Advertisment

মাটি, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

আদিম জীবন্ত বস্তুর জাদুস্পর্শেই প্রাণহীন পাথরখণ্ডের মাটিতে পরিবর্তিত হওয়ার শুরু। মৃত শ্যাওলার গুঁড়ো, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৃত পোকাদের খোসা, এইসব জমে পাথরচূর্ণ থেকে গড়ে উঠছিল এক নতুন পরমাশ্চর্য বস্তু – মৃত্তিকা।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Soil

ফাইল ছবি

এক উজ্জ্বল তরুণ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছিলেন, খোলামুখ খনিতে মাটির ক্ষতি হয় বলছেন, মাটির আবার ক্ষতি কী? মনে পড়ল প্রায় সত্তর বছর আগে এক মেয়ে কী যত্নে লিখছিলেন মাটির জন্মকথা। রাচেল কারসন লিখছিলেন যে আমার মত একজন সাধারণ মানুষের জন্য, নিজের বেঁচে থাকার আশপাশের কোনো দরকারি কথা না-শিখেই যার জীবন কেটে গেছে। পায়ের তলার মাটি, তাকে যে কেন ধরিত্রী বলে আমার আপন ভাষায়, ভেবে দেখাই হয়ে ওঠে নি।

Advertisment

কোলিয়ারি কিংবা পাথর খাদানের প্রকাণ্ড গহ্বরের আশে পাশে জমে থাকে পাহাড়ের মত প্রকাণ্ড কাঁকুড়ে পাথুরে মাটির স্তূপ। কিন্তু পাহাড় নয়। সাত-দশ বছরেও নিতান্ত কিছু কাশ ছাড়া আর কিছু জন্মায় না ওগুলোর ওপর। নরম মিহি মাটির যে স্তর ওইসব জায়গার মাঠঘাটে বিস্তৃত ছিল, যার ওপর ছিল জঙ্গল, ঘাসজমি, ছোট নদীর ধারা, গ্রাম, সেই পলল মাটি চাপা পড়েছে দেড়শ’ দুশো ফুট খুঁড়ে তোলা ওই ঊষর কাঁকুড়ে পাহাড়ের নিচে।

আরও পড়ুন, আন্তর্জাতিক জলবায়ু ধর্মঘট আন্দোলন কী ও কেন?

ভূভাগের ওপর জায়গায় জায়গায় মৃত্তিকার যে স্তর বিছিয়ে, তাইই মানুষের আর পৃথিবীর অন্য সমস্ত প্রাণীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। মাটি না-থাকলে আমরা যাদের মাটির ওপরের গাছপালা বলি, সেগুলো জন্মাতো না। গাছপালা না থাকলে কোনো প্রাণী বাঁচত না।

তবু, এটা যেমন সত্য যে আমাদের জীবনযাপন নির্ভর করে মাটির ওপর, তেমনি এটাও কিন্তু সত্য যে মাটিও নির্ভর করে জীবজগতের ওপর। মৃত্তিকার উৎপত্তি আর তার নিজস্ব প্রকৃতি জীবিত বা মৃত প্রাণী আর গাছপালার সংগে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে যুক্ত। কারণ মাটিকে এক হিসাবে বলা যায়, জীবনের দ্বারাই তৈরি। কোটি কোটি বছর আগে জীবন্ত ও জড়বস্তুদের এক আশ্চর্য সমাহারের মধ্য দিয়েই মাটি গঠিত হতে থাকে। এর মূল উপাদান ছিল আদিম আগ্নেয়গিরিগুলো থেকে বেরিয়ে আসা জ্বলন্ত লাভার স্রোত।তার ওপর ঝরে পড়া বিপুল বৃষ্টিজল যুগের পর যুগ ধরে সেই কঠিন আগ্নেয় শিলাস্তরকেও ক্ষয় করছিল। তুষার আর বরফ পাথরের ফাটলে ফাটলে ঢুকে তীক্ষ্ণ ছেনির মত সেই শিলাস্তরকে আরও কুচিকুচি করে ভাঙছিল। তারই মধ্যে একসময়ে জীবনের আবির্ভাব হল। এককোষী শ্যাওলা, যা কিনা খোলা পড়ে থাকা সেই নিষ্প্রাণ প্রস্তরস্তূপের প্রথম জীবিত আস্তরণ, তারা নিজেদের শরীর নিঃসৃত অ্যামিনো অ্যাসিডের সাহায্যে পাথরকে আরো ক্ষয় করে তাকে উপযুক্ত করে তুলল অন্যান্য আরো নানা জীবিত বস্তুর সংস্থানকে ধারণ করার মত। সেইসব আদিম জীবন্ত বস্তুর জাদুস্পর্শেই প্রাণহীন পাথরখণ্ডের মাটিতে পরিবর্তিত হওয়ার শুরু। মৃত শ্যাওলার গুঁড়ো, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৃত পোকাদের খোসা, এইসব জমে পাথরচূর্ণ থেকে গড়ে উঠছিল এক নতুন পরমাশ্চর্য বস্তু – মৃত্তিকা। পলল মাটি। অতি ধীরে। কোথাও কোথাও এমনকি একহাজার বছর লাগল একইঞ্চি ওই পালনী, ঋত্তিকা তৈরি হতে। আদিম সমুদ্রজল থেকে উঠে আসা মৃত প্রাণীদের খোলা, নানা দেহাবশেষও জমা হচ্ছিল তার মধ্যে।

