আজকের রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে যত কথা হচ্ছে, কয়েক বছর আগেও এমনটা ছিল না। বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা, গণপিটুনি, ৩৭০, এসব শব্দ কিছুদিন আগেও রাজনৈতিক আলোচনায়, নিবন্ধে ততটা খুঁজে পাওয়া যেত না। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের জীবনে সম্ভবত এমন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাবেন নি বা কিছু লিখে যান নি। হিন্দু-মুসলমান, জাতীয়তাবাদ, ইত্যাদি বিষয়ে কবিগুরুর লেখা নিয়ে বাংলায়, ইংরেজিতে, নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে দেশের পত্রপত্রিকা বা ইন্টারনেটে। তবে এর বাইরে যে কবির নাম এই প্রসঙ্গে সবার আগে এসে পড়ে, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৭৭ সালে ভারতে জরুরি অবস্থার পর যখন ভোট এল, অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র বলেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দেবেন। কলকাতার রাসবিহারী কেন্দ্রে তিনি প্রার্থী ছিলেন। ওই সময় দেখেছি, বন্দিমুক্তির দাবিতে নকশালপন্থী এবং অন্যান্য বামপন্থী যুবকদের মিছিল, আর সেই মিছিলে গলা মিলিয়ে সবাই গাইছেন নজরুলের 'কারার ওই লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট…'। হিন্দু-মুসলমান প্রশ্নে আজ ফের সময় এসেছে নতুন করে নজরুল চর্চার।
আরও পড়ুন: ঈদ হোক বা পুজো, করোনা আতঙ্কে উৎসব বিমুখ দুই বাংলাই
'ভক্তিগীতি মাধুরী' নামে নজরুলের ৫০১টি ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত এবং ইসলামি গানের নির্বাচিত সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের এক নামী প্রকাশনা থেকে। পিডিএফ ফরম্যাটে বইটি আমি পাই 'বইয়ের হাট' নামের একটি ওয়েবসাইট থেকে। করুণা প্রকাশনীর বই। ইন্টারনেটে করুণা প্রকাশনীর যে বুকলিস্ট পেলাম, তাতে সার্চ দিয়ে দেখলাম বইটি এখন ছাপানো নেই। অর্থাৎ আউট অফ প্রিন্ট। সেই বইটির ভূমিকা হিসেবে নজরুলের যে লেখাটি আছে, সেটি পড়ে জানতে পারলাম, নজরুল একজন হিন্দু গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর নাম বরদাচরণ মজুমদার।
নজরুল লিখছেন, "তিনি (বরদাচরণ মজুমদার) এই গ্রন্থ-গীতার উদগাতা"। অর্থাৎ এই যে ভজন, কীর্তন, শ্যামাসঙ্গীত এবং ইসলামি গানের সংকলন, তাকে তিনি বলছেন 'গীতা'। সম্ভবত তিনি ভেবেছিলেন ভজন, কীর্তন আর ইসলামি গানের সুরে, কথায় রচিত হবে নতুন সংস্কৃতির ধর্মগ্রন্থ। কৌতূহল হলো জানতে, কে এই বরদাচরণ মজুমদার? ইন্টারনেটে খুঁজতে খুঁজতে একটি অনলাইন বুকশপে পেয়েও গেলাম 'পথহারার পথ ও দ্বাদশ বাণী' নামে বরদাচরণ মজুমদারের একটি বই।
বইয়ের মূল বিষয় যোগসাধনা। বরদাচরণ ছিলেন যোগসাধক। নজরুল তাঁর এই গুরু সম্পর্কে 'ভক্তিগীতি মাধুরী'র ভূমিকায় লিখেছেন, "সহসা একদিন তাঁহাকে দেখিলাম।…শুভক্ষণে আনন্দবাসরে আমার সে ধ্যানের দেবতাকে পাইলাম।…আজ আমার বলিতে দ্বিধা নাই, তাঁহারই পথে চলিয়া আজ আমি আমাকে চিনিয়াছি। আমার ব্রহ্ম-ক্ষুধা আজও মেটে নাই কিন্তু সে ক্ষুধা এই জীবনেই মিটিবে, সে বিশ্বাসে স্থিত হইতে পারিয়াছি।" এই লেখাটি নজরুল প্রথম লিখেছিলেন 'পথহারার পথ ও দ্বাদশ বাণী'-র প্রথম সংস্করণের ভূমিকা হিসেবে। পরে তা ব্যবহার করা হয় 'ভক্তিগীতি মাধুর' সংকলনে। 'পথহারার পথ ও দ্বাদশ বাণী'-র আধুনিক যে সংস্করণ আমার হাতে এসেছে, তাতে নজরুলের ভূমিকাটি নেই। সেখানে ভূমিকা লিখেছেন প্রশান্ত চক্রবর্তী নামে এক ভক্ত। তবে উল্লেখ রয়েছে যে এই বইয়ের প্রথম সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন 'বিদ্রোহী কবি'।
আরও পড়ুন: ভারতমাতা কি জয় বনাম ইনকিলাব জিন্দাবাদ
ঈশ্বরে আস্থা যাঁর যাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু আজকের ধর্মীয় বিদ্বেষের যুগে কাজী নজরুলের এই যে ধর্মের বেড়াবিহীন ঈশ্বর ভাবনা, তা এক নতুন মানুষের কথা বলে। এই দৃষ্টান্ত আজকের দিনে যেন বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। নজরুল নিজে এই ধর্মীয় বিদ্বেষ সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন। খুব আর্থিক সঙ্কটে পড়ে ১৯৪২ সালের ১৭ এপ্রিল অর্থ চেয়ে নজরুল একটি চিঠি লিখেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, "আমার স্ত্রী আজ প্রায় পাঁচ বৎসর পঙ্গু হয়ে শয্যাগত হয়ে পড়ে আছে। ওকে অনেক কষ্টে এখানে এনেছি। ওর অসুখের জন্যই এখনো সাত হাজার টাকার ঋণ আছে। এর মধ্যে মাড়োয়ারি ও কাবলিওয়ালাদের ঋণই বেশি।…আপনি জানেন, হিন্দু-মুসলমান ইউনিটির জন্য আমি আজীবন কবিতায়, গানে, গদ্যে দেশবাসীকে আবেদন করেছি। সে সব সাহিত্যে স্থান পেয়েছে…আরো পাঁচশো টাকা অনুগ্রহ করে যত শীঘ্র পারেন পাঠিয়ে দেবেন, বা যখন মধুপুরে আসবেন, নিয়ে আসবেন। কোর্টের ডিক্রির টাকা দিতে হবে। তিন চার মাস দিতে পারিনি। তারা হয়তো body warrant বের করবে।" এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট, কী ভয়ঙ্কর দুর্দিনের মধ্যেও নিজের আদর্শে অবিচল থেকেছিলেন নজরুল।
আজ আমাদের এই সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্রে যেখানে একজন সংখ্যালঘুকে এখানে ওখানে ‘জয় শ্রীরাম’-এর পরীক্ষা দিতে হয়, যা থেকে এই বাংলাও মুক্ত নয়, এ সময়ে মনে হয়, নতুন করে নজরুল চর্চা খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে।
(এই লেখাটি আইই বাংলায় প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের অগাস্ট মাসে)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন