Advertisment

জল মাটি: পুজো-পার্বণ

লক্ষ্মী ছিলেন শ্রী আর শস্যের দেবী। কেবল শঙ্খ ঘোষ চিঠির মাথায় শ্রী লেখেন বলেই নয়, ‘শ্রী’ তো কল্যাণসৌন্দর্যেরই দেবী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Dhanteras, Jol Mati

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ফাইল (ছবি- পার্থ পাল)

পূর্ণিমায় লক্ষ্মীপুজো আর অমাবস্যায় কালী – এই দুই পরবের মাঝখানে এসে পড়েছে আর এক নতুন মহাপরব- ধনত্রাস। পরিবার, অপরিবার, হতে- পারে-পরিবার সক্কলে সেই নবীন সেনী উদ্যমে ‘ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে’ চলেছেন কিনতে। কী কিনতে? সেটা বড়ো কথা নয়- কিছু না কিছু কেনো। জানাই কথা যতো বেশি দামি জিনিস কিনবে, ততোই উথলে উঠবে সৌভাগ্য। কারণ সৌভাগ্য নির্ভর করে ‘পড়শির ঈর্ষা’র ওপর। সুতরাং বাজি ফাটাবার ধামাকা মহালয়া দিয়ে শুরু করে ‘ধনদেবী লক্ষ্মী’র পুজো, তারপর কার্তিকী অমাবস্যায় বাজি, ডিজে ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক সহ, ফুর্তির শেষ দেখে নিয়ে শারদীয়া পুজোপরব শেষের পথে।

Advertisment

শহুরে বাঙালির সহনশীলতা ও গ্রহণশীলতার জুড়ি মেলা ভার। ‘ধনতেরস’ পুজো তাঁরা এমন গুছিয়ে আপন করে নিয়েছেন যে তার পেটের খবর চাপা পড়েছে একেবারে সাতহাত মাটির তলায়। এখন যদি কোনো অরসিক বলতে আসে যে ধনতেরস এর সংগে ধনসম্পত্তির কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই ওটা আসলে ঋষি-চিকিৎসক ধন্বন্তরীর জন্মতিথি হিসাবে সুস্বাস্থ্যকামনার তিথি ছিল, তাহলে তাকে নিঘঘাৎ সমস্ত দোকানবাজারের সভ্য অঞ্চল থেকে বার করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রথাটির শুরু সেখান থেকেই। দুর্গাপুজোর সময়কার যে শুক্লা অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষণ, শ্রী যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বিচার করে দেখাচ্ছেন যে সেটি আসলে সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণ চংক্রমণের সন্ধি। প্রাচীন জ্যোতিষের বিচার অনুযায়ী কার্তিকমাসে সূর্য নিম্নস্থ থাকে অর্থাৎ তার জ্যোতি হ্রাস হয়। হিম পড়তে শুরু করে। ঋতু-পরিবর্তনকালে ‘হিম লাগা’ বা অসাবধান না হওয়ার কিছু নিয়ম বাস্তবে এখনও পালন করা হয়। এইসব কারণেই কার্তিকের শুক্লা ত্রয়োদশীতে চিকিৎসক ধন্বন্তরীর কাছে প্রার্থনা জানানোর এই রীতি ছিল।

অনেকের মনে থাকতে পারে, এই কার্তিকমাস পূর্বজদের স্মরণের মাস ছিল। তাঁদের জন্য সন্ধ্যাবেলায় বাড়ির ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বালা হত। পূর্বজদের স্মরণ করার এরকম প্রথা পৃথিবীর আরো বহু প্রাচীন সভ্যতায় দেখা যায়। আধুনিক বাজার চেষ্টা করে প্রকৃত উপলক্ষটি আড়াল করে কেবল দিনটিকে কিছু কেনার উচ্ছ্বাস হিসাবে চিহ্নিত করে দিতে, যেমন সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের দিন কিংবা ঈস্টার উৎসব। এমনকি, নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রিয় কারো জন্মদিনও প্রীতি ও কল্যাণকামনার থেকে অনেক দূরে আরেক দেখানেপনা প্রতিযোগিতার দিন হয়ে উঠল।

কথা হল এই ফুটন্ত উৎসবের মাঝে বসে এসব কথা তুলছি কেন? এ সকল দেবদেবীমূলক পূজা, ধর্ম- এসবে তো আমরা অনেকেই বিশ্বাস করিনা। কথাটা ঠিক, কোথাও একজন বা অনেকজন ভগবান আকাশের ওপরে বসে আছেন, তিনি/ তাঁরা মানুষের ভাল/মন্দ করতে পারেন, পুজো করে তাদের সন্তুষ্ট করা যায়- এসব কথা আন্তরিকভাবে খুব কম লোকই মনে করেন। আমরা জানি, এগুলো বহুকালের প্রচলিত প্রথা। এই উপলক্ষে সমাজের নানা শ্রেণির মানুষ আনন্দ উৎসব করেন। কিন্তু একদিকে, ধীরে ধীরে সেই আনন্দ-উৎসবের প্রধান চেহারাটা চলে যাচ্ছে কেবল কেনাবেচা ও নানারকম প্রতিযোগিতায়, যার অনেকগুলোই ক্রমশ সুস্থতার বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে, এই প্রথাগুলোর কোনো গভীরতর অর্থ খোঁজার ইচ্ছে, প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজন- সবই চলে যাচ্ছে আমাদের ভাবনাজগতের বাইরে। অন্যদিকে, একটু মন দিয়ে দেখলে এই প্রথাগুলোর মধ্যে দিয়ে আমাদের পুরোন সমাজের অনেক চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।

কারো মনে হতে পারে, কী দরকার পুরোনো সমাজকে খোঁজার?

