কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া থেকে বেরিয়ে সূর্য সেন স্ট্রিট ধরে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে যেতে যেতে এই অঞ্চলটায় রোজই একবার দাঁড়ান সুশান্তবাবু। এখানে পর পর বেশ ক'টি তেলেভাজার দোকান। তার কোনও একটি থেকে তেলেভাজা-মুড়ি কিনে হাঁটতে হাঁটতে দিব্যি স্টেশন পৌঁছে যান। এই সময়টায় একটু খিদেও পায়, আর ওই একমুঠো মুড়ি গালে দিয়ে হাঁটলে পথের ক্লান্তিটাও তেমন টের পাওয়া যায় না। রিটায়ার করার বয়স প্রায় ছুঁয়েছেন সুশান্তবাবু। কিন্তু কে বলবে? এই যে এখন তেলেভাজা খাবেন, অম্বল-টম্বল তার ধারকাছ দিয়েও যায় না।
আজ কিন্তু প্রায় ভিরমি খাওয়ার যোগাড় হলো তাঁর। বলে কী, একটা পিঁয়াজির দাম ১৫ টাকা? পিঁয়াজি নাকি? তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে বহুদিনের চেনা তেলেভাজার দোকানী বলে, "হ্যাঁ, পিঁয়াজিই দাদা। পেঁয়াজের কিলো কত করে জানেন? ৮০ টাকা।" বলে কী? এ যে ডাবল ভিরমি খাওয়ার কথা। সেই কাকভোরে বেরিয়ে আসেন কলকাতায় অফিস করতে। বাজারহাট গিন্নিই করেন। পেঁয়াজের দাম যে এমন আগুন হয়েছে, তিনি কেমন করে জানবেন?
আগুনই বটে! গত দুদিন ধরে বাজারে পেঁয়াজ কিনতে গেলেই এমন আগুনের ছ্যাঁকা লাগছে ক্রেতাদের। পেঁয়াজ যে কখনও এমন দামি এক সবজিতে পরিণত হবে, এমনটা স্বপ্নেও ভাবেন নি কেউ। ফলে, সুশান্তবাবুর মতো ভিরমি খাচ্ছেন অনেকেই। ভারতীয়, বিশেষত বাঙালি রসনায় পেঁয়াজ অত্যাবশ্যকীয় বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, সব বিত্তের মানুষের রান্নাঘরেই পেঁয়াজ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে মধ্যবিত্ত বা ধনীর টেবিলে হরেক আমিষ পদ, সেখানেও যেমন পেঁয়াজ চাই, অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষ, তাঁরও কোথাও পান্তাভাতের সঙ্গে এক টুকরো পেঁয়াজ বা ডাল-আলু সেদ্ধ, পেঁয়াজ। এটুকু না পেলে খাওয়াই তো হবে না। সালাডে পেঁয়াজ, মুড়ি মাখায় পেঁয়াজ, তেলেভাজার মুখ্য তালিকাতেও পেঁয়াজের পিঁয়াজি। মোদ্দা কথা, পেঁয়াজ ছাড়া আমাদের রসনার তৃপ্তি নেই। পেঁয়াজের স্বাস্থ্যগুণের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
আরও পড়ুন: শুধু ভাষা নয়, আত্মপরিচয় হারানো
এহেন পেঁয়াজ স্যাক্রিফাইস করে রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া? বাঙালির হেঁসেল কাঁদবে না? আপাতত সর্বত্র তাই শুধু পেঁয়াজ-চর্চা। মিডিয়ায় রানু-যাদবপুর-রাজীব কুমারের পাশে উঁকি মারছে দুঃখী পেঁয়াজের খালি ঝুড়ি। বাজারের থলে থেকেও পেঁয়াজ উধাও। ফেসবুকের রন্ধন পটীয়সীরা তো কেঁদেই আকুল। নানা পদ রেঁধে তাঁরা ছবি পোস্ট করেন। আমরা খেতে না পাই, দেখে সুখ নিই। তাঁরা সকলেই প্রায় বলছেন, কী আর করা, নাহয় পেঁয়াজ ছাড়াই রান্না করব। যদিও তাঁরা ভালো করেই জানেন, কিছু পদ অন্তত পেঁয়াজ ছাড়া বানানো একেবারেই অসম্ভব। বাজারবাবু ও বিবিরা বাজারে ঢুকে আলু-পেঁয়াজটা প্রথমেই কিনে নেন। আজ সেখানেও কেমন এক বিষন্ন বাতাবরণ।
এবারে একটু বাড়াবাড়ি রকমের হলেও, পেঁয়াজের দাম বাড়ার ট্রেন্ডটা কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই। ২০১৭-র ডিসেম্বর থেকেই পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে থাকে। তারপর ২০১৮-র সেপ্টেম্বরে এক ধাপে অনেকটা। ঠিক এক বছর পর, ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর, মাথায় হাত ক্রেতার। পাইকারি বাজারেই দাম ৮০ টাকা প্রতি কিলো। খুচরো বিক্রেতারা কী করবেন? শোনা যাচ্ছে, প্রয়োজনের তুলনায় যোগান কম, এটাই নাকি পেঁয়াজকে এমন দুর্মূল্য করে তুলেছে। কিন্তু কেন? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়।
জেনে রাখুন, বিশ্বে ভারত হলো পেঁয়াজ উৎপাদনে দ্বিতীয় বৃহত্তম। আর ভারতে উৎপাদিত ৪৫ শতাংশ পেঁয়াজ আসে মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটক থেকে। আমাদের রাজ্যেও পেঁয়াজ উৎপন্ন হয়। তবে তার পরিমাণ এমন নয় যে রাজ্যের চাহিদা মেটে, ফলে ভিন রাজ্য থেকে সরবরাহ করতেই হয়। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোল্ড স্টোরেজে পণ্যের ঘাটতি, অস্বচ্ছ (তোলা ইত্যাদি) পরিবহন ব্যবস্থা, পেট্রোল-ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি, এসব পার হয়ে খোলা বাজারে পৌঁছনো - এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবেই পেঁয়াজের দাম আকাশ ছুঁয়েছে।
