প্রথম কাশ্মীর গিয়েছিলাম ১৯৮০, বেড়াতে। শ্রীনগরে পরিচয় হয়েছে অলফাজ বলে এক সাংবাদিকের সঙ্গে। খুবই উৎসাহী আমরা যেন সব ভালো ভালো জায়গাগুলো ঠিকমত দেখে নিতে পারি। আমরা নিজেদের জ্ঞানমত বলেছি নাগিন লেক দেখতে যাবার ইচ্ছের কথা। নাগিন লেক?-অলফাজ একটু বিভ্রান্ত। ঐসা তো কুছ ইয়হাঁ হ্যায় নহীঁ! আমরাও অবাক, এরা শ্রীনগরের লোক, এত বিখ্যাত নাগিন লেক এর নামই জানে না! শুনে এসেছি ডাল লেকের মধ্যে দিয়ে নাকি সেই হ্রদে পৌঁছনো যায়। অলফাজ ওর অন্য সহকর্মী, বন্ধুদের কাছে জানতে চাইছে, ‘কী ভাই, নতুন কোনো নাম দেওয়া হয়েছে কোনো জায়গার?’ আরো কিছু বিভ্রান্তির পর খানিক স্পষ্ট হল উচ্চারণ সমস্যা, সে বিশাল জলক্ষেত্রের নাম নগীন মানে সুগভীর। যে অর্থে অমরনাথ যাবার পথে শীর্ষে অবস্থিত একটি জলাশয়ের নাম ‘শীষনগ’। শেষ বা প্রথম কোনো নাগের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই নেই।
সেবারের সেই যাত্রায় আমার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য ছিল অমরনাথ। আমার পুত্রের বয়স দু’বছর। নানাজনের নিষেধ আর সাবধানবাণীর কাছে পরাস্ত মা ছেলের সঙ্গে পহলগাঁওয়ে থাকাই মনস্থ করলেন। অমরনাথ যাত্রা করা আর সে জায়গা দেখতে পাওয়া এক পরম অভিজ্ঞতা। সত্যিই। কিন্তু সেবারের পহলগাঁও-ও আমার কাছে ছিল এক পরমপ্রাপ্তি। দুই অসমবয়সী প্রাণেরবন্ধুর নানাবিধ অ্যাডভেঞ্চার ভরা দিনযাপন। তার মধ্যে ছিল কাঁটাতার টপকে ওপাশের পাহাড়ে যাবার চেষ্টা করে পা কেটে সেই ঘোড়া-চরানোর মাঠের ময়লা লেগে ‘আমার তো ধনুষ্টঙ্কার হবেই, কাল সকাল থেকে আমার এই বাচ্চাটাকে কে দেখবে’ সেই আশঙ্কায় বাড়ির ঠিকানা, এর পরিচয়, তীর্থযাত্রীদল ফিরে আসবার পর একে ঠিকমত তাদের হবালে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ, সব কিছু সবিস্তারে কাগজে লিখে রাখা ইত্যাদিও।
নাগরিকত্ব বিলের মূল্য দিতে পারবে তো ভারতবর্ষ?
যা হোক, সেটার দরকার পড়েনি অবশ্য। কিন্তু সেই পাঁচদিন আমরা দুইবন্ধু সকাল বিকেল একবার করে বেড়াতে যেতাম পহলগাঁওয়ের একমাত্র রাস্তায়, যেটা বাজার পার করে একটা ছোট্ট দোকানে গিয়ে শেষ হত। সে ছিল একটা গল্পের দোকানের মত। বড় একটা কাচের জানালার পেছনে বসে থাকতেন যে কোনো মাস্টার পেইন্টারের আঁকা বৃদ্ধের পোর্ট্রেটের মত একজন। তাঁর নাম জাফর আলি খান। ‘হুনর’ শব্দটা আমার ব্যক্তিগত ডিকশনারিতে কেবল ওই মানুষটিকেই মনে পড়ায়।
পেপার ম্যাশের তৈরি জিনিস আর কার্পেট- এই কেবল বিক্রি হত সেই সরু লম্বা দোকানে। অন্য কয়েকজন কারিগরও ছিলেন, দোকানের পেছন দিকটায় অপেক্ষাকৃত একটু গরম জায়গায় বসে কাজ করতেন তাঁরা, পেপার ম্যাশের কাজ। কার্পেট ওখানে তৈরি হত না। জাফর আলি খানকে লোকজন চিনত, সম্মান করত কিন্তু ট্যুরিস্টদের বিশেষ ভিড় থাকত না ওঁর দোকানে। জিনিসপত্র প্রধানত বাইরের দেশে চলে যেত, স্থানীয় বিক্রি ছিল কম। হয়ত সেজন্যই দোকানের সামনের মুখটা ছোট। আমাদের দু’জনকে কী কারণে যে ওঁর ভালো লেগেছিল বলা শক্ত। তখন তো এসব নিয়ে ভাবিনি, মানুষকে মানুষের ভালোই লাগবে, একথাটা কেমন স্বতঃসিদ্ধের মত বলে মনে হত যথেষ্ট সংখ্যায় বিপরীত প্রমাণ পাওয়ার পরও।
