এই মুহূর্তে কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের মূল ভূখণ্ড সহ সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন। পুরোপুরি অবরুদ্ধ, কোনও ধরনের কোনও যোগাযোগ নেই, সংবাদমাধ্যম শুধু একটি নির্দিষ্ট অংশে প্রবেশাধিকার পেয়েছে।
সংসদে যখন বিতর্ক চলছে, ফারুক আবদুল্লা নেই, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন তিনি নাকি মুক্ত, স্বেচ্ছায় আসেননি। ফারুক বলছেন, তিনি নাকি গৃহবন্দি। বাস্তবত, সমস্ত সংসদীয় দলের নেতৃত্ব ও কর্মীরা এখন সেখানে বন্দি।
অনুচ্ছেদ ৩৭০ নিয়ে, ৩৫ এ নিয়ে আমরা সবাই যখন বিতর্কে, প্রতিবাদে বা সমর্থনে মুখর, তখন কাশ্মীর উপত্যকার মানুষের মত জানতে পারা যাচ্ছে না, রাজ্যের মর্যাদা হারিয়ে, তাঁরা কি আত্মহারা? উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাবে বলে আনন্দিত? সামরিক বাহিনীর দ্বারা আবৃত, সর্বত্র কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে তাঁরা এমনকি গণতন্ত্রের আস্বাদ উপভোগ করছেন! বা ৫ অগাস্ট রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় "উপত্যকার যুবকদের বলছি, আপনারা মোদী সরকারের উপর আস্থা রাখুন। অন্য দলগুলোর কথা শুনবেন না। (কারণ তারা তাদের নিজস্ব রাজনীতির কারণে মিথ্যা বলছে)।"
আরও পড়ুন, ছেঁড়া-খোঁড়া ইতিহাস, তালি দেওয়ার ভবিষ্যৎ
উপত্যকার যুবকরা কি স্বস্তি পাচ্ছেন নেতিবাচক কিছু হবে না! যতক্ষণ না তাদের অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের উত্তর আমরা পাচ্ছি না। বরং উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হচ্ছে, কী চলছে সেখানে?
রাজনৈতিক দল, সরকার পক্ষ কি খবর রাখেন তিন দশক ধরে চূড়ান্ত সামরিকীকরণের আজ কাশ্মীর উপত্যকায় প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে একজন মানসিক ভারসাম্যহীনতার শিকার- ক্ষোভ, ঘৃণা ও আগ্রাসনের মেজাজ তাদের আচরণে স্পষ্ট। নিরাপত্তার নামে এই দমন পরিবেশ তাদের সুপার প্রেশার কুকারের মধ্যে রেখেছে। যে কোনও দিন কিছু ঘটে যেতে পারে। এসব শুধু ৩৭০ বলে ধামাচাপা দেওয়া যাবে না।
ইউরোপে একসময়ে রক্তক্ষয়ী দমন পীড়নের মধ্যে দিয়ে নিরঙ্কুশ জাতিরাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল, ফ্রান্সে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে নৃশংস গণহত্যার মধ্য দিয়ে ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী অঞ্চল, ভেন্ডি কে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, তা সেখানকার মানুষ আজও স্মরণ করে।
১৯৪৭ সালে বর্তমান ভারত সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বোঝাপড়া, বিশ্বাস ও চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদার শর্ত নিয়ে ভারতে যোগদান করেছিল। প্রবঞ্চনা করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে, সংসদ চলাকালীন অবস্থায় সংসদকে অন্ধকারে রেখে, রাষ্ট্রপতির সিলমোহর লাগিয়ে ৩৭০ ও ৩৫এ কার্যত বাতিল করা হল।
আরও পড়ুন, জম্মু কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা হারিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত: একটি টাইমলাইন
সরকারি যুক্তিগুলো গ্রাহ্য নয়। এই অনুচ্ছেদের মার্জিনে সাময়িক লেখা থাকলেও ঐতিহাসিক নানা কারণে (কে কতখানি দায়ী তা আপাতত উহ্য রেখে) এই অনুচ্ছেদ স্থায়ী রূপ নিয়েছিল - এ মত সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৬৮ সালে থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে একাধিক বার জানিয়েছে। সকল দারিদ্র্য, অভাবের মূলে রয়েছে ৩৭০ অনু্চ্ছেদ- এ যুক্তি ধোপে টেঁকে না। নানা পরিসংখ্যান থেকে দেখা গিয়েছে, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীপুরুষের ন্যায় ও সমতার মত ১০টি নিরিখে জম্মু কাশ্মীর দেশের দ্বিতীয় স্থানে। বিহার বা উত্তর প্রদেশের থেকেও বেশি তাদের রাজ্যের নিজস্ব উৎপাদিত সম্পদ।
বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ যাবতীয় সমস্যার মূলে। তাই? সমস্ত গবেষণাধর্মী লেখায় আজ স্বীকৃত যে, ১৯৫৪ থেকে শুরু করে ১৯৮০-র দশকে ৩৭০ অনুচ্ছেদের সমস্ত বাস্তব গুরুত্ব ও মর্মবস্তু শেষ হয়ে গিয়েছে, ছিল শুধু প্রতীকী মূল্য। তাহলে তা কী করে সব অনিষ্টের মূলে হয়? কোন অনুচ্ছেদের কারণে সারা ভারতের কেন্দ্রীয় সংস্থায় কয়েক লক্ষ শূন্য পদ ছয় বছর ধরে পূরণ করা হয়নি? পুরাতন বোস্টনের মত কোন অনুচ্ছেদের কারণে ভারত ধীরে ধীরে লিঞ্চিংস্থান হয়ে উঠছে? সারা ভারতে চরম বেকারত্ব কোন অনুচ্ছেদের কারণে? শুধু পাকিস্তানের অঙ্গুলিহেলনে কাশ্মীরের মানুষ চলছে তিন দশক ধরে? তাদের নিজস্ব চেতনা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বলে কিছু নেই? তাহলে এখন মৃত্যু উপত্যকা করে দেওয়া হল কেন?
আজ যাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে, সেই মেহবুবা মুফতির সঙ্গে জোট সরকারে বিজেপি ছিল ঠিক দু বছর। কই তখন তো এই লুঠ করা পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত করতে তাদের কোনও কুণ্ঠা পর্যন্ত হয়নি।
ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র্যকে স্বীকার করে নেওয়া। তাই শুধু ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ নয়। ৩৭১ ক অনুচ্ছেদে নাগাল্যান্ড, ৩৭১ জি অনুচ্ছেদে মিজোরামকে বিশেষ অধিকার দেওয়া রয়েছে। সে অধিকার অনুসারে জমি কেনাবেচা, হস্তান্তরসহ একাধিক বিষয়ে সংসদের আইন সেখানে কার্যকর হবে না। বা পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফশিলে উপজাতিভিত্তিক অঞ্চলগুলোতে এই জাতীয় বিশেষ অধিকার স্বীকার করে নেওয়া আছে।
কই সেখানে তো এক দেশ, এক আইনের কথা উঠছে না! এমনকী নাগাল্যান্ডের রাজ্যপাল ৭ অগাস্ট নজিরবিহীনভাবে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আশ্বস্ত করেছেন যে নাগাল্যান্ডে এর কোনও প্রভাব পড়বে না। তাহলে কি জম্মু-কাশ্মীর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একমাত্র রাজ্য বলেই এই আক্রমণ কেবলমাত্র ব্রুট সংখ্যাগরিষ্ঠতার দৌলতে? আমার উত্তর - হ্যাঁ। একদিকে লাদাখের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দেওয়া হল বলে সোচ্চারে বলা হচ্ছে, অন্যদিকে কাশ্মীরি মানুষের স্বায়ত্তশাসনের, বিশেষ মর্যাদাসহ ভারতে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে এক কলমের খোঁচায় নস্যাৎ করা হল।
আরও পড়ুন, জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা আসলে কী? কোথা থেকে এল এই আইন?
৩৫ ক তুলে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে কাশ্মীর উপত্যকাকে হিন্দুকরণের পরিকল্পনাকে রূপায়িত করা হবে। নেতারা হুল্লোড় করবেন, মিষ্টি খাবেন, টুইটারে বলবেন, "উফ জীবদ্দশায় এসব ঘটবে আমরা ভাবতেও পারিনি।" বৃহত্তম গণতন্ত্রের আড়ালে স্বৈরতন্ত্রের এই উত্থান ও উল্লাস ভবিষ্যতের জন্য শুভ তো নয়ই, বরং ভয়ংকর।
কারণ এগুলো দেশের মঙ্গলের জন্য করা হচ্ছে না। এগুলি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শের বলপূর্বক রূপায়ণ। যে মতাদর্শ ১৯৫০-এর দশক থেকে বলে আসছে বহুমুখী সংস্কৃতি ভারতের পক্ষে বিপজ্জনক, বলে আসছে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভারতের যাবতীয় অনিষ্টের মূলে, তারা অশুভ। কখনও নীরবে, কখনও সশব্দে ওই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়িয়ে আসছে বিরামহীনভাবে দশকের পর দশক জুড়ে। ঘৃণা কতদূর, কত গভীরে বিষফলের মত ঢুকে গিয়েছে তা বোঝা যায় যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়, কাশ্মীরে জমি কিনে শূকরের মাংসের দোকান খুলব। মেরে জাতীয়তাবাদ শেখানো। জয় শ্রীরাম শ্লোগান আজ মারের হাতিয়ার।
পাশাপাশি সংবিধান বদলে দেব, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে একরাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলব - এই ভাবনা জনসংঘ, বিজেপি তথা সংঘপরিবারের মতাদর্শের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনী বিজয়ের পর দেশের কেন্দ্রীয় শাসক দল ধরে নিয়ে নিয়েছে এগুলি এখন জনমানুষের দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত।
আচ্ছে দিন আনার চেষ্টা আজ আস্তাঁকুড়ে। মৌল সমস্যাগুলি সমাধানের ক্ষেত্রে কোনও চেষ্টা নেই। অর্থনীতির চূড়ান্ত বেহাল অবস্থা। অতএব ক্ষোভকে ঘুরিয়ে দাও, ধর্ম ও আবেগ ঘৃণা ও বিদ্বেষের আবহে নিমজ্জিত রাখো নাগরিকদের, সহনাগরিকদের নির্বিচার হত্যার প্রতিরোধ কোর না, অধিকার রক্ষার সপক্ষে কিছু বোল না। সংশোধিত ইউএপিএ-র খাঁড়া ঝোলানো রয়েছে, অতএব সাবধান। মনে রেখো সুধা, সোমা, রোনা, ভারভারা রাওদের হাল।
এঁরা বিশ্বাস করেন মাকিয়াভেলির প্রিন্সের সেই প্রবচনে, To be feared is safer। অর্থাৎ ডরনা জরুরি হ্যায়।
কাশ্মীরের মানুষের মুখে ফেরে কলহনের রাজতরঙ্গিণীর কথা, Kashmir can be conquered by force of spirituality but never by force of Soldiers.
ইতিহাস থেকে কি শিক্ষা নেবেন এঁরা? ইতিহাস থেকে কী শিক্ষা নেবেন এঁরা?
হেগেল অবশ্য বলবেন, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না।
(সুজাত ভদ্র মানবাধিকার আন্দোলনের সংগঠক, মতামত ব্যক্তিগত)