৩৭০ ধারা খর্ব করার মাধ্যমে জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনডিএ সরকার। এর ফলে হিন্দুত্ববাদী দলের ৭০ বছরের পুরনো হিন্দুত্ববাদী দলগুলির অ্যাজেন্ডা পূরণ করা হয়েছে - যারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জম্মু কাশ্মীরের ভারতে অন্তর্ভুক্তি একদিন বাস্তবে পরিণত হবেই। ২০১৯ সালের নির্দেশিকা ১৯৫৪ সালের নির্দেশিকাকে রহিত করেছে, এর মধ্যে রয়েছে ৩৫এ ধারাও - যে ধারার বলে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া ছিল। ৩৫এ ধারা নাকচ হয়ে গেছে। ৩৭০ ধারা বলবৎ থাকলেও, কার্যত তা মৃত। সরকার একইসঙ্গে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য পুনর্সংগঠন বিলের মাধ্যমে রাজ্যকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করেছে। এর মধ্যে জম্মু কাশ্মীরে বিধানসভা থাকবে, লাদাখে তাও থাকবে না।
জম্মু কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পিতাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত ছিল না। দেশ তৈরির ক্ষেত্রে এ ভাবনা ছিল অপরিহার্য। এ ভাবনার মাধ্যমে মুসলিম-প্রধান রাজ্যের ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ রাজ্যের জনবিন্যাসের ক্ষেত্রে অনন্যতা সুরক্ষিত হয়েছিল সংবিধান দ্বারা। এর মাধ্যমেই ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবনাকে জোরদার করা হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা ইতিহাসের পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে কোনও ক্ষুদ্র বিষয় নয়, যা জনবিন্যাস বদলে দিতে পারে, আনতে পারে নয়া ভারতের ধারণা - যে ধারণার উপর নরেন্দ্র মোদীর ছাপ স্পষ্ট। এই বদলগুলি ঐতিহাসিকই, ওরা এবার নেহরুর ভারতের ধারণার ওপর লাল দাগ টেনে দিল।
আরও পড়ুন, কেন আমাদের দেশে এখন মোট ২৮টি রাজ্য
কিন্তু নয়া ভারতের ধারণাটা ঠিক কী, এভাবে ওরা কেমন ভারত তৈরি করতে চাইছে? ইতিহাসে এও লেখা থাকবে, কেমন করে এই বিশাল বদল ঘটানো হলো। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এরকম কোনও উদাহরণ নেই যেখানে কোনও সরকার রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক কোনও সিদ্ধান্ত এত গোপনীয়তার মাধ্যমে গ্রহণ করেছে। যেভাবে সংসদের অধিবেশন চলাকালীন এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে, সেটা সম্ভবত এ কারণেই যে বিজেপি ভাবছে যেহেতু তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে, ফলে তারা এভাবেই কাজকর্ম চালাতে পারে। কিন্তু এই গোটা প্রকল্পটিই গণতান্ত্রিক ধারা ও পদ্ধতির পরিপন্থী।
উপত্যকায় আরও বেশি বেশি করে নিরাপত্তাবাহিনী মোতায়েন ও অমরনাথ যাত্রা বাতিলের পিছনে যে পাক সন্ত্রাসের ছকের কথা বলা হয়েছে, তা নিয়ে যে কোনও সরকারি আধিকারিকই কিছু জানতেন না, সে বিষয়টিও কৌতূহলের উদ্রেক করে। ১৯৫৩ সালে শেখ আবদুল্লার গ্রেফতারির পর এই প্রথমবার দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, যাঁরা মূলধারার রাজনৈতিক দলের নেতাও বটে, তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন, ‘জম্মু-কাশ্মীরকে খণ্ডিত করে জাতীয় সংহতি রক্ষা করা যায় না’, সরব রাহুল
কাশ্মীর ইস্যু কাশ্মীরিদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী, যে ভাবনার অংশীদার হয়েছিলেন পরবর্তীকালে কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংও, তারই বহমানতায় ২০১৫ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত পিডিপি-র সঙ্গে বিজেপির জোট হয়েছিল। সে জোট ভেঙে গেছে। বাজপেয়ীর ইনসানিয়ত, জামুরিয়ত, কাশ্মীরিয়তের কথা মোদী গত বছরই বলেছিলেন বটে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তিনি এবং তাঁর বিশ্বস্ত সৈনিকরা মনে করেন, কাশ্মীরের মানুষের ভবিষ্যৎ স্থির করার জন্য তাঁদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন নেই, তাঁরা মনে করেন, বিরোধীদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমেই দমন করা সম্ভব।
এবার কাশ্মীরে যে রাজনৈতিক ও আইনি প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে, সরকার কীভাবে তার মোকাবিলা করে - এর উপর দেশের অনেক কিছু নির্ভর করছে। ৩৭০ ধারায় উল্লিখিত স্বায়ত্তশাসনের অধিকারই যদি কাশ্মীর সমস্যার কারণ হতো, সরকার এবার তা থেকে মুক্ত। মুক্ত শুধু এ কারণে নয় যে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসনের সাংবিধানিক নিশ্চয়তা আর রইল না, এবার রাজ্যগুলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের আওতায় এনে সর্বশক্তিমান লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
আরও পড়ুন, বিজেপির কাশ্মীর যোগ, সৌজন্যে শ্যামাপ্রসাদ
এআইডিএমকে এবং টিআরএসের মত আঞ্চলিক দলগুলি, যারা সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ সমর্থন করেছে, তারা একবার ভেবে দেখতে পারে যে তামিলনাড়ুর মত রাজ্য, যেখানে আঞ্চলিকতার আবেগ পুরোমাত্রায় বিদ্যমান, তাকে যদি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়, তাহলে কী হবে। কিন্তু বিরোধীদের কাছে চ্যালেঞ্জ হলো - এটি কোনও দূরবর্তী ভাবনার বিষয় আর রইল না। বিজেপি এবার তাদের কোর ইস্যুগুলিকে যখন লাগু করতে শুরু করে দিয়েছে, তখন সমস্তটাই বাস্তব হয়ে উঠছে।
উপত্যকায় চিরকালের জন্য সমস্ত কণ্ঠস্বর অবরুদ্ধ করে রাথা সরকারে উদ্দেশ্য হতে পারে না। শুরু করতে হবে ওমর আবদুল্লা, মেহবুবা মুফতি এবং সাজ্জাদ লোনের মুক্তি দিয়ে। এর পর কাশ্মীর ও জম্মুতে অন্য নেতাদেরও মুক্তি দিতে হবে। উপত্যকায় স্বাভাবিক যান চলাচল শুরু করতে হবে, টেলি যোগাযোগ ফের স্বাভাবিক করতে হবে। কাশ্মীর নিয়ে যা করা হয়েছে তা যে কেবল সংখ্যা বা বন্দুকের নলের জোরে নয়, সে কথা প্রমাণ করার রাজনৈতিক দৃঢ়তা দেখাতে হবে সরকারকে। এ ছাড়াও এলাকার গতিপ্রকৃতির বদল নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে, মোকাবিলা করতে হবে তারও।
Read the full story in English