একরকম করে জীবনই যে মৃত্তিকাকে ঘটিয়ে তুলল, তাই নয়,  এর মধ্যে দেখা দিল অসংখ্য, অজস্র জীবিত প্রাণের বৈচিত্র। সেগুলো উপস্থিত না থাকলে, যাকে আমরা মাটি বলি, তা হয়ে থাকত বন্ধ্যা এক মৃত বস্তুমাত্র। নিজেদের উপস্থিতি আর বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ দিয়ে  এই সংখ্যাতীত জীবনকণার জাল মাটিকে উপযুক্ত করে তুলল যাতে তা হতে পারে এই ধরণীর কোমল, সবুজ আবরণ। পৃথিবীর নিজের পোষাক।

এই মাটিও কোন স্থির বস্তু নয়, তা থাকে নিত্যপরিবর্তনশীল অবস্থায়। যে সব জীবনচক্রের কোনো অন্ত নেই কারণ নির্দিষ্ট আরম্ভও নেই, তাদেরই আধার এবং অংশ হয়ে। উপাদান বস্তুগুলি এখনও নিত্য গঠনশীল। বাতাস ও বৃষ্টির ঘর্ষণে, সূর্যতাপ ও বরফে, শিলাস্তর ক্রমশ ক্ষয় হচ্ছে। জীবিত বস্তুরা পচছে, আকাশ থেকে বৃষ্টিধারার সঙ্গে নেমে আসছে নাইটট্রোজেন ও অন্যান্য মৌল। তারই মধ্য থেকেকিছু অংশকে যেন সাময়িকভাবে, ধরে নিচ্ছে নতুন নতুন জন্মানো প্রাণসংস্থানগুলো। বিরাট অথবা অতি সূক্ষ্ম সব রাসায়নিক পরিবর্তনও ঘটে চলেছে। চলছে বাতাস ও জল থেকে পাওয়া মৌল উপাদানগুলোকে উদ্ভিদের কাজে লাগবার উপযুক্ত করে নেবার পদ্ধতি। জীবিত প্রাণসংস্থানগুলোই এইসব পরিবর্তন ঘটানোর সহায়ক হচ্ছে।

আরও পড়ুন, গ্রেটা থুনবার্গ কি বিশ্বের জলবায়ু নীতিতে কোনও পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম?

মাটিজন্মের অন্তরালে এরকম কতো যে সপ্রাণ বস্তু গিজগিজ করছে, তার মত মনোগ্রাহী বিষয় খুব কমই আছে, মাটির মধ্যেকার এই সূক্ষ্ম প্রাণকণাগুলো কীভাবে পরস্পরের সংগে যুক্ত থেকে নিজেদের এক বিশ্ব তৈরি করে নেয়, কীভাবেই বা যুক্ত থাকে পৃথিবীর উপরিতলের সঙ্গে, সেই অতি আকর্ষক বিষয় নিয়ে চর্চা অপেক্ষাকৃত কম কেন হয় বলে আক্ষেপ করেছিলেন রাচেল ১৯৬০-৬২ সালে। তাঁর মনে হয়েছিল এই বিশাল বিশ্বব্যাপারকে চালিত করার ক্ষেত্রে ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণকণাগুলোর গুরুত্ব বুঝলে মানুষের মনে হয়ত আরেকটু বেশি সম্ভ্রম বাড়বে, যত্ন বাড়বে এই পালনী মৃত্তিকার জন্য। রাচেল জেনে গেলেন না মাটির গঠনপ্রনালী, তার মধ্যেকার অণুজীবদের ভুবনই আজ বিজ্ঞানের সবচেয়ে চর্চিত বিষয়। জানলেন না- মাইক্রোবায়োলজি  নিয়ে গবেষণার জন্য কত বিপুল অর্থের জোগান আসে বিভিন্নন কর্পোরেটদের কাছ থেকে। কিন্তু রাচেল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, একেবারেই বাস্তবায়িত হয় নি তা। বরং কৃষি এখন কারখানা-জাত উৎপাদনের চরিত্র নিয়েছে। প্রকৃতির সূক্ষ্মের চেয়ে সূক্ষ্ম নিয়মকেও এখন ‘পেটেন্ট’ নেওয়া যায়।

(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)

এই সিরিজের সব লেখাগুলি পাওয়া যাবে এই লিংকে

environment Jol Mati
Advertisment