আরও পড়ুন: দুর্গাপূজা অনুদান: আজ না হোক কাল, হিসেব হবেই
তবে সবচেয়ে বড় কারণ হলো লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম উৎপাদন। সর্বাপেক্ষা বেশি পেঁয়াজ উৎপাদনের রাজ্য মহারাষ্ট্রে অতি বৃষ্টি ও বন্যা পরিস্থিতির জন্য এবারে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে অনেকটাই। বাজারে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা পেঁয়াজের পুরোনো স্টক। এসব ক্ষেত্রে দালাল ও অসাধু চক্রেরও একটা ভূমিকা থাকে। বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে তারা মুনাফা লোটে। মাল আটকে রেখে কালোবাজারে বেশি দামে বিক্রি করে। একদিকে চাষি তাঁর ফসলের যথাযথ মূল্য পান না। অন্যদিকে ক্রেতাও ন্যায্য মূল্যের অনেক বেশি দিয়ে পণ্য কিনতে বাধ্য হন। বিশেষত খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে ক্রেতাকেই সবসময় আপোষ করতে হয়।
কেন্দ্রীয় কৃষি দফতর জানাচ্ছে, তারা চেষ্টা করছে এই অসাধু চক্র ভেঙে দিয়ে বাজারে একটা সঠিক মাপকাঠি প্রণয়ন করতে। কোল্ড স্টোরেজে পেঁয়াজের স্টক বাড়ানোর ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। চাষিরা যাতে তাঁদের ফসলের সঠিক মূল্য পান, সেটাও দেখা হচ্ছে। এর ফলে কিছুদিন হয়তো ক্রেতারা খানিকটা অসুবিধের সামনে পড়বেন। কিন্তু সেটা সাময়িক। পেঁয়াজের দাম খুব শিগগিরই কমবে বলে আশা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বাফার স্টক থেকে নাফেদ ও এনসিসিএফ (ন্যাশনাল কোঅপারেটিভ কনসিউমার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া)-র মাধ্যমে অনেকটাই কম দামে পেঁয়াজ বিক্রির চেষ্টা করছে কেন্দ্র। যা সত্যি লোভনীয়, ২২/২৩ টাকা কিলো। মাদার ডেয়ারির সফল স্টোরে ২৩.৯০ টাকা। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা যৎসামান্য বলা যায়। এই লেখা জমা দেওয়ার সময় খোলা বাজারে দিল্লী, মুম্বই, কলকাতায় পেঁয়াজ ৮০ টাকা কিলো। চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুতে ৬০ টাকা। হায়দরাবাদে অবশ্য অনেকটা কম, ৪১ থেকে ৪৬ টাকা।
আরও পড়ুন: রানাঘাটের নাইটিঙ্গেল, এক হঠাৎ তারার কাহিনি
এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ জরুরি। গত বছর মে মাসে প্রবল গরম, এবং তারপর অতিবৃষ্টি ও বন্যা। মহারাষ্ট্রের কৃষকরা তাঁদের নষ্ট হয়ে যাওয়া শস্য রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হন। বিশাল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন তাঁরা। আত্মহত্যাও করেন কেউ কেউ। সেই সময় এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে কেউই গ্রাহ্য করেন নি। সরকারের পক্ষ থেকে যেমন অবহেলা ছিল, কৃষকদের কথা ভাবাই হয় নি। ক্রেতারাও তার প্রতিবাদ করেন নি কোথাও। দিবারাত্র খেটে মাঠে ফসল ফলান যাঁরা, যাঁদের অবদানে আমাদের ক্ষুধার নিবৃত্তি, তাঁদের খবর তো সত্যি রাখি না আমরা। তাদের জীবন ও বেঁচে থাকা নিয়ন্ত্রণ করে হয় দালাল নয় রাজনীতির প্রতিভূরা। কৃষক তাঁর ফসলের ন্যায্য দাম পেলে, মাঝখানে দালালরা না থাকলে, বাজার আগুন হতো না। এই অতি সরল সত্যিটা ফিরে ফিরে আসে। আমরা অসহায় হয়ে দেখি।
অন্যদিকে প্রকৃতিও প্রতিকূল। এ বছর পেঁয়াজের এই আগুন দাম যেন প্রকৃতিরও প্রতিশোধ। মজার কথা হলো, আজ যা কিনতে ছ্যাঁকা লাগছে, কাল তা অভ্যাসে পরিণত হবে। এরপর পেঁয়াজকুল দামে সেঞ্চুরি করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর এই অবাক না হওয়াটাই ক্রেতার পক্ষে সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। দ্রব্যমূল্য, বিশেষত খাদ্যপণ্য বৃদ্ধির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ভুলে আমরা নানা হুজুগে মেতে থাকি। হঠাৎ একদিন টনক নড়ে, তারপর যে কে সেই। উল্টোদিকে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দল, তাদের তো এসব নিয়ে মোটেই ভাবার সময় নেই। দালালচক্র রুখবে কে? ভূত তো পেঁয়াজ, থুড়ি, সর্ষের মধ্যেই।