প্রয়োজন আছে। হয়ত যতোটা আমরা ভাবি তার চেয়ে বেশিই প্রয়োজন। কোনও জাতির ইতিহাস অর্থাৎ তার নিজের শিকড়ের পরিচয় থাকে তার সমাজে প্রোথিত, মাটিতে যেমন ধৃত থাকে গাছ। ‘এলেম আমি কোথা থেকে’ তো কেবল এক ব্যক্তির ভূমিষ্ঠ হবার পরিচিতি সন্ধান নয়,  রীতিনীতি সামাজিকতা, তার ভৌগোলিক, পরিবেশগত পরিচিত, তার  বাসস্থান –ভিটে, তার খাদ্য, পরিধেয়, বাসস্থান, ভাষা এককথায় তার সমগ্র সংস্কৃতির পরিচয়ই মানুষের পরিচিতি। এমন কি সে গহীন জঙ্গলে  একলা থাকলেও থ্রি-পিস স্যুট পরে খেতে বসা দেখেই নাকি তাকে চেনা যায়। রঙোলির টান কিংবা ভাটিয়ালির সুর শুনে কি নবান্ন উৎসব দেখে যেমন অন্যদের। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্য, আরও ভালো করে বললে এই স্বকীয়তা, তাদের পছন্দ নয় যারা চায় নির্ঝঞ্ঝাটে একচেটিয়া বিপুল উৎপাদন। কর্পোরেট সভ্যতা বৈচিরত্য চায় না। তার কারণ নানা কিন্তু প্রধান কথা বোধহয় এই যে বৃহৎ সর্বদাই নিজের ক্ষমতা দেখতে ভালোবাসে, বৈচিত্র্য ‘অন্যরকম’কেও স্বীকৃতি দেয়।

কর্পোরেট সভ্যতা তাই সমস্ত মানুষের একইরকম পছন্দে স্বস্তি পায়। ভিন্ন ভিন্ন মনুষ্যসমাজের স্মৃতিকে ভুলিয়ে দিতে পারলে সকলকেই ‘আধুনিকতা’র খুড়োর কলে দৌড় করানো সহজ। মানুষের জীবনে সবচেয়ে আধুনিক যে তার নিজস্ব ভাবনা, তার অর্থবোধের ক্ষমতা, এ বালাই লোকে, বিশেষত নবীনরা যতো শিগগির ভোলে, দোকানদারের ততো লাভ। সমাজের প্রাচীন ইতিহাস-চিহ্নগুলির অধিকাংশকে তাই ‘সেকেলে’ বলে দূর করে ফেলে, বাকিগুলো দিয়ে চকমকে বেসাতি বানিয়ে বেচতে শুরু করলে ডবল লাভ। লক্ষ্মী ছিলেন শ্রী আর শস্যের দেবী। কেবল শঙ্খ ঘোষ চিঠির মাথায় শ্রী লেখেন বলেই নয়, ‘শ্রী’ তো কল্যাণসৌন্দর্যেরই দেবী। বস্তুত সে জন্যই শান্ত সাহসের বিবেকধারী কবি লেখেন।

কিন্ত, গত কয়েকবছর ধরে দেখছি লক্ষ্মীপুজোর আগে থেকে তিনি বিপুল বিজ্ঞাপিত হতে থাকেন ‘ধনদেবী’ বলে। দেবতা যেখানেই থাকুন, বহু প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয় দেবমূর্তিবিদ্যা, এটাই কি ‘আইকনোগ্রাফি’র নামপরিচয় হতে পারে, ভারি বিস্তারিত ও অপরূপ কল্পনাময়। লক্ষ্মীপুজোয় ধানছড়ার আলপনা, আসনচৌকি ঘিরে ধান আর যবের শীষের প্রাবল্য, তাঁর পরিচয় স্পষ্ট করে রেখেছে। কিন্তু তা-ই সব নয়, ধনেরও একজন নির্দিষ্ট দেবতা আছেন এদেশে, তাঁর নাম কুবের। রাক্ষসরাজ রাবণের তিনি বড় ভাই। পাতালে থাকেন, যেখান থেকে ধাতুসকল উত্তোলিত হয়। এবং এই ঈষৎ ন্যুব্জ, বিশালদেহী দেবতার একজন বাহনও আছে। ভারতীয় মূর্তিশাস্ত্রে ধনদেব কুবেরের বাহন- মানুষ।

কে বলে মুনিঋষিরা ঘরসংসার জানতেন না?

(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা একসঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Jol Mati
Advertisment