Advertisment

রুশী বগাতীর, নাগ ভাসিলি এবং কারখানার গল্প

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে কলকাতা ফেস্টিভ্যালের বিকল্প হাতের কাছে ছিল না যে এইটে বড় আক্ষেপের বিষয় নয়, বরং আক্ষেপ এজন্যই যে বিকল্পের প্রয়োজন সম্পর্কেই অসচেতন থেকে যাবার ইতিহাস রয়েছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

শতাব্দীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পেরিয়ে এসেও ফেস্টিভ্যালের চরিত্রবদলের চিহ্ন নেই

“ইলিয়া একটা করে মস্ত ওক গাছ কেটে তোরণ বানিয়ে দেয় ফোয়ারার ওপর দিয়ে। তোরণের গায়ে খোদাই করে দেয়ঃ “চাষীর ছেলে রুশী বগাতীর ইলিয়া ইভানভিচ এসেছিল এখানে।”

Advertisment

কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে, কলকাতা শহরের মতোই, একটা বয়স পর্যন্ত পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে নস্টালজিয়া যদি আপনার কলকাতায় দীর্ঘসময় বসবাস করার দুর্ভাগ্য হয়ে থাকে এবং বয়স পেরিয়ে এলে বোঝা যায় উক্ত নস্টালজিয়া মেয়াদোত্তীর্ণ। আক্ষেপ বস্তুটি বড় স্বাস্থ্যকর নহে, তাকে বহন করার যে ক্লান্তি আছে তা থেকে নিস্তার চাইলে আপনাকে অয়দিপাউসের মতোই সব ভুলে যেতে হবে।

যেমন ধরুন এ বছরের কলকাতা ফেস্টিভ্যালে ‘মায়েস্ত্রো’ নামে একটি বিভাগ রয়েছে, সেখানে সমকালীন ‘মাস্টার’দের ছবির অতিপ্রাচুর্য হেতু আশ্বস্ততার মাত্রা বিপদসীমা পেরিয়ে গিয়েছে দস্তুরমতো, তাই এই ‘মাস্টার’দের তালিকা প্রণয়নের র‍্যাশনাল ঠিক কী অথবা একত্রে ছবি ডাম্প করার মধ্যে কোন ধরনের কৃতিত্বের পরিচয় রয়েছে সেই বিষয়ে বিশেষ কিছু শোনা যাচ্ছে না। গতবছরের কলকাতা ফেস্টিভ্যালে পেন-এক রাতানারুয়াং এর ছবির বিশেষ বিভাগ যে পরিমাণ উত্তেজনা সঞ্চার করেছিল এবং পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে হইচই করার মতো সিনেমা স্টাডিজের গবেষকদের পাওয়া গিয়েছিল তাতে এই ধারণাই হওয়া স্বাভাবিক যে পেন-একের ছবি এক অদৃষ্টপূর্ব, অপার্থিব বস্তু এবং এহেন হারানিধি হাতে পেয়ে কলকাতাবাসীর আনন্দের সীমা নাই। তবে এইসব ঘটনাবহুলতার কিছু কার্যকর দিক অবশ্যই রয়েছে, কলকাতার চণ্ডীমণ্ডপের যোগাযোগসীমার প্রান্তবিন্দু সম্পর্কে তা একটা ধারণা তৈরি করে।

ফিরে দেখার সময় এলে তখন কলকাতাকে খুব বেশি দোষ দেওয়াও চলে না, কেননা আমাদের দেশের কোথাওই প্রশিক্ষিত ফিল্ম প্রোগ্রামার বা কিউরেটর নেই, নেই সিনেমাতেক, নেই ভিস্যুয়াল আর্টের জগতের সঙ্গে ছবির লেনদেন। বহুবছরের শ্রমেও ফিল্ম সোসাইটি নিজের ইতিহাস লিখে যেতে পারেনি, সে কাজ এখন দক্ষিণ এশীয় ইতিহাস-লিখিয়েরা করছেন। ফিল্ম ক্রিটিসিজমের কোন স্বতন্ত্র ধারাও তৈরি হয়েছে এমন দাবী করা চলে না, এ দাবী যাঁদের সম্পর্কে ওঠে মধ্যে মধ্যে তাঁদের বিষয়ে মন্তব্য না করাই ভাল। দক্ষিণ ভারতে পরিস্থিতি কিছুটা, সামান্য হলেও, শ্রেয়তর। এবং দেশের একমাত্র এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার দ্বি-বার্ষিক আন্তর্জাতিক উৎসবটিও হয় বেঙ্গালুরুতে।

আমাদের দেশের (এবং অনেকে দেশেরই) বৃহৎ ফেস্টিভ্যালের সামনে মগজ এবং সংলাপহীন পদ্ধতিতে ইউরোপের ফেস্টিভ্যালের পুরস্কৃত ছবি এনে গাদা করার বাইরে খুব বেশি বিকল্পও থাকে না। দেশের বৃহৎ ফেস্টিভ্যালগুলির তুলনাতেও আবার কলকাতা অনেকসময় কিঞ্চিৎ নিরেস হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে, বিশেষ করে যেহেতু মুম্বাইয়ের আম্বানিদের ফেস্টিভ্যালের সঙ্গে বাজেটের লড়াই করা নিরর্থক।

আমাদের বেড়ে ওঠার সময়ে কলকাতা ফেস্টিভ্যালের বিকল্প হাতের কাছে ছিল না যে এইটে বড় আক্ষেপের বিষয় নয়, বরং আক্ষেপ এজন্যই যে বিকল্পের প্রয়োজন সম্পর্কেই অসচেতন থেকে যাবার ইতিহাস রয়েছে। এই পশ্চাৎপট রেখে এসে মনে পড়ে একদা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দাবী করেছিলেন ফেস্টিভ্যাল করে ভাল দর্শক তৈরি করা গেছে। কিন্তু অচলতা কলকাতার স্বভাবধর্ম, স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শতাব্দীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ পেরিয়ে এসেও ফেস্টিভ্যালের চরিত্রবদলের চিহ্ন নেই।

সম্প্রতি খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে কলকাতা ফেস্টিভ্যালের বাজার বিভাগটি অন্যান্য ফেস্টিভ্যালের সমধর্মী বিভাগের তুলনায় অকার্যকর কেন এই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। এর উত্তর যে ফেস্টিভ্যালের চরিত্রকাঠামোতেই রয়েছে সে কথা হয়ত তাঁদের মনে হয় নি। এই ব্যবসায়হীন বাজার আর পরিবর্তনহীন মোড়ক এই কাঠামোর অংশ, তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা সম্ভব নয়।

বহুবহুকাল আগে, রুশী বগাতীর ইভান যখন নাগ ভাসিলির সঙ্গে যুদ্ধ করতে বেরত সেসময় একদা রাজ্যের সর্বাধিক বিক্রীত দৈনিক ফেস্টিভ্যালকে ‘অশিক্ষিত পটুত্বের রুগণ কারখানা’ আখ্যায় ভূষিত করেছিল, রাজ্যের তৎকালীন সর্বাধিনায়কের মন্তব্য তাঁকেই ফিরিয়ে দিয়ে। তারপর বগাতীর গেল অনেক পথ নাকি অল্প পথ কে জানে, কিন্তু রাজ্য এবং কারখানা দুইই কোথাও যায় নি, তারা সীমান্তের ধারে একঠেঙে গাছের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।

Kolkata International Film Festival
Advertisment