নীলার্ণব চক্রবর্তী: বাংলাদেশের শামিম ওসমান খেলা হবে-র রাজনৈতিক জন্মদাতা। তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি, এমন সুনামি-'খেলা' হবে এ বাংলায়। ইতিহাসে যত ভোট-স্লোগান লেখা, তার মধ্যে আপাতত এটি-- একে চন্দ্র। অনেকে ফোঁস করেছেন স্লোগানটিতে। যুদ্ধরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মতো তাদের শক্তসমর্থ যুক্তি: নির্বাচন তো খেলা নয় দাদা, গণতন্ত্রের উৎসব, তাকে খেলা হবে বলে নির্জলা খেলাচ্ছল করে দেওয়াটা মোটেই ঠিক নয়!
পাল্টায়: আরে দাদা, জীননানন্দের বনলতা সেনের চোখ যেমন পাখির নীড় নয়, তেমনই নির্বাচন খেলা নয়… লড়াইটাকে খেলা বললে ক্ষতি কী-- এর শ্লেষটা বুঝতে এত ক্লেশ কেন আপনাদের? নির্বাচন-পিরিয়ডে এমন আঁতেল-যুদ্ধ দেখা-- ঘরেবাইরে, ঘাটে-আঘাটে। আঁতেলরা যখন যুক্তির লড়াই করেন, তখন পাবলিক ভোম্বল বনে যায়। আঁতেলদের সঙ্গে দাঁতের লড়াইয়ে জেতা সহজ নয়, আপনার সাধারণ দাঁত হলে ওঁদের ইয়েতির দাঁত। কথা বলার সময় ওই দাঁত এমন ভাবে ওঁরা দেখান যে, চোখে ঝিলমিল লেগে যায়, আপনার যুক্তি-কাঠামো তাতেই খানখান।
আঁতেল কেমন বস্তু? ধরুন, রসগোল্লা খাবার জন্য আপনি হাঁ করেছেন, আপনার হাঁ আরও বাড়িয়ে দিয়ে রসগোল্লার রসকে এঁরা নন্দনতত্ত্ব করে দেবেন লহমায়। যুক্তির জাল বিছোতে বিছোতে বলে উঠবেন, ক'প্রকার রস আছে বলুন তো? ওহ জানেন না দেখছি। ন'প্রকার…। আদি, বীর, করুণ, অদ্ভুত, হাস্য, ভয়ানক, বীভৎস, রৌদ্র এবং শান্ত। রাম নাম যেমন জপ করেন, তেমন করেই আউড়ে যান না এটা। মুখস্ত হতেই হবে। তার পর কী যেন সাত-পাঁচ ভেবে, ওহ হো! বলতে ভুলে গেছিলাম-- এই যে রস, এই যে রসের নটি ভাগ… নির্বাচনে তো সবকটিই অক্ষরে অক্ষরে দেখেন, দেখেন কিনা… তা-ই ভোটকে রসখেলা বললেও বলতে পারেন, কি…?
নাহ, আমরা কিন্তু লেখার 'সেন্টার' থেকে সরে যাচ্ছি। কিন্তু সেন্টার থেকে শুরু করার পর, সরতে হয়, হবেই, তাই না! শূন্য থেকে শুরু হয়, শূন্যে দাঁড়িয়ে থাকা যে যায় না। ওই দেখুন, এসে গেল তো, এসে গেল তো… কী আবার এসে গেল ভাই?… এখনও বুঝলেন না-- শূন্য, দাদা… শূন্য শূন্য-- মানে গোল্লা, বুঝেছেন আশা করি, রসগোল্লার কেরামতি! নবীন ময়রা শুধু আবিস্কার করেননি এইটি, তাকে নিয়ে শুধু ফিল্ম হয়নি, রাজনীতিও ভীষণ, বিস্তর হয়েছে। দাদাভাই, রসগোল্লার মতো এমন মিষ্টিদ্রব্য নিয়ে যদি রাজনীতির হতে পারে, ওড়িশার সঙ্গে ঘনঘোর ঘাম-ঝারানো লড়াই চলতে পারে, তবে ভোট কেন খেলা হতে পারবে না?
আঁতেলদের মধ্যে বামপন্থীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, বিশ্বাস করে দিন কাটাচ্ছেন অনেকে-- আজও। এক বামপন্থী একটু নাক-কুঁচকে কথাবার্তায় ঢুকে পড়ে বললেন, শূন্য-- এর কত জোর জানেন না আপনারা-- না, আর্যভট্টের কথা বলছি না, বলছি আমাদের কথা। আমরা যে ডাহা শূন্য পেলাম, এটাই তো আমাদের শক্তি। নতুন করে শূন্যচর্চার প্রয়োজন এখন, এটা আস্তে আস্তে অনুভব করছেন রাজ্যের মানুষ। বামপন্থী আলোয় চলবে সে চর্চা, মাথায় ঢুকল কি? শুনে একজনের খোঁচা: অভ্যাস দোষ না ছাড়ে চোরে, শূন্য ভিটায় মাটি খোঁড়ে! মানেটা জানেন তো?…
আরও পড়ুন দিল্লি সফর, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ- কেন এ পথে মমতা?
যিনি রসগোল্লা খাওয়ার জন্য হাঁ করেছিলেন, তিনি বেবাক রসখ্যাপা হয়ে গিয়েছেন এত ক্ষণে। হাঁ আটকে গিয়েছে, গোঁ গোঁ করছেন, চোখের গোল্লা দুটো বেরিয়ে আসার জোগাড়। পিছন থেকে পাবলিকের গান ভেসে আসছে, আমি বাম দিকে রই না আমি ডান দিকে রই না, আমি দুই দিকেতে রই, পরান জলাঞ্জলি দিয়া… কে গাইছে এ গান, উফ আপনারা আঁতলেমি করতে পারলে আর কিছু চান না দেখছি। ওহ হো, এই ভাবে তো দেখছি আঁতেল শব্দটারই পুনর্জন্ম হয়ে গেল…! কবে শব্দটা মরে গিয়েছিল, বোধ হয় সেই সত্তর দশকে। এই বার 'চিনের চেয়ারম্যান, আমাদের চেয়ারম্যান'কে একটু নবরূপ দিয়ে কংগ্রেসিরা বলতেই পারেন, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান… আমাদের তো চেয়ারের শূন্যগর্ভ দশা, হে বীর (আবার রস!) পূর্ণ করো, করো প্লিজ… বাংলায় মমতাকে গালমন্দ, দিল্লিতে সনিয়ার ভালমন্দ, গানের সুরটা যেন কেমন… হে বীর… আঁতলেমি শব্দটার মতো আমাদেরও পুনর্জন্ম যদি হত?
নাহ, আর পারা যাচ্ছে না, কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, কোথায় এসে হাজির হলাম, তেল আনতে গিয়ে আঁতেল নিয়ে এলাম! হবেই বা না কেন বলুন তো, আমাদেরই বা কি দোষ, ভেবেছিলাম, যাক পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন হয়ে গেছে, খেলা জেতাও হয়েছে, ভাঙা পায়ে খেলার ক্ষমতা দেখে বিপক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়েছে, এবার এই স্লোগানটি 'ইতি তোমাদের দিদি' বলে শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু না-- শেষ থেকে নতুন শুরু হচ্ছে। দিল্লিতে দুশমনকে দুরন্ত গোল দেওয়ার জন্য ফের সবুজ জার্সির পিছনপানে লেখা হচ্ছে 'খেলা হবে'।
জাভেদ আখতারের উপর দায়িত্ব পড়েছে বিরাট। খেলা হবে-র গান তাঁকে লিখতে হবে। ডিজে বাজানোর মতো কিছু লিখতে বোধ হয় পারবেন না। আখতারি ঘরনায় সুললিত অথচ দাপটের আলো… এমন জাতীয় নিশ্চয়ই লিখে দেবেন। ২৪-এ ২৫ পেতে চাইছে খেলা হবে-র টিম। লিরিকের খেলাটা নিশ্চয় দেখাতে চাইবেন কথাজাদুর জাভেদ, কী বলেন!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন