গ্রামে, পাহাড়ে মাথা তুলেছে নানা গাছের চারা। কথা হল, তবে কী বনবিভাগ থেকে চেয়ে আনা হবে কিছু গাছ? প্রাজ্ঞরা দু-একজন বললেন, বাইরের গাছ এনে বসানোর চেয়ে বেশি কাজের হবে যেসব গাছের চারা উঠছে সেগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা। তারা এই মাটির পরিচিত গাছ, আলাদা যত্ন করতে হবে না। কেবল কাটা বন্ধ রাখতে হবে। কিছুজন চাইলেন বনদফতর থেকেও কিছু বেশি গাছ এনে লাগাতে, তাড়াতাড়ি গাছের সংখ্যা বাড়বে। তাও হল। কিন্তু এই ফিরে আসার ব্যবস্থায় সবাই খুশি হয়নি। নেশার পেশা করছিল যারা, যারা করছিল বন্ধকি কারবার, সেরকম দুচারজনের চক্ষুশূল হল এই ফিরে দাঁড়ানো। তারা করল তাদের যা সাধ্য- একরাত্রে একশ গাছের চারা কাটা গেল। সকালে পুরো গ্রাম স্তম্ভিত। সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারছে কাদের এই কাজ, যুবারা ফুটছে তাদের উচিত শিক্ষা দেবার জন্য। কিন্তু নিবৃত্ত করলেন গোপীনাথবাবু। এমনকি খবর পেয়ে এসে পড়া স্থানীয় ওসি কেও বললেন ‘না, কারোকে সন্দেহ করিনা আমরা, জানি না কে করেছে।’ কেবল অন্নজল ত্যাগ করলেন, বললেন ‘প্রায়শ্চিত্ত করছি’। তিনদিনের দিন অন্যায়কারীরা পায়ে পড়ল এসে,

-আপনি আমাদের ধরিয়ে দিতে পারতেন, কেন দিলেন না?

-তাতে কী হত? রাগ দিয়ে তো কোনো ভালো কাজ হয় না। সবাই হাত দিলে তবে কাজ ভালো হয়।

তাই হয়েছিল। সাত-আট বছরের নিরন্তর পরিশ্রম আর ভালোবাসা। অভাবনীয় পরিশ্রম। চাষের খেত থেকে, মাঠের পথ থেকে সমস্ত পাথর তুলে নেওয়া। বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে এসে ভরাট করে দিয়েছিল পুকুরগুলোকে, তাদের কেটে গভীর করা। প্রকৃতি তো জননী, তাঁর দিকে এতটুকু এগিয়ে গেলে তিনি নিজে সব অভাব পূরণ করে দেন। আট বছরে ঘন সবুজ হয়েছে পাহাড়-সমতল। শ্যামল শস্যখেত। গভীর পুকুরে মাছের ঝাঁক। ফিরে এসেছে আবার। সঙ্গে এসেছে একটি নতুন ধর্মাচরণ- ওইসব গ্রামে পরস্পর দেখা হলে একমাত্র সম্ভাষণ ‘বৃক্ষবিনা জীবন নহি’।

আরও পড়ুন, বার্লিন প্রাচীর, ত্রিশ বছর পর আজও বর্তমান

পরস্পরের প্রতি হাতজোড় করে এই এক উচ্চারণ।  যে কোন উপলক্ষ্যে-বিয়ে হোক বা মৃত্যু, প্রতিটি ঘটনার স্মারক হিসাবে গ্রামে লাগানো হয় অন্তত দুটি গাছ। গাছেরাই হয়ে উঠেছিল সে গ্রামের ইতিহাস বই।

এতদিন পর আবার শুনলাম সেই প্রাজ্ঞ বাণী, ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী নেত্রী রোজ কেরকেট্টার মুখে। ‘বন একটি প্রাকৃতিক সংস্থান। বন সৃজন করার কোন দরকার নেই। প্রতিবছর যে বীজ বনের মাটিতে পড়ে, তা থেকে আগের বছরের চেয়ে বেশি গাছ ওঠে। আমাদের কর্তব্য কেবল সেই গাছগুলিকে না কাটা।’

উষ্ণায়ন বিষয়ে গবেষণা ও প্রচার চালানোর জন্য অঢেল টাকা খরচ করা সরকার কি এই সহজ সত্যকথাটি শুনতে পাচ্ছেন?

এই সিরিজের সব লেখা এক সঙ্গে পেতে ক্লিক করুন এই লিংকে

Jol Mati
Advertisment