Advertisment

ভাসানের কার্নিভালে জিনপিং

কার্নিভালে এত হাঁটাহাঁটির পর সকলেরই বেশ খিদে পাবে। রাজ্য প্রশাসনের এই সব দিকেও বেশ ভালো নজর আছে। হঠাৎ দেখি চিনের লোকটার পাশে বসে আছেন স্বয়ং আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Jinping, Mamata

নরেন্দ্র মোদীও কার্নিভাল দেখতে কলকাতায়!

ত্রয়োদশীর সন্ধে বেলায় কার্নিভাল। বিভিন্ন বড় পুজোর প্রতিমা নিয়ে রেড রোড পরিক্রমা। মহালয়ার দুদিন আগে থেকে শুরু, লক্ষ্মীপুজোর দুদিন আগে শেষ। কলিকালে পুজোর দৈর্ঘ্য বেড়ে একপক্ষ কাল। আসছে বছর আবার হবে। তবে সেখানে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে রেকর্ড। মহালয়া আর বিশ্বকর্মা পুজো একই দিনে, ১৭ই সেপ্টেম্বর। আর ষষ্ঠী শুরু বাইশে অক্টোবর। একই আশ্বিনে দুটি অমাবস্যা চেপে বসায় এই কীর্তি। যখন তখন চাঁদের গায়ে যন্ত্র আছড়ে পড়লে অমাবস্যা বাড়বেই। তাই আগামী বারের পুজোর উদ্বোধন মহালয়ার দুদিন আগে ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু আর কার্নিভাল সহযোগে শেষ হবে লক্ষ্মীপুজোর দুদিন আগে, অর্থাৎ ২৯শে অক্টোবর।

Advertisment

দেবীপক্ষে মহাষষ্ঠী থেকে বিজয়া দশমীর পাঁচ দিনের গল্প বাম আমলে বিলীন। এখন পুজোর ক্যালেন্ডার অন্য অঙ্কে লেখা। তাই সামনের বার প্রায় দেড় মাসের ধাক্কা। এখানে অল্প একটু ঐকিক নিয়ম আছে। দু হপ্তার পুজোয় যদি ভারতীয় মুদ্রায় এক লক্ষ কোটির বেশি বাজেট হয় তাহলে ছ হপ্তায় অন্তত তিন লক্ষ কোটি। মোদি সরকারের ট্রিলিয়ন ডলারের স্বপ্নে পশ্চিমবঙ্গের অবদান থাকবে না তা হয় নাকি? বিশ্বজুড়ে শ্লথগতির অর্থনীতির মধ্যে গোটা দেশ দিশেহারা, বৃদ্ধির পরিমাণ নাকি টেনেটুনে মাত্র পাঁচ শতাংশ। গাড়ি থেকে বিস্কুট, সবকিছুর বিক্রি আকাশ থেকে মাটিতে গোঁত্তা মারছে। কিন্তু শারদীয়া উৎসবে রাজ্যের গতিধারা অব্যাহত, যার শেষ কার্নিভালে। মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায় প্রজাতন্ত্র বা স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ আর বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান বোধহয় পুনঃপ্রচারিত হচ্ছে। যে সমস্ত অতিদীর্ঘ যানবাহনে মা দুর্গা উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম থেকে শহরের কেন্দ্রে পাড়ি দেন, সেগুলোকে এ রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনায় যন্ত্রপাতি আনার কাজে লাগালে অর্থনীতি বেশি চাঙ্গা হত কিনা এই সমস্ত অর্বাচীন প্রশ্ন তুলবে গুটিকয় নিন্দুক। কার্নিভালের শোভায় পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন রেড রোডে উদ্ভাসিত। শুধু ভেতো বাঙালি নয়, বিদেশিরাও দলে দলে ছুটে এসেছেন এই উৎসবে সামিল হতে। কেউ দেখেছেন, কেউ বা নেচেছেন ঢাকের তাল আর মাদলের বোলে। সবশেষে ভাসান, মায়ের বিদায়ে মাটি মেখে মানুষের গঙ্গাস্নান।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: মোদী-জিনপিং বৈঠক – কাকে বলে ঘরোয়া সম্মেলন?

সবার তো আর রেড রোডে উপস্থিত হয়ে দশমী পার করা মাতৃমূর্তির মিছিল আর সাংস্কৃতিক উৎসব দেখার সুযোগ হচ্ছে না। তাঁদের জন্যে টেলিভিশন-ই ভরসা। সেখানে সবকটা খবরের চ্যানেলে কার্নিভালের সরাসরি সম্প্রচার। পুজোর সময় ঘেমে নেয়ে বৃষ্টি ভিজে দেখে আসা প্রতিমা আবার টিভির পর্দায় খুঁজে পেয়ে একরাশ হইচই। তবে এর মধ্যে মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনের বিরতি হলে সেই সুযোগে টুকটাক হাতের কাজ সেরে নেওয়া। কিছুক্ষণ আগেই দেখেছি বিদেশিদের মধ্যে চিনের বেশ কিছু অতিথি মন দিয়ে শোভাযাত্রা দেখছেন। মাঝে একটু বাদ পড়ে গেছিল। আবার ফিরে এসে দেখি বেশ কিছু চিনের মানুষ। তবে এদের মুখ তুলনায় গম্ভীর। মন দিয়ে দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যশৈলী উপভোগ করছেন। ভাবা যায় আমাদের কার্নিভালের কি উন্নতি? এত উন্নতমানের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এই বাংলা ছাড়া আর কোথায় দেখতে পাবেন? কী সুন্দর মন্দিরের আদল। একেবারে মমল্লপুরমের বিশুদ্ধ স্থাপত্য যেন তুলে আনা হয়েছে কলকাতায়। টেলিভিশনের পর্দায় লেখা হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে নৈশভোজের আসর। অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। কার্নিভালে এত হাঁটাহাঁটির পর সকলেরই বেশ খিদে পাবে। রাজ্য প্রশাসনের এই সব দিকেও বেশ ভালো নজর আছে। হঠাৎ দেখি চিনের লোকটার পাশে বসে আছেন স্বয়ং আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী। তার মানে নরেন্দ্র মোদীও কার্নিভাল দেখতে কলকাতায়! সবসময় তো আর টিভির সামনে মুখ গুঁজে থাকা সম্ভব নয়। তাই রাতের খাবার গরম করতে দিয়ে এসে বুঝলাম আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চিনের রাষ্ট্রপতির বৈঠক হবে কাল। তার আগে নিশ্চয় দুই দেশের সর্বাধিনায়ক কলকাতায় কার্নিভাল দেখতে এসেছেন! তবে শুরুতে সারাক্ষণ ক্যামেরাগুলো যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর দিকে তাক করে ছিল, মাঝে মাঝে নাতি কোলে রাজ্যপালকেও দেখিয়েছে, মোদী আর জিনপিং মঞ্চে ওঠার পর থেকে সে ফোকাস বদলে গেছে।

বাড়ির বাকি লোকজন আমার মত রাজনীতিতে উৎসাহী নয়। আজকালকার কলেজে পড়া ছেলেপুলে রাজনীতি আর কি বুঝবে? তর্ক করতে গেছিল যে বৈঠকটা নাকি দক্ষিণ ভারতে। এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছি। সরাসরি রেড রোড থেকে সম্প্রচার দেখেও যদি শীর্ষ সম্মেলনের স্থান-কাল-পাত্র কেউ না বুঝতে পারে তবে তাদের সঙ্গে বেশি আলোচনা করার কোন মানে হয় না। কলকাতায় এবছর এক মিলিয়ন ভারতীয় মুদ্রার বেশি অর্থের বই বিক্রি হয়েছে সিপিএমের স্টলে। বিজয়া দশমীর পরেও যাদবপুরের বাসস্ট্যান্ডে আরও দুদিন চালু রাখতে হয়েছে লাল শালুতে মোড়া বই বিপণি। সেই প্রেক্ষিতে চিনের শীর্ষনেতা যে কলকাতায় আসবেন এমনটাই স্বাভাবিক। আর এখানে এসেই সরাসরি কার্নিভালের মঞ্চে। এটাই তো আমাদের সবার হেঁটে দেখার কলকাতা। “তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম” থেকে “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান”, সব শ্লোগানই এ বঙ্গের ঝুলিতে। হিরোশিমা নাগাসাকির কথা মনে রেখে শান্তি মিছিল কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলার জন্যে ইডেন ভরানো, সবটাই আমাদের জন্য। সত্যি বলতে কি চিনের প্রেসিডেন্ট ভারতে আসার আগে বেজিং-এ ইমরানের সঙ্গে বৈঠকটা না করলেই পারতেন। ইমরান ইডেনের পিচ ভালোই চেনেন। ফলে ক্লাব হাউসেই না হয় একেবারে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে কাশ্মীর সমস্যাটা মিটিয়ে ফেলা যেত। সৌরভ গাঙ্গুলিকে একটু আগে থেকে খবর দিয়ে রাখতে হত। রেড রোড থেকে আকাশবাণীর পাশ দিয়ে ইডেনের তিন নম্বর গেট পর্যন্ত পাতা থাকত লাল কার্পেট। মাঝে মোদি, একপাশে ইমরানের সঙ্গে দাদা, অন্যদিকে দিদির সঙ্গে জিনপিং। দুর্ভাগ্যবশত এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়ে গেছে। পেলেন অ্যাবি আমেদ আলি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী। বয়স যাঁর মাত্র তেতাল্লিশ বছর। আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সেই রকমই ভারতের সঙ্গে পড়শি দেশের ঝামেলা মিটলে হয়ত ইডেন থেকে সুইডেনে একটা খবর চটজলদি পাঠাতেই হত। মাদার টেরেসার পর বিশ্ববঙ্গে আসত দ্বিতীয় নোবেল শান্তি পুরস্কার, এই শহর থেকেই।

আরও পড়ুন, বিশ্লেষণ: সরকার কি এবার হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজও দেখে ফেলবে?

কার্নিভাল শেষ। রাত নেমেছে শরতের কলকাতায়। বৃষ্টি যদিও একেবারে থামে নি এখনও। রেড রোড শুনশান। মাঝে মাঝে ঝোড়ো গতিতে ছুটে যাচ্ছে দু একটা গাড়ি। পাশে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে ফাঁকা ময়দান। যুদ্ধশেষের ভাঙা কামান, কাঁধের বন্দুক আকাশমুখী করে বন্ধুহীন সৈনিক। কিছুটা দূর থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অল্প আলো ঠিক পৌঁছে যাচ্ছে দু একটা গাছের ভিজে পাতায়। জোনাকির মত বিন্দুতে চুঁইয়ে পড়ছে আলোককণা। গ্র্যান্ড হোটেলের বাইরের ঝোলা বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে বেশ কয়েকজন দেশনেতা। বৈঠক চলবে ভোর পর্যন্ত। অনেক দিনের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা শেষ হবে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে। স্বপ্ন ভেঙে বাস্তবের শান্তি ফিরবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং দুর্ভীক্ষপীড়িত আফ্রিকার একজন নেতাও যদি নিজেদের ভালো বুঝতে পারেন, তাহলে আমাদের স্বপ্ন দেখতে ক্ষতি কি?

(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

Anyo Paksha
Advertisment