চিকিৎসা পরিষেবা বনাম হেলথ ইন্ডাস্ট্রি
যা হোক, সেই ভালোবাসাবাসির কারণে পাঁচটি সন্ধ্যার প্রতিটিই আমরা দুই মক্কেল সেই শিল্পলোকের ভেতরে আসীন থাকতাম। ক্ষুদের সামনে প্লেটে কিছু বাদাম আর মুখে অনর্গল বকবকানি। তার মাও প্রায় তথৈবচ, তফাতের মধ্যে তার সামনে কহবা আর জাফর আলি খান স্বয়ং। অন্তহীন প্রশ্নের জবাবে একটুও বিরক্ত না হয়ে তিনি আমাকে বোঝাতেন পেপার ম্যাশে তৈরির কলাকৌশল। আর বলতেন, ‘বেটা, আপ অগর মহিনাভর ইধর ঠহর যাতি তো মৈ আপকো অপনে হাথোঁ সে ইয়েহ সিখাতা’। কাগজ, ছেঁড়া সুতোর কাপড়, আর চাল ভিজিয়ে রেখে হামানদিস্তায় কুটে কেমন ভাবে সেই পেপার পাল্প তৈরি হয়, কেমন করে গঠন দেওয়া হয় তার, শুকোনো, তারপর আঁকা হয় সেই ছোটর চেয়ে ছোট কিংবা বড়ো জিনিসের গায়ে, আর কীভাবে ছেঁড়া কাপড়, কাগজ আর চালের আধপচা মণ্ড থেকে জেগে ওঠে রূপ... সেই গল্প শুনতাম।
দু-একদিন সকালের আলোতেও গিয়ে দেখতাম তাঁর শীর্ণ শরীরের মধ্য থেকে জেগে থাকা চোখ, সরু রোগা আঙুলগুলি কী সব নকশা ফুটিয়ে তোলে সেইসব বিচিত্র আকারের গায়ে। তিনি আমাকে দেখিয়েছিলেন তুলির চেহারা, যে তুলি রঙকে কাগজের গায়ে মোটা রঙের প্রলেপের ওপর সূক্ষ্ম রঙিন নকশা আঁকে। ‘বেড়ালের লেজের লোম দিয়ে তৈরি হয় এইসব তুলি, বেটা। যেমন তেমন যে কোনো বেড়াল নয়, যত্ন করে পালন করা বিশেষ বেড়াল। কেবল তাদের লোমেই এই রঙ ঠিকমত ধরবে।’ কীরকম রঙ সেগুলো? প্রত্যেকটি তৈরি হয় প্রাকৃতিক বস্তু থেকে। এই যে কমলা রঙের ফুল, একরকম পাথর ঘষেই কেবল পাওয়া যায় এটা। এই রঙটা দেখো, জাফরান গাছের ছাল দিয়ে তৈরি। কালো জমির ওপর এই যে চোখে দেখা যায় না এরকম আঁকাবাঁকা রুপোলি রেখা, এই আঁকাবাঁকা রেখাই হল কাশ্মীরি আর্টের বৈশিষ্ট্য। রুপো ঘষে তৈরি করা হয় এই জালগুলোর রঙ। এটা আঁকতে লাগে একটা লোমের তুলি। এইটা যে ঠিকঠাক বানাতে পারে, তাকে বলবে যে হ্যাঁ, সে কিছু শিখেছে।
‘এবার বলো, ট্যুরিস্টরা এসে বলবে পেপার ম্যাশের জিনিস দাও আর শস্তায় দাও। এটা কি শস্তায় করা যায়? তাই আমার এখানে বেশি খরিদ্দার আসে না।’ প্রতিটা বস্তুর গায়ে নকশা আর রঙের অপরূপতায় অবাক হয়ে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম,
-এই এতরকমের আলাদা আলাদা নকশা করেন, এর কি কোনো ক্যাটালগ আছে? মূর্খ শিশুকে বোঝানোর মত স্নিগ্ধ হেসেছিলেন শিল্পী,
-কৈসি ক্যাটালোগ বেটি, এই যে এতবড় ভুবন বানিয়ে রেখেছেন খোদাতালা! যখন সময় পাই গিয়ে ঘরের বাইরে বসে থাকি। চোখ ভরে দেখি। ঘরে আসবার পর জেহানে যতটুকু থাকে তাই আঁকি। আবার যাই, নকশা পালটে যায়।
তীর্থযাত্রীরা ফেরবার পর শেষদিন সকালে গেলাম দেখা করতে। নিজের হাতে তৈরি ছোট্ট কালো একটি কাপ দিলেন আমায়। কালোর ওপর কমলা সবুজ ফুলপাতা আর তা ঘিরে সেই রুপোলি রেখার জাল। ভেতরের ছোট শূন্যতাটুকু অতল স্নেহে ভরা।
লিদ্দার নদী রাস্তার ওপর দিয়ে চলে আর তার কিনারে থাকত সেই পহলগাম...
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
এই সিরিজটির সব লেখা একসঙ্গে পড়ুন এই লিংকে