Advertisment

আজাদি শ্লোগান: উত্তর-আধুনিক রামধনু স্বর

এর চেহারা ওপেন-এন্ডেড, বহুস্তরীয়। কোনও বিধিবিদ্ধ খাঁচার ভিতরে এই শ্লোগান আবদ্ধ নয় । স্বাধীন ভারতের জন-আন্দোলনের ধারায় এই শ্লোগান এক জলবিভাজিকার কাজ করছে ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Kanhaiya Kumar, Azadi Slogan

এক্সপ্রেস ফোটো- তাশি তবগিয়াল

“...ভুখমারি সে, আজাদি / হাঁ ভেদভাব সে আজাদি / হাম লেকে রহেঙ্গে, আজাদি / তুম কুছ ভি করলো, আজাদি / হাঁ পুঁজিবাদ সে, আজাদি / হাঁ মনুবাদ সে, আজাদি...” এই শ্লোগান এই মুহূর্তে সারা ভারতে শ্লোগান হিসেবে ভাইরাল। হয়ে উঠেছে ভারতব্যাপী সরকার-বিরোধী তারুণ্যের একমাত্র সর্বজনীন অ্যানথেম।

Advertisment

কয়েক বছর আগে জেএনইউ ক্যাম্পাসে তরুণ ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার এবং তাঁর গুটিকতক কমরেড যে শ্লোগানের জন্ম দিয়েছিলেন, সেই আজাদি শ্লোগান আজ আসমুদ্রহিমাচল ভারতের উদ্বেলিত জনতাকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। বিহারের পাটনা ময়দান থেকে কলকাতার রাজপথ, মুম্বাইয়ের রাস্তা থেকে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া, বেঙ্গালুরুর ছাত্রসমাজ থেকে উত্তরপ্রদেশের হাজার হাজার মানুষের দৃপ্ত মিছিলকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে এই শ্লোগান।

এত কম সময়ের মধ্যে এইভাবে সমাজের কেবল ছাত্রছাত্রী নয়, বরং অন্যান্য স্তরেও এই শ্লোগান জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পিছনের রহস্য কী? কোন ম্যাজিক কাজ করছে এর পিছনে? লক্ষণীয়, এই ভাইরাল শ্লোগানের কোনও স্থির লিরিকগুচ্ছ নেই। বরং প্রত্যেকটি আলাদা জায়গায়, প্রত্যেকটি আলাদা পরিস্থিতিতে সম্মিলিত জনতা এই শ্লোগানের ভিতর জুড়ে দিচ্ছে নিত্যনতুন পংক্তি। আর সেই সংযোজন এই শ্লোগানকে ক্রমশ দীর্ঘায়িত ও বৈচিত্র্যমণ্ডিত করে তুলছে। হয়ে উঠছে আক্ষরিক অর্থেই জনতার শ্লোগান। আজাদি ব্যানার, আজাদি পোস্টার ছাড়াও এ শ্লোগানের শব্দগুচ্ছের এক অমোঘ আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে মানুষের মনে। লোক একাত্ম বোধ করছে এই শ্লোগানের সঙ্গে। আর সেটাই এই শ্লোগানের সবচেয়ে বেশি জোরের জায়গা। এত ভিন্নধর্মী মানুষের একত্র সমাহার সম্ভবও হয়েছে এই শ্লোগানের অন্তর্নিহিত এই প্রসারণের শক্তির জন্য। এমন এক শ্লোগান, যা স্থানভেদে নিজেকে পালটে ফেলে, নিজেকে বিভিন্ন দাবি অনুযায়ী খাপ খাইয়ে নেয় ।

দীর্ঘ আট দশকের কমিউনিস্ট পার্টির উদ্ভাবিত শ্লোগান—‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ নয়, আশির দশক থেকে শুরু হওয়া ‘বোল মেরে ভাই হাল্লা বোল’ নয়, আজাদি শ্লোগানের একটা অন্তর্গত বিশেষত্ব হল এই যে এটা কোনও একক পার্টি বা সংগঠনের উদ্ভাবিত ‘নারা’ নয়।

