Advertisment

বিপর্যয় মোকাবিলা: কী পারা যায়, কী পারা যায় না

কলকাতা পুলিশ মেঘনাদকে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, এটাও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বৃহত্তর স্তরে এই প্রয়োগ ঘটলে, তাতে সমাজই উপকৃত হবে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kolkata police diasaