গাড়োয়ালের তুঙ্গনাথ পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে গড়িয়ে নামছে ছোট নদী আকাশকামিনী। সেই গাড়োয়ালি গ্রামে, স্থানীয় লোকজনের মুখে তার এহেন নাম শুনে দস্তুরমত চমকে উঠেছিলাম, ভেবেছিলাম হয়ত এ নদীর অন্যকোনো চলিত নাম আছে, ইদানীং এমন অপরূপ সংস্কৃত নাম দেওয়া হয়েছে। পরে বুঝলাম না, এটাই ওর বরাবরের নাম। এই নামেই সে আঠেরো কি বাইশ কিলোমিটার লম্বা নদী পরিচিত। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিজের কাটা খাত ধরে ঝর্ঝর ধারায় চলে এসে সে মন্দাকিনীতে মিশেছে। সেখান থেকে আরো পাহাড়ের গা বেয়ে আরো নিচদিকে রুদ্রপ্রয়াগে এসে মন্দাকিনী মেশে অলকানন্দায়। পাহাড়ের অন্যদিকের গোমুখ গঙ্গোত্রী থেকে নামছে গঙ্গা। অনেকখানি নিচে দেবপ্রয়াগে অলকানন্দার ধারা মিলিত হল ভাগীরথীর সঙ্গে। একই খাতের মধ্যে দিয়ে দু-রঙের দুটি জলস্রোতের সহগমন- সেই অসামান্য দৃশ্যের সামনে পুরোনকালের ঋষিমুনি কেন, আমাদের মত সামান্য মানুষদের মনেও নিত্যবাস সম্পর্কে নানা দার্শনিক চিন্তার উদয় হত উপনিষদে উল্লিখিত সেই ‘পিতা যেমন পুত্রকে, সখা যেমন সখাকে...’ নিত্য সম্ভাষণে সয়ে নেওয়ার আদর্শ বিষয়ে।
আরও পড়ুন, বাংলার শিকড়: সুখারিয়াতে ‘আকালের সন্ধানে’
আর এই দীর্ঘ পথে প্রতিটি প্রধান নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ছোট-মাঝারি অসংখ্য ধারা। বিশাল পাহাড় আর ঘনজঙ্গলের ভেতর থেকে যত জলের ধারা নেমে আসছে তারা সবাই তো এই প্রধান নদীদের কারো না কারো অববাহিকার অংশ, ফলে তারা নিজেদের জলস্রোত এনে মেশায় এইসব নদীর ধারায়। আকাশকামিনীও তেমনই এক ছোট নদী। খাগড় বলে একটা জায়গায় যেখানে সে মন্দাকিনীতে পড়ে, এখন সেটা মোটরাগাড়ির রাস্তার প্রায় সামনেই। আশ্চর্য লাগে যে ভীলাঙ্গনা বা আকাশকামিনীর মত খুব দু’ একটিকে বাদ দিলে গাড়োয়াল অঞ্চলের প্রায় সব বহতা জলধারার নামের সঙ্গেই গঙ্গা শব্দ জুড়ে আছে। ফুলগঙ্গা, কেদারগঙ্গা, বিরহী গঙ্গা, সোনগঙ্গা এমনি অজস্র। এদেরও গোড়ায় থাকে গড়িয়ে এসে ঝাঁপানো ঝর্ণাধারাগুলি। যেন পৃথিবীর উচ্ছ্বসিত হাসির মত তারা। কোন দূর-দুর্গম থেকে এমন অগুণতি জলধারা এসে একটি নদীর ধারাকে তৈরি করে। অনেকগুলো চুল নিয়ে যেমন একটি বেণী।
কেবল যে নিজের অববাহিকার পাথর-মাটি-বনতল ধোয়া জল নিচের জলে মেশায় নদী, এমন নয়। সেই সঙ্গে নিজের দুইপাশের মানুষ ও জীবজগতকেও সুচালিত করে তারা। সমতলের নদী সম্পর্কে যদি কেউ শুধোয় কী আসে নদীতে? আমার মত দূর অঞ্চলের মানুষ হয়ত বলব -‘জল’। নদীতীরের একজন বাসিন্দা বলবেন ‘মাটি, মাছ, শ্যাওলা কতোকিছু।’ যেখান দিয়ে বয়ে আসে সেখানকার মাটি, এমনকি শিলাস্তরও ক্ষয় করে বয়ে আনে নদী। শিলাস্তরে স্থিত বিভিন্ন আকরিক। সে ক্রমাগত নিচদিকে চলতে থাকে, নদীবাহিত এই মসৃণ মাটিও নিচদিকে যায়। সমতলে নদী চওড়া হয় বলে বর্ষাকালীন জলস্ফীতির সময় এই মিহি পলল মাটি অনেকখনি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গভীর জায়গায় জল জমা হলে বয়ে আসা মাটির কিছুটা সেখানে জমা পড়ে। কিছু উদ্বৃত্ত মাটি আবার আরো নিচে বয়ে যায়। এইভাবে ঝরণা ও নদী নিরন্তর অববাহিকার নিচু অংশগুলিকে উঁচু করে তোলে। এই পদ্ধতি যতো চলে নদীখাত স্বাভাবিকভাবেই ততো গভীর হয়। গভীর নদী যেমন শীতগ্রীষ্মে কিছুটা জল নিজের খাতে ধরে রাখতে পারে, বর্ষার অতিরিক্ত জলও সহজে তার খাত উপছে ওঠে না। কূলভাসানো বন্যা প্রতিবছরের স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতে ঘটে না।পঞ্চাশ বছর আগেও দেখা যেত স্বাভাবিক বড়ো বন্যা আসত গড়পড়তা চার বছরে একবার। লোকের দুর্দশা হত, কিন্তু একরকম প্রস্তুতিও থাকত। বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে লোকের বসতি থাকত নদী থেকে কিছুটা দূরে। নদীর কাছ ঘেঁষে থাকত ক্ষেত, জলের সংগে আসা পলিমাটির সবচেয়ে বেশি অংশ যেন খেতেই জমা হয়। বসতবাড়ি লোকে তৈরি করত যার যেমন সাধ্য উঁচু ভিতের ওপর, মাটির বাড়িও। অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলে দুচারদিনের জন্য জল দাঁড়িয়ে গেলে বাসিন্দারা একটু উঁচু জায়গায় কুটুমদের খোঁজ-খবর করে আসতেন সেই ক’দিন। আমাদের নদীপ্রধান দেশে জারি, ভাটিয়ালি এরকম বহু গান নদীজলের এই জলের নানা বৈশিষ্ট্য থেকে জন্ম নিয়েছে।
আরও পড়ুন, ঘরে কী কী বই আছে?
নদীজল আর তীরবর্তী মাটির এই পারস্পরিক ছন্দোবদ্ধতার সঙ্গে মিলেমিশে থাকার যে সব নিয়ম মানুষের সমাজ ধীরে ধীরে তৈরি করে, তা-ই তার জীবনযাপনকে একরকম নিয়মিত সৌষ্ঠব দিয়েছিল। সমস্যা তখনও ছিল, সেই সকল সমস্যাকে পার করার চেষ্টাও অনেকটাও ছিল মানুষের নিজের ক্ষমতার মধ্যে।গত এক শতাব্দীরও কম সময়ে দীর্ঘকালের এই নদীধারার ছন্দ বিভিন্ন ভাবে ব্যহত হয়েছে। তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা পাবার জন্য অল্পসংখ্যক মানুষ যখন অন্যান্য প্রাকৃতিক শৃঙ্খলার সঙ্গে নদীর স্বাভাবিক বহমানতার নিয়মকে নষ্ট করতে শুরু করল, তখন থেকেই মনুষ্যসভ্যতা নিজেকে অমোচনীয় সংকটে টেনে নামাতে লাগল।
আমাদের মত ঋতুচক্রের দেশে বর্ষাকালে বন্যা সবচেয়ে স্বাভাবিক ঘটনা এবং এই বন্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এদেশের শুধু উৎপাদন পদ্ধতি নয়, দেশের সংস্কৃতি। সেখানে নদীর স্বভাবকে লঙ্ঘন করার কারণে প্রায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেও বন্যা, জলডুবি, নদীতীরবর্তী গ্রামে শুধু নয়, দেশের সবচেয়ে বড়ো শহর গুলিতেও নৈমিত্তিক বার্ষিক ঘটনা হয়ে উঠেছে। অথচ বন্যার সমার্থক যে পলিমাটি আর মাছের প্রাচুর্য ছিল তাও খোয়া গিয়েছে।
কী হতে পারে তার ফল? কী এমন কাজে লাগে নদীর জল যখন কিনা আমাদের সকলেরই বাড়িতে কলের জল আছে আর, যে সব বাড়িতে এখনও নেই, অচিরে তারাও পেতে যাচ্ছেন ‘নল কা জল’? এরপরের দু একটা সংখ্যায়, পাঠকরা যদি চান, কিছু কথা হতে পারে সে প্রসঙ্গ নিয়ে।
এই সিরিজের সব লেখাগুলি পাওয়া যাবে এই লিংকে