কোথায় এর পার্থক্য আগের শ্লোগানগুলোর সঙ্গে? দীর্ঘ সাত দশকের সোভিয়েত ও পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসন ও পরবর্তী সময়ে চিন, কিউবা, ভিয়েতনাম বা উত্তর কোরিয়ার খুনে একনায়কতন্ত্রের অভিজ্ঞতার পর ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ শ্লোগানের সারবত্তা আজ অস্তমিত-প্রায়। কমিউনিস্ট পার্টি এবং বামপন্থীরা এই শ্লোগান আজও দিলেও এর গ্রহণযোগ্যতা ৬০ বা ৭০-এর দশকে যা ছিল, মানুষের মনে এই শ্লোগানের যে আসন ছিল তা আজ আর নেই । ‘অজয় দেবগণ অভিনীত ‘হাল্লাবোল’ ছবিটির পাশাপাশি আমাদের মনে পড়বে ‘হাল্লাবোল’ নাটক ও তার স্রষ্টা সফদর হাশমির কথা, যাঁকে কংগ্রেসি গুণ্ডারা প্রকাশ্যে মেরে দিয়েছিল। এই সমস্ত শ্লোগানের বিপ্রতীপে আজ সবচেয়ে উজ্জ্বল আর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে আজ ‘আজাদি’ শ্লোগান।

১৯৯১ সালের সোভিয়েতের পতন আর গোটা ভারতের অর্থনীতি বিশ্বায়নের সঙ্গে জুড়ে যাবার পর প্রথম দুই দশকে খুব দ্রুত এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল ভারতে। এই শ্রেণি সরাসরি নতুন বিশ্বায়িত পুঁজির সন্তান। গোটা দেশে এই নতুন মধ্যবিত্তের সংখ্যা অন্তত ২০ কোটি। তাঁদের চিন্তাভাবনার কাছাকাছি আরও  একটা বিরাট অংশের স্বল্পবিত্ত, কম-আয়ের মানুষজন আছেন। এঁদের রুচি-ভাবনা-চিন্তা-পোশাক-দৈনন্দিন অভ্যাস-মূল্যবোধে একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। আজকের ভোটারদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশই ছাত্র-যুব। এই অংশটি সবচেয়ে বেশি চায় তা হল স্বাধীনতা। যেকোনও ধরনের রেজিমেন্টেশন থেকে মুক্তি।

লক্ষ্য করুন, এঁরা এমনকি কোনও নির্দিষ্ট পার্টি বা সংগঠনের ছত্রছায়ায় থাকতেও রাজি নয়। এঁদের কাছে ‘আজাদি’ শ্লোগান একটা বিস্ফোরণের মত। যা এঁদের মনের সবচেয়ে কাছাকাছি। এঁরা সবধরনের আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চান । তা পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সম্পর্কের দায়বদ্ধতা, দাম্পত্যের চালু নরম্যাটিভিটি সব কিছুই। এঁরা প্রশ্ন করতে চান সবকিছুকে। এঁরা কিন্তু প্রায় কেউই কোনও দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লব বা রাষ্ট্রযন্ত্রের অদলবদল করে ফেলতে চায় না। এরকম নয় যে এরা বিদ্রোহ করে রাতারাতি আগামিকালই দলে দলে মাওবাদী হয়ে গেল এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাইফেল ওঠাল না। এরকম হওয়ার প্রায় কোনও সম্ভাবনাই নেই। কিন্তু এক অমোঘ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এঁদের ইমিডিয়েট প্রাতিষ্ঠানিকতার ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে আসার প্রেরণা জোগাচ্ছে। কানহাইয়া কুমার, উমর খলিদের মধ্যে এই নতুন ছাত্র-যুব সেই নতুন স্বাধীন আইকনকে খুঁজে পাচ্ছেন।

লক্ষ্য করুন, কানহাইয়া কুমার নিজে পরবর্তী সময়ে সিপিআই পার্টিতে যোগ দিলেও তাঁর কথা বলা, অংশগ্রহণ, পাবলিক অ্যাড্রেস সবকিছুই একেবারেই সম্পূর্ণ নিজের মত । ষাট বা সত্তর দশকের পার্টি-কর্মীর আর্কেটাইপ তিনি নিজেও নন। আর এই  নিজস্বতাই তাঁর ইউএসপি। এই নিজস্বতাই আবার ওই ‘আজাদি’ শ্লোগানেরও ইউএসপি। সেকারণেই এই শ্লোগান খুব দ্রুত অসংখ্য দাবিকে নিজের ভিতরে আত্মসাৎ করছে এবং নিজেকে বহরে বাড়িয়ে ফেলতে পারছে। হয়ে উঠছে আরও অনেক মানুষের শ্লোগান। একে আমরা উত্তর-আধুনিক রামধনু স্বর হিসেবে চিহ্নিত করতেই পারি। কারণ, এর চেহারা ওপেন-এন্ডেড, বহুস্তরীয়। কোনও বিধিবিদ্ধ খাঁচার ভিতরে এই শ্লোগান আবদ্ধ নয় । স্বাধীন ভারতের জন-আন্দোলনের ধারায় এই শ্লোগান এক জলবিভাজিকার কাজ করছে । যা একধরনের ডিপার্চার বলা যেতে পারে ।

যদি আশির দশক অব্দি পে-কমিশনগুলোর সঙ্গে ১৯৯৬ এবং ২০০৬-এর কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের পে-কমিশনের পার্থক্য লক্ষ করেন, দেখবেন, বিশ্বায়িত ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাষ্ট্রও চেয়েছে একটা শক্তিশালী আর্থিক বনিয়াদ-সম্পন্ন মধ্যবিত্ত স্যালারিড শ্রেণি গড়ে উঠুক । আজাদি শ্লোগানের প্রায় পুরো ক্লায়েন্টেল এই নতুন পে-কমিশন পাওয়া বাবা-মায়েদের সন্তান। এদের স্টেক-হোল্ড আগের জেনারেশনের চেয়ে ঢের বেশি। এদের পায়ের নীচে মাটিও অনেক বেশি শক্ত। কিন্তু পুঁজিবাদের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারেই এই নতুন মধ্যবিত্ত এইবার আক্রান্ত হতে শুরু করেছে।

২০১৪ সালে অতি দক্ষিণপন্থী বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এই আক্রমণ প্রকট হচ্ছে। ২০১৬ সালের পে-কমিশন খুব বেশি আর্থিক বৃদ্ধি ঘটায় নি। আরও এক ধাপ এগিয়ে নীতি আয়োগের তরফ থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে এটাই ভারতের শেষ পে-কমিশন। এরপর পাঁচ বছর অন্তর প্রয়োজন অনুযায়ী বেতন বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করবে সরকার। ইনফরমেশন টেকনোলজির বাজার ধসে গেছে, প্রায় সবকটা আর্থিক সেক্টরে ব্যাপক ছাঁটাই, মাইনে না-বাড়া, এবং একধরনের ভয়াবহ ‘জবলেস গ্রোথ’ অথবা ‘স্লো গ্রোথ রেট’-এর সামনে দাঁড়িয়ে ওই নতুন মধ্যবিত্ত ঘরের পরবর্তী জেনারেশন অর্থাৎ আজকের তরুণ প্রজন্ম এক সাংঘাতিক চ্যালেঞ্জের শিকার। এই অংশটাই আজাদি শ্লোগানের সবচেয়ে বড়ো সাবস্ক্রাইবার। এঁরাও চূড়ান্ত স্বাধীনচেতা মন নিয়ে একের পর এক গণ-আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন। এঁরাই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই নতুন আন্দোলনের নতুন শ্লোগানের মশাল।

ঠিক এর উলটো পিঠেই রাষ্ট্র আবিষ্কার করেছে এক নতুন আক্রমণাত্মক বিশেষণ—‘আরবান নকশাল’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে এঁদের। যদিও ধ্রুপদী নকশালপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে এদের প্রায় কোনও যোগ নেই। এখানেই আজাদি শ্লোগান আর আরবান নকশাল চিহ্নিতকরণের অন্তর্গত যোগ—উত্তর-আধুনিক ভারতের নতুন গণ-সচেতনতার অভিজ্ঞান।

(অর্ণব সাহা শেঠ আনন্দরাম জয়পুরিয়া কলেজের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment