ও রাজনীতির দাদা-দিদিরা, কাকা-জ্যাঠারা, পিশে-মেসোরা, দোহাই আপনাদের, এবার মাসদুয়েক রাস্তার মিটিং-মিছিলে ক্ষান্ত দিন প্লিজ। পরীক্ষার মরশুম শুরু হয়ে গেছে। বাচ্চাগুলোকে একটু শান্তিতে পরীক্ষাটা দিতে দিন এবার, দোহাই আপনাদের!
সেই সিএএ বিল পাশ হওয়ার পর থেকেই চলছে। রাস্তাঘাটে অনন্ত মিছিল, অগুনতি মিটিং। রোজ একাধিক। কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। কোনওটা রাজনৈতিক ব্যানারে, কোনওটা নয়। চলছে লাগাতার। পি.সি. সরকারের সেই 'ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া' ম্যাজিকটার মতো। জল পড়ছে তো পড়ছেই, পড়েই চলেছে। থামার কোনও লক্ষণ নেই। গত মাসদুয়েক ধরে প্রায় একই ভাবগতিক মিছিল-মিটিংয়ের। আজ এ পক্ষের, তো কাল ও পক্ষের। বা একই দিনে বিভিন্ন পক্ষের। কলকাতা পুলিশের সূত্র বলছে, ডিসেম্বরের শুরু থেকে ধরলে এই মাঝ-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কম করে হলেও সিএএ-এনআরসি ইস্যুতে শহরে মিছিল হয়েছে সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি। মানে গড়ে চার থেকে পাঁচটা রোজ। কতদিন চলবে এভাবে? যতদিন, ততদিন?
বেশ, না হয় তা-ই চলুক। কিন্তু লাল বা বেশি লাল, সবুজ কিংবা গেরুয়া এবং আর যা যা রংয়ের রাজনৈতিক দল আছে, গণতন্ত্রের জন্য বলিপ্রদত্ত আর যা যা অরাজনৈতিক গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী আছে, সিএএ-র পক্ষে বা বিপক্ষে গলা-ফাটানো আর যা যা দল-উপদল রয়েছে, তাদের দাদা-দিদিদের করজোড়ে অনুরোধ শুধু, মাসদুয়েকের একটা ব্রেক নিন, প্লিজ। সিবিএসই শুরু হয়ে গেছে, মাধ্যমিক-আইসিএসই-উচ্চমাধ্যমিকও শুরু হলো বলে। বাচ্চাগুলোকে একটু শান্তিতে পরীক্ষাগুলো দিতে দিন প্লিজ। একটু জিরিয়ে নিয়ে, একটু শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে ফের না হয় ঢাল-তরোয়াল নিয়ে মাঠে নামবেন মাসদুয়েক পর। কে আটকাচ্ছে?
কেউ আটকাচ্ছে না। শুধু তো মাসদুয়েক একটু বিরতি নেওয়ার আবেদন। আর, আমরা তো আটকে থাকতেই অভ্যস্ত এ শহরে। এ শহরের যে মিটিং রাশি আর মিছিল লগ্নে জন্ম, সে আর কারই বা জানতে বাকি আছে? কাজে বেরিয়ে হঠাৎ রাস্তাজোড়া মিছিলে আটকে গিয়ে অফিসে লেট করে পৌঁছে বসের মুখঝামটা খাওয়া তো আমাদের চিরন্তন ললাটলিখন। অফিসফেরতা পথে কোনও জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদী মোমবাতি-মিছিলে আটকে যাওয়া এবং এক ঘন্টার রাস্তা তিন ঘন্টায় পেরোনো... এ-ও তো আমাদের ডিএনএ-তে ঢুকে গেছে সেই কবেকাল থেকেই। বহুকাল হলো আমরা হাড়েমজ্জায় বুঝে গেছি, রাস্তা আটকে যখন খুশি, যেমন খুশি মিটিং-মিছিলই হলো গণতান্ত্রিক পথে প্রতিবাদের একমাত্র মাধ্যম। আমাদের বৃহত্তর অধিকার আদায়ের জন্যই এত কিছু। সময়মতো নিরুপদ্রবে স্কুল-কলেজ-অফিস-কাছারিতে যাওয়ার অধিকার তো তুলনায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ। সুতরাং কোনও প্রশ্ন নয়। কারণ, প্রশ্ন তুললেই দাবড়ানি অবধারিত, 'চোপ, মিছিল চলছে।’
পরীক্ষার মরশুমে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়মানুযায়ী আবাসিক অঞ্চলে মাইক বাজানো বারণ। কিন্তু আইন থাকলে আইনের ফাঁকও আছে। মাইক বাজানো বারণ, এবং সেই বিধিনিষেধ মোটের উপর মানাও হয়। একটা প্রশাসনিক তৎপরতা থাকে। কিন্তু মিছিল? তার উপর তো কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। আর নেই যখন, মিছিল-মাদকে বছরভর আচ্ছন্ন রাজনৈতিক দলগুলো টানা দুটো মাস উপোসী থাকে কী করে? না-ই বা থাকল আওয়াজখানা 'দিল্লি থেকে বর্মা' পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ, 'মৌন মিছিল' করতে তো আর বাধা নেই। ব্যস, চালাও পানসি বেলঘরিয়া! বেরিয়ে পড়ো পতাকা নিয়ে!
গত কয়েক বছরে পরীক্ষার মরশুমেও এ ধরণের দেদার মৌন বা আধা-মৌন মিছিল হয়েছে শহরে। মাইকে ভাষণবাজি হচ্ছে না, এই তো যথেষ্ট আত্মত্যাগ। এর উপর যদি আবার পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মিছিলজনিত যানজটে আটকে-থাকা পড়ুয়াদের কথাও ভাবতে হয়, তাহলে তো ভারি মুশকিল। ছাত্ররা দেশের ভবিষ্যৎ, আর দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থেই না মিছিল! পরীক্ষা দিয়ে ফেরার সময় বাসে বসে যদি ঘন্টাখানেক ঘামতে হয় ক্লান্ত শরীরে, সে তো নেহাতই 'কোলাটেরাল ড্যামেজ'।
তা এই 'ড্যামেজ'-টা একটু 'কন্ট্রোল' করা যায় না এ বছর থেকে? দুটো মাস, মাত্র দুটো মাসের মিছিল-বিরতিতে দেশোদ্ধারের প্রক্রিয়া যে বিশ বাঁও জলে পড়ে যাবে, এমনও তো নয়। বাচ্চাগুলো সময়মতো পরীক্ষা দিতে যাক, শেষ হলে সময়মতো নিরাপদে বাড়ি ফিরে পরের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিক নির্বিঘ্নে, এটুকুই তো চাওয়া। ও রাজনীতির দাদা-দিদিরা... পোস্টারগুলো তোলা থাক না এই দুটো মাস, তারপর না হয় সুদে-আসলে পুষিয়ে দেবেন। এ পোড়া দেশে ইস্যু তো আর কম পড়িবে না!
বাচ্চাগুলোকে একটু শান্তিতে পরীক্ষাটা দিতে দিন, প্লিজ!