Advertisment

কার্ল মার্ক্সের মূল অর্থনৈতিক মতবাদের পূনর্মূল্যায়ন

ক্যাপিটালিজম বা পূঁজিবাদ সম্পর্কে মার্ক্সের বিশ্লেষণ বা অর্থনৈতিক সাধন সম্পর্কে ব্যাখ্যায়  সম্পর্কে যা জানি তার থেকে বলা কি সম্ভব যে তিনি ঠিক না ভুল ছিলেন? লিখছেন নিলস জিমারমান

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
KARL MARX

কার্ল মার্ক্সের মূল অর্থনৈতিক মতবাদের পূনর্মূল্যায়ন। (ছবি- চিন্ময় মুখোপাধ্য়ায়)

নিলস জিমারমান

Advertisment

এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে গেলে আমাদের প্রথমে দেখতে হবে কোন একটি মূল মতবাদের ভিত্তিতে তাঁর থিয়োরিগুলি রচিত কিনা, এবং সেই মতবাদটি কি ভুল না ঠিক। “দাস কাপিটাল”এর দ্বিতীয় খণ্ডে এই ধরনের একটি মতবাদ, বাস্তবিকই আছে, যা মার্ক্স বাস্তব অর্থনীতির প্রথম খণ্ডের থেকে বেশী পরিশীলিত বিশ্লেষণের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন। বাজারের প্রধান অংশীদার অর্থাৎ, শ্রমিক (উপভোক্তার ভূমিকায়), পুঁজিবাদী, পুঁজিপতি, মহাজন এবং ব্যবসায়ীদের(খুচরা ও পাইকারী) মধ্যে কিভাবে অর্থ হাতবদল করে তার একটি নকশা আঁকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মতবাদের বিশাল ইমারতটার ভিত্তিই হল একমাত্র শ্রমিকরাই উৎপাদনকারী, অতএব “অতিরিক্ত মূল্যের” উৎপাদনকারীও। অতিরিক্ত মূল্য অর্থাৎ উৎপাদনের খরচ এবং তার মূল্যের মধ্যে পার্থক্য।    

যদি এই মূল মতবাদটিই ভুল হয় তাহলে মার্ক্সের সম্পূর্ণ থিয়োরিই ভুল, এবং সেই থেকে উদ্ভূত আর্থ-রাজনৈতিক মতবাদটিও ভুলঃ অর্থাৎ, ‘প্রলেতারিয়েত’এর হাতে উৎপাদনের সমস্ত মাধ্যম থাকবে আর তাহলে সব ঠিক থাকবে। এই মতবাদ যতটা না ঠিক, তার থেকে অনেক বেশীমাত্রায় ভুল অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে মার্ক্সের অতিরিক্ত মূল্যের মতবাদটি ঠিকের থেকে অনেক বেশী করে ভুলই।

যদি এটা ধরা যায় যে, পুঁজিপতিরা শ্রমিকদের, সামগ্রিকভাবে কারখানায় উৎপাদিত বস্তুর বিক্রয় থেকে পাওয়া আয়ের থেকে থেকে কম অর্থ প্রদান করে তবেই মতবাদটি ঠিক। কিন্তু এতে কিছু মূলগত সমস্যা আছে। অর্থাৎ এই মতবাদটি বলার চেষ্টা করছে যে কারখানার পারিশ্রমিক সংক্রান্ত খরচ এবং বাজারে বিক্রয়ের পর অর্জিত আয়ের মধ্যে যে পার্থক্য সেটি কারখানার শ্রমিকদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া “অতিরিক্ত মূল্য”।

প্রথমেই বলা উচিত যে, কোন কিছুর বাজার মূল্য শুধুমাত্র উৎপাদনের খরচ থেকে উৎপন্ন নয়। উদাহরণ স্বরূপ, এক আউন্স খাঁটি সোনার মূল্য এমনি সাধারণ পথিকের কুড়িয়ে পাওয়া হলেও একই থাকবে অথবা পরিসশোধনাগারে কম বেতন প্রাপ্ত শ্রমিকদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে পাথর ভেঙে পাওয়া সোনার ছোট ছোট কণা জুরে তৈরী হলেও একই থাকবে। প্রথম ক্ষেত্রে, সার্বিক আয় বাস্তবে অনেক বেশী। কিন্তু শোষিত শ্রমিকের কোন অস্তিত্ব নেই এখানে। বাস্তবে, কোন উৎপাদন যোগান শৃঙ্খলে শ্রমিকের অবদান তার মূল্যের একটি মাত্র উপকরণ। এ ছাড়াও আরও অনেক অবদানকারী আছে।

প্রথমত, প্রকৃতির অবদান। যেমন, জেলেরা মাছ উৎপাদন করে না, প্রকৃতি করে। দ্বিতীয়ত, কারখানার ম্যানেজাররা, যারা কারখানার মালিকও হতে পারে অথবা অংশীদার, এবং তাদের অবদানও গুরুত্বপূর্ণ। উৎপাদনের ক্ষেত্রে সংগঠন এবং প্রবন্ধনের গুরুত্ব অপরিসীম। তৃতীয়ত, মেশিনের অবদান আছে, যা হয়তো এই উৎপাদন পদ্ধতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। মেশিনের নকশায়, মানুষের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বিকাশের লব্ধ এবং সংগৃহীত জ্ঞান বর্তমান। একটি সম্পূর্ণভাবে যন্ত্রচালিত কারখানার কথা চিন্তা করুন, যেখানে কোন শ্রমিক নেই, অথবা শুধুমাত্র কিছু প্রযুক্তিবিদ রয়েছেন যাঁরা মেশিনের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন। এক্ষেত্রে শ্রমের অতিরিক্ত মূল্য কোথায়? এই স্বয়ংচালিত কারখানার সামগ্রিক মূল্য মূলত বিজ্ঞানের সাধকদের মধ্যে লুকিয়ে আছে যারা বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলী আবিষ্কার করেছেন এবং তার সঙ্গে এক বিশাল সমাজ ব্যবস্থা, যার মধ্যে  স্কুল, প্রযুক্তি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যা বছরের পর বছর ধরে লব্ধ জ্ঞান এবং প্রুযুক্তিগত দক্ষতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে কোনটারই সঙ্গে কারখানার পারিশ্রমিকের কোন সম্পর্ক নেই। চতুর্থত, বাজার নির্দিষ্ট প্রভাবের অবদানও আছে। কোন বিশেষ উৎপাদিত বস্তু কোথায় এবং কখন বিক্রি হচ্ছে তার উপর তার মূল্য অনেকটাই নির্ভর করে। তাৎক্ষনিক চাহিদার উপর নির্ভর করে ক স্থানের থেকে খ স্থানে অথবা অ সময়ের থেকে আ সময়ে বিক্রয় মূল্য দ্বিগুণ হতে পারে। এর সঙ্গে কারখানার উৎপাদন পদ্ধতি, তার পারিশ্রমিক সংক্রান্ত খরচ ইত্যাদির কোন সম্পর্ক নেই। পঞ্চমত, ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং নেটওয়র্কের উপর অনেকটাই মূল্য নির্ভর করে। একটি পুঁজিবাদী কর্পোরেশন ক্রেতা, বিক্রেতা, বিজ্ঞাপনদাতা, যোগানদার, নিয়ন্ত্রক এবং অন্যান্য অংশীদারদের দ্বারা গঠিত একটি জটিল তন্ত্রের দ্বারা গঠিত। কারখানার প্রলেতারিয়ান শ্রমিক এর মধ্যে কোনটিতেই কোন অবদান রাখে না।

অতএব দাড়িয়াল অর্থনীতিবিদের প্রান্তিক পূজন থেকে সাবধান

 মার্ক্সের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের দেড়শো বছর পরে তার বিশ্লেষণে প্রচুর কালি ও শ্রম খরচ হয়েছে। তিনি পুঁজিবাদ এবং তার কার্যপ্রক্রিয়ার উপর সতর্ক সমালোচনাকারীদের মধ্যে প্রথম। এবং যদিও তাঁর বেশ কিছু মতবাদ ভুল ছিল, তবুও পুঁজিবাদের কার্যপ্রক্রিয়ার দ্বারা উদ্ভূত ভারসাম্যহীনতার প্রতি আঙুল তোলাতে কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন না। যেমন, মহাজন এবং তেজারতদের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ, যারা কোন পরিশ্রম এবং যথেষ্ট যোগ্যতা ছাড়াই সুদখোরীর মাধ্যমে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে আসে। কিন্তু তাঁর ‘শ্রমের অতিরিক্ত মূল্য’ গবেষণাটি সমস্ত আঙ্গিকগুলিকে সচেতনভাবে হিসাবে আনে না এবং এটি ভুল। একইভাবে, পুঁজিবাদ ভিতর থেকে ফাঁপা এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যায়নের চাপে একদিন ধসে পড়বে, তাঁর এই মতবাদও ঠুনকো। মানদণ্ডের অর্থনীতি, প্রাথমিক অবদানকারীর ফায়দা, ব্র্যান্ডের প্রতি উপভোক্তার নিষ্ঠা, নেটওয়র্কের প্রভাব এবং অন্যান্য কারণগুলি, যা সব মিলিয়ে একটি নিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে যেখানে সামান্য কয়েকটি কর্পোরেশনের হাতেই বাজারের সর্বাধিক ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে। এর ফলে এই সমস্ত কোম্পানি যাদের হাতে অধিকাংশ ক্ষমতা থাকে, তারা, এমন কি সম্পৃক্ত বাজার অর্থনীতিতেও নিয়মিত লাভের মুখ দেখতেই থাকে। অর্থাৎ, মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বলেছিলেন যে, ‘পুঁজিবাদ নিজেই নিজের অসঙ্গতির কারণে ধ্বসে পড়বে’ সেটি ঠিক নয়।

প্রোলেতারিয়েত জীবনের একটি বিশেষ অবস্থা, একটি শ্রেণি নয়।

দেখা যাচ্ছে যে ‘প্রলেতারিয়েত’রা উৎপাদনের পদ্ধতি দখল করে নিতে পারে, এবং তারপর একটি শ্রেণি হিসাবে ‘উৎপাদনের সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে’ সবকিছু সমান ভাবে ভাগ করে নেবে, মার্ক্সের এই ইউটোপিয়ান ভাবনাটাও ভুল ছিল। এর থেকে বেরিয়ে আসছে যে যে কোন মানব শ্রেণির জন্য নেতৃত্ব এবং সঠিক প্রবন্ধনের প্রয়োজন আছে। এবং নেতারা প্রতি ক্ষেত্রেই একটি বিশেষ ‘শ্রেণি’তে পরিণত হয়, যারা বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। কম্যুনিস্ট দেশগুলির ইতিহাস থেকেই দেখা যাচ্ছে বিপ্লবী প্রলেতারিয়ান নেতা খুব চট করেই একটি আপাত পুঁজিবাদী শোষকে পরিণত হয় ক্ষমতার প্রভাবে। অবশ্য মার্ক্সের থেকে শেখারও আছে অনেক কিছু। তাঁর বিশ্লেষণ ও মতবাদ অবশ্যই আমাদের শ্রমিক সমবায় গড়ে তুলতে শিখিয়েছে, যা লভ্যাংশ ভাগ করে নেওয়া এবং দীর্ঘকালীন কর্মীদের মধ্যে মালিকানা ভাগ করে নেয়ার মতো পন্থা বার করে দেয় যা শেষ পর্যন্ত শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে বিভেদ মুছে দিয়ে অর্থনৈতিক সমতা রক্ষা করে।

মালিকানা, আবর্তন এবং পুঁজির জমা হওয়া

মার্ক্সের বিশ্লেষণ, অর্থের আবর্তন, এবং অর্থনীতির বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে তার জমা হওয়া সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা দেয়। জোর্দা এবং তাঁর সহকর্মীদের দ্বারা প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণা পত্র “সার্বিকরূপে লাভের হার, ১৮৫০-২০১৫”, যা গত দেড়শো বছরের তথ্যের ভিত্তে অর্থনীতিবিদ, অস্কার জোর্দা (ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব সান ফ্রান্সিস্কো), ক্যাথারিনা নোল (জার্মান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক) এবং তাঁদের বহু সহকর্মীর দ্বারা নির্মিত, দেখাচ্ছে যে, অর্থনৈতিক পুঁজি দ্রুত নিজের আশেপাশেই ঘনীভূত হয় গাণিতিক নিয়মেই। কঠিন পুঁজি করের অনুপস্থিতিতে মহাজনরা (সম্পত্তির মালিকানা ভাড়ায় দিয়ে যারা আয় করে) সারা বিশ্বের সামগ্রিক পুঁজির বেশ বড় অংশ খুব পরিশ্রম ছাড়াই নিজেদের পকেটস্থ করে, শুধুমাত্র প্রাথমিক অর্থের যোগানের উপর ভিত্তি করে ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক সম্পত্তিতে অক্রিয়ভাবে লগ্নি করে।

এই বিশ্লেষণটি এই প্রস্তাবনাকেই সমর্থন করে যে, মহাজনদের অর্থ  আংশিকভাবে পুনরায় আবণ্টন করা সম্ভব, যেমন সংগৃহীত অর্থের উপর কর চাপিয়ে জনগণের জন্য পুঁজির ভাণ্ডার সৃষ্টি করে। এর ফলে কিছু পুঁজি পুনর্বন্টিত হবে আর বাকি পুঁজি সক্রিয় আবর্তন করানো সম্ভব হবে, যা সামগ্রিক কার্যকরী চাহিদা এবং সামগ্রিক উৎপাদন এবং বণ্টনের সাম্যের উপর সুপ্রভাব সৃষ্টি করবে। কিন্তু মার্ক্সের থেকে পাওয়া সবথেকে মূল্যবান শিক্ষা হল প্রাচীনপন্থী ধর্মীয় বিশ্বাসকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে ব্যক্তিগত সততার উপর বিশ্বাস জাগানো। যতই প্রতিভাবান হোন না কেন, মার্ক্স শুধুমাত্র একজন অর্থনীতিবিদই ছিলেন, ঐশ্বরিক কোন দেবদূত নন। যদিও দেখেছি যে, নিজের ভাবনা চিন্তায় তিনি সবসময় ঠিক, এমন একটা ধারণা তাঁর ছিলই। আর সেখানেও তাঁর ভুলই হয়েছিল।

Advertisment