১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে মাধবরাও সিন্ধিয়া কংগ্রেস দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। তারপর নরসিমহা রাওকে সরিয়ে সীতারাম কেশরী যখন দলের সভাপতি হন, তখন তিনি আবার ফিরে আসেন। যেদিন ফিরেছিলেন, সেদিন, নিয়ম মেনে দলীয় ফর্মে স্বাক্ষর করার জন্য অর্জুন সিংকে একটি কলম দেন। অর্জুন সিংয়ের কাছেই থেকে যায় সেই কলম। পাঁচ বছর পর যখন মাধবরাওয়ের পুত্র জ্যোতিরাদিত্য বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর কংগ্রেসে যোগ দেন, সেদিন আবার দলীয় ফর্ম ভরার জন্য অর্জুন সেই স্মৃতিবাহী কলমটি তাঁকে উপহার দেন।
সেই ঝর্না কলমটি আজও রয়েছে জ্যোতিরাদিত্যের কাছে। জানি না, বিজেপির প্রাথমিক পদ গ্রহণের ফর্মটিতে স্বাক্ষর করার সময় তিনি কোন কলম ব্যবহার করেছেন! শুধু বুঝতে পারছি, ইতিহাস কীভাবে পুনরাবৃত্ত হয়। ফিরে আসে ইতিহাস, নব নব রূপে ফিরে আসে।
আরও মনে পড়ছে এক সন্ধ্যার কথা। লালকৃষ্ণ আডবাণী তখন থাকতেন পান্ডারা পার্কে। সেদিন হঠাৎ গিয়ে দেখি, খাওয়ার ঘরে বসে আছেন কংগ্রেস নেতা রঙ্গরাজন কুমারমঙ্গলম। তামিলনাড়ুর এই নেতা আবার প্রয়াত সিপিআই নেতা মোহন কুমারমঙ্গলমের পুত্র, এবং বাংলার একদা মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জির সম্পর্কিত পৌত্র। মা বাঙালি হওয়ার সুবাদেই হয়তো, দারুণ বাংলা বলতেন 'রঙ্গা' (এই নামেই তাঁকে সবাই ডাকত)। রঙ্গার অনুরোধে সেদিন রাতে খবরটা লিখতে পারিনি যে, তিনি শিগগির বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন।
পরে, রঙ্গা ডিনার সেরে চলে যাওয়ার পর, আমাকে আডবাণী বুঝিয়েছিলেন, কেন তিনি দলে কিছু বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতাকে নেওয়ার পক্ষে। প্রথমত, বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ হলো কংগ্রেস। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে শতাধিক বছরের প্রাচীন এই দলটি যতই দুর্বল হবে, বিজেপি ততই প্রতিপক্ষের পরিসর পাবে। একজনের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে অন্যের অধোগতি সমানুপাতিক। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের 'ল্যাটারাল এন্ট্রি' সংঘ পরিবারের সংকীর্ণ ভিত্তি থেকে দলকে আরও প্রসারিত করবে। তৃতীয়ত, যেসব রাজ্যে বিজেপির রাজনৈতিক ভিত্তি দুর্বল, সেসব রাজ্যে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত নেতা এলে তাঁর পরিচিতিকে 'মূলধন' করে বিজেপির শক্তি সেসব দুর্বল রাজ্যে বাড়ানো যেতে পারে।
আডবাণীর সেসব চেষ্টা যে সবটা সফল হয়েছে, তা নয়। কিন্তু আজ মোদী-অমিত শাহ যা করছেন, তাতে সেই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনীতিই পরিলক্ষিত হচ্ছে। জ্যোতিরাদিত্যের বিজেপিতে যোগদান সেই রাজনীতির সম্প্রসারণ। নতুন সংস্করণ মাত্র। এর ফলে কংগ্রেসের ক্ষতি কতটা, আর বিজেপির লাভ কতটা - তা নিয়ে ময়নাতদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রেও, আর পাঁচটা বিষয়ের মতো, নানা মুনির নানা মত থাকতেই পারে। তবে গান্ধী পরিবারের চরণতলের দাসানুদাসও আজ একথা বলতে পারছেন না যে, এই পরিস্থিতিতে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল।
এই ঘটনার পরদিন, সংসদে এক প্রবীণ কংগ্রেস নেতা, রাজ্যসভার সদস্য (নামটি প্রকাশ করা সৌজন্য-বিরোধী) বললেন, "কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে দিল্লির তখ্ত থেকে নরেন্দ্র মোদীকে সরানো সম্ভব নয়। আবার, রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস কখনওই নরেন্দ্র মোদীকে সরাতে সক্ষম হবে না। যে কোনও কংগ্রেস নেতার সঙ্গে একান্তে আলোচনা করুন, দেখবেন, তিনি স্বীকার করছেন, রাহুল গান্ধীকে দিয়ে হবে না। এমন কথাও বহু নিন্দুকে বলেন, মোদীর জন্য সবচেয়ে বড় 'সেফটি ভাল্ভ' হলেন রাহুল গান্ধী।"
২০০৩ সালে কংগ্রেস মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাচ্যুত হয়, তারপর ১৫ বছর বিরোধী দলের ভূমিকায় থেকে আবার সবে তারা ক্ষমতায় এসেছে। এসেছে, কারণ দলের ভোটব্যাঙ্ক অটুট ছিল। রাহুল নয়, কমল নাথ, দিগ্বিজয় সিং, জ্যোতিরাদিত্যের মতো বিশিষ্ট রাজ্যনেতা ছিলেন, যাঁদের রাজ্যস্তরে জনভিত্তি ও সাংগঠনিক শক্তি আছে।
মধ্যপ্রদেশে কোনও 'তৃতীয়' রাজনৈতিক দলও গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর, গত ১৬ মাস ধরে কমল নাথ মুখ্যমন্ত্রী ও দলের রাজ্য সভাপতি। হাইকমান্ড কোনও নেতাকেই রাজ্য সভাপতি করার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। রাজস্থানেও একইভাবে শচীন পাইলট গত ১৬ মাস ধরে উপমুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য সভাপতি। সে রাজ্যেও যে কী ভয়ংকর কলহ চলছে তা আমি পর্যন্ত জানি, আর রাহুল গান্ধী জানেন না?
রাহুল গান্ধী বলতে পারেন যে, তিনি এখন সভাপতি নন, মা সোনিয়া গান্ধীই দলনেত্রী। তবে তাও তো অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে, রাহুল যদি সত্যিই আর সভাপতি হতে না চান, রাজনীতি থেকেই দূরে সরে যেতে চান, তবে সেটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিচ্ছেন না কেন? মধ্যপ্রদেশে কমল নাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল, সিন্ধিয়া বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। তবু সোনিয়া এবং রাহুল এই সম্ভাব্য বিপদকে কেন গুরুত্ব দিলেন না, কেন যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না, সে এক অমীমাংসিত প্রশ্ন।
কংগ্রেসে দলত্যাগ এবং নতুন দলগড়া বিক্ষুব্ধ নেতাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। জ্যোতিরাদিত্যের বাবাও বিক্ষুব্ধ নেতার মতো পৃথক দল গড়েছেন। কিন্তু এক্ষেত্রে জ্যোতিরাদিত্য সরাসরি বিজেপিতে যোগ দিলেন। বাজপেয়ী-আডবাণী জমানায় কে সি পন্থ, সুখরাম, কুমারমঙ্গলমের মতো নেতারা কংগ্রেস থেকে আসেন। কংগ্রেস যেহেতু প্রধান শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, তাই সেই দলকে ভাঙা এবং 'সাম্প্রদায়িক' তকমা লাগানো বিজেপির সার্বিক বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো - এমনটা ছিল আডবাণীর উদ্দেশ্য, যা আগেই বলেছি। মোদী জমানায় যখন শাহিনবাগের পর দেশে ধর্মনিরপেক্ষ বাম-উদার এক রাজনৈতিক পরিসর বিজেপি-বিরোধী প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে, তখন এ ঘটনাও সোনিয়া গান্ধীর কপালে ভাঁজ ফেলবে বইকি!
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে রাহুল গান্ধীকে এক সাক্ষাতে আমি বলেছিলাম, আপনার সমস্যা হচ্ছে, আপনার কোনও অমিত শাহ নেই। রাহুল হেসে আমাকে জবাব দেন, আপনি কি চাইছেন আমি মূল্যবোধ-বিসর্জিত, কৌশল-নির্ভর রাজনীতি করি? পালটা প্রশ্ন করিনি। সত্যিই তো, মূল্যবোধ বিসর্জিত দলভাঙার রাজনীতিকে সমর্থন করি কী করে? কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং তো বলেছেন, বেঙ্গালুরুতে এমএলএ-দের যে বিমানে নিয়ে যাওয়া হয়, তার ব্যবস্থাও অমিত শাহর বিজেপিই করেছে।
গণতন্ত্রের পক্ষে এহেন রাজনীতি 'অসুখ', বা এই রাজনীতি ভবিষ্যতের জন্য ভালো না খারাপ - এসব ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু কেন বিজেপি এমনটা করছে? প্রথমত, এই কৌশল নিছক মধ্যপ্রদেশে আবার শিবরাজ সিংয়ের সরকার গড়ার জন্য নয়। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ জানেন, আগামী লোকসভা নির্বাচনে মোদীকে বরখাস্ত করা তখনই সম্ভব, যখন কংগ্রেস শক্তিশালী হবে। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে শুধু আঞ্চলিক দল এবং অ-বিজেপি দলগুলিকে নিয়ে 'বিকল্প' সরকার গঠন সম্ভব নয়।
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাত, কর্নাটক, হিমাচল প্রদেশ প্রভৃতি রাজ্যে এখনও লড়াই কংগ্রেস বনাম বিজেপির। আর এই রাজ্যগুলিতে লোকসভার আসন সংখ্যাও অনেক। কাজেই সহজ পাটিগণিতের হিসাবেই লোকসভার ম্যাজিক নম্বর হাসিল করতে গেলে বিরোধীদের মধ্যে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসকে অনেক আসন পেতে হবে। জ্যোতিরাদিত্য গোয়ালিয়রে সিন্ধিয়া রাজবংশের উত্তরাধিকারী রাজনেতা। আধা-পুঁজিবাদী, আধা-সামন্তবাদী মধ্যপ্রদেশে আজও মহারাজার জনপ্রিয়তা কম নয়। সে রাজ্যে বহু কংগ্রেস কর্মী আহ্লাদিত।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি যেভাবে রাজ্যে রাজ্যে হারছে, তাতে যে এই ঘটনা বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির তৃণমূল স্তরের কর্মীদের ভীষণভাবে উৎসাহিত করবে, তাতে সন্দেহ নেই। তৃতীয়ত, দেশের আর্থিক হালও শোচনীয়। সংসদ চলছে। ইয়েস ব্যাঙ্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন। এ অবস্থায় কৌটিল্য নীতি অনুসারে প্রতিপক্ষ শিবিরে যদি আগুন লাগিয়ে দেওয়া যায়, তবে সে যুদ্ধ করবে কী করে? এ ঘটনা কংগ্রেসের মধ্যে আরও বিদ্রোহের জন্ম দিতে পারে। রাজস্থানে অশোক গেহলট-বিরোধী শচীন পাইলটের অনুগামীরাও উৎসাহিত।
যে কথাটা দিল্লিতে সবাই জানেন, আলোচনা হয় আড্ডায়, তবু কেউ লেখেন না, সেটা হলো: রাহুল-জ্যোতিরাদিত্য সম্পর্ক। যাঁরা ২৪ আকবর রোডের হাঁড়ির খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এ সম্পর্ক যতটা বাহ্য, ততটা বাস্তবে নয়। রাহুল সংসদে তাঁকে চোখের ইশারা করতে পারেন, কিন্তু সোনিয়া-রাহুল কেউই রাহুলের ইস্তফার পর জ্যোতিরাদিত্যকে দলের দায়িত্ব দিতে রাজি হননি। রাজ্যসভার সদস্যপদ চেয়েছিলেন, তাও তাঁকে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়নি। এই আত্মঘাতী কংগ্রেস, রাহুল গান্ধীর হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া নেতৃত্ব, আর যাই হোক, নরেন্দ্র মোদীর মতো শক্তিশালী জনপ্রিয় নেতাকে সরাতে পারে না। এটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স বা কোয়ান্টাম থিওরি জানার দরকার নেই। এ হল রাজনীতির সহজ পাঠ।