রুমেলা সাহা
দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের পর বেশ কিছু বছর কেটেছে। মূল অভিযুক্ত, সব থেকে কম বয়সী ছেলেটি তখন জেলবন্দি। জনৈক সাংবাদিক ছেলেটির ইন্টারভিউ নিতে গেছেন। সেই ইন্টারভিউয়ের আনএডিটেড ফুটেজ দেখেছিলাম। সেখানে ছেলেটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তুমি এমন করলে? উত্তরে সে যা বলেছিল, তার নির্যাস হল, অত রাতে (১১টা নাগাদ) একটি মেয়ে কেন পরপুরুষের সঙ্গে একা বাড়ির বাইরে থাকবে। ওকে সবক (শিক্ষা) দেওয়ার দরকার ছিল। ও(মেয়েটি) অন্যায় করেছিল। তাই ওকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
নির্ভয়াকাণ্ডে অভিযুক্তদের মধ্যে এই ছেলেটির বয়স সব থেকে কম ছিল আর এই ছেলেটি সব থেকে বেশি নৃশংস অত্যাচার করেছিল নির্ভয়ার ওপর। কিন্তু সেই পুরো ইন্টারভিউয়ের মধ্যে কোথাও বছর আঠারোর ছেলেটির মুখে অনুশোচনার কোন ছাপ ছিল না। বরং সে যা করেছে ঠিক করেছে, এই দৃঢ়তাই অত্যন্ত স্পষ্ট। ছেলেটির বড় হয়ে ওঠার মধ্যে, আর্থ-সামাজিক-পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে দিয়ে সে এটাই শিখেছে মেয়েদের কোন কাজে কীভাবে সবক্ দিতে হয়। সেই সবক্ দিতেই নির্ভয়ার অমন পৈশাচিক পরিণতি।
সেদিনের কলকাতা মেট্রোতে গল্পটা কিন্তু একই। ঘনিষ্ঠ দুই যুবক-যুবতীকে সবক্ শেখাতে আসরে নামলেন প্রায় বৃদ্ধ, প্রৌঢ়ের দল। কলকাতায় তালিবান নেই তাই ফতোয়া জারি হয় না,খাপ-পঞ্চায়েত নেই, কিছু সাম্প্রদায়িক সংগঠন আছে, তবে শহরবাসী তাদের পাত্তা দেয় না। কিন্তু সবক্ তো শেখাতে হবে। সেই মহান দায়িত্ব নিজেদের নড়বড়ে কাঁধে তুলে নিলেন বিগত দিনের ‘নায়কেরা’।
আরও পড়ুন, কলকাতা মেট্রোয় নীতি পুলিশের থাবা প্রসঙ্গে
মেট্রোতে অনেক সময় বাচ্চারা বমি করে। আমরা পাশ কাটিয়ে চলে যাই। সেটি অসুবিধার কারণ হলেও তার জন্য বাচ্চাটিকে মারি না। শরীর খারাপ থাকলে বমি করে ফেলতে পারেন কোনও বয়স্ক নাগরিকও। সেটাও অন্যের অসুবিধার কারণ হতে পারে, তাই বলে সেখানে কেউ কাউকে মারতে উদ্যত হন বা হবেন বলে মনে হয় না। দুটি মানুষ যদি নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা করেই থাকেন, এবং লোক দেখিয়েই করে থাকেন, তার পরিণতি কি গণধোলাই হতে পারে? যাঁদের কাছে এ ঘটনা দৃষ্টিকটু লাগছিল তাঁরা কি পাশ কাটিয়ে যেতে পারতেন না?
আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে সবক্ শেখানোই কি এই গণমারধোরের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল? উত্তরটা হয়তো এত সহজ নয়। অথবা আমরা ইচ্ছে করে সেটা আমল দিচ্ছি না। ঘটনার পর থেকে নাগরিক সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। একদল এই ঘটনার প্রতিবাদ করছেন আর অন্যদল বলছেন, পাবলিক প্লেসে ঘনিষ্ঠ হওয়ার দরকার কী ছিল, তার জন্য পার্ক কিম্বা নিরিবিলি কোন জায়গা তো রয়েছেই। মেট্রোতে বাচ্চারা বাবা-মায়ের সঙ্গে যাতায়াত করে, সেখানে এসব অশালীনতা, বাড়াবাড়ি... ইত্যাদি।
আরও পড়ুন, কলকাতা মেট্রো: বিতর্কিত উপদেশ দিয়ে কমেন্ট ডিলিট করল কর্তৃপক্ষ
যতটুকু জানা গেছে তাতে, ভিড়ের কারণে, মতান্তরে ভালোবাসার কারণে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়েছিলেন ওই যুগল। এতেই বিগতযৌবন বঙ্গপুঙ্গবদের মানসিক অস্থিরতা, নৈতিক দায়িত্ব, অ্যাড্রিনালিন গ্রন্থির ক্ষরণ বেড়ে গিয়েছিল। যার ফলে প্রেমিক যুগলকে উত্তম-মধ্যম দেওয়া থেকে ওঁরা নিজেদের বিরত করতে পারেননি। আর গণপ্রহারের ঘটনাটা কিন্তু ষ্টেশনে ঘটেছিল, মেট্রোতে নয়।
যে মানুষগুলো গত পরশু হাতের সুখ নিলেন, তাঁরা মোবাইলে অথবা অন্য কোথাও কি নীলছবির সুখ নেন না? আমরা মেয়েরা জানি, পথে ঘাটে যে সব পুরুষের নোংরা হাত ৪-৮০-র (বয়সটা এখন কোন ফ্যাক্টর নয়) নারী শরীরে অবাঞ্ছিত স্পর্শ করে, তাদের মধ্যে প্রৌঢ় বা বয়স্ক পুরুষের সংখ্যা অনেক বেশি। যারা নিজেরা বিকৃত কামাচারে জর্জরিত, তারা অন্যদের সবক্ শেখানোর অধিকার পায় কোথা থেকে!
আরও পড়ুন, তরুণ-তরুণীকে মারধোরের ঘটনা ধরা পড়েনি সিসিটিভি ফুটেজে, জানাল কলকাতা মেট্রো
বর্তমানে সারা দেশের সিনেমাগুলোতে যখন নির্বিচারে যৌন দৃশ্য দেখানো হয়, ঘরের ড্রইংরুমে বসে পরিবারের ছোটবড় সবাই মিলেই সেই সিনেমা দেখে থাকেন। তখন তো এই সব নৈতিক দায়িত্ববান মানুষেরা কোন প্রতিবাদ করেন না। টেলিভিশন প্রতিনিয়ত যে টেলি সিরিয়ালগুলো দেখানো হয় যার মূল গল্প একাধিক বৈবাহিক সম্পর্কের উপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়, সেখানেও তো বাচ্চা বড় নির্বিশেষে সবাই এর দর্শক, কই প্রতিবাদ তো আসে না। যে সমাজে নাচের অনুষ্ঠানে স্টেজে মেয়ে নাচলে দর্শক আসনে বসা বাবা সিটি মারেন, পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপনে ফর্সা, সুন্দরী, তন্বী ছাড়া যোগাযোগ অপ্রয়োজনীয় লেখা থাকে, যে সমাজে প্রতিদিন উচ্চ থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারে পণের জন্য বধূ হত্যা সাধারণ বিষয়ে, স্কুলে যৌন-শিক্ষা বিষয়কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না অথচ পুত্রসন্তান প্রসব করার ওষুধ বিক্রির রেকর্ড ছাপিয়ে যায়, যেখানে ৪ মাসের কন্যা সন্তানকেও ধর্ষণের বলি হতে হয়, সেই সমাজে নৈতিকতার দোহাই দিয়ে প্রণয়ী যুগলকে স্টেশনে ফেলে মারা হবে এটাই তো স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন, আলিঙ্গনের জন্য গণপ্রহার: সরব নেটিজেনরা
আরও আশ্চর্য এর বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যারা মার খায়, সমাজের একাংশ তাদের অপরাধীর কাঠগড়ায় তোলে অথচ যারা আইন হাতে তুলে নিল তাদের কোন শাস্তি হয় না। কোনও সিসিটিভি ক্যামেরায় এর ফুটেজ খুঁজে পায় না মেট্রো কর্তৃপক্ষ।
তবে ঘৃণার বদলে ঘৃণা নয়...যদি এমন একটা প্রতিবাদ করা যায়, মেট্রোর মধ্যে আলিঙ্গনাবদ্ধ মানুষের দল তাদের প্রিয়তমদের চুমু খাবে। লম্বা, বিলম্বিত, ফরাসি,তুরীয়, চৌকশ, চকাশ যার যেমন ইচ্ছে তেমন চুমু। হামিও চলতে পারে। এসব বেরসিকদের হেলায় হারিয়ে সভ্যতার আদি থেকে অন্ত চুমু দীর্ঘজীবী হোক। ঘৃণার বিরুদ্ধে প্রেমই তো শ্রেষ্ঠ অস্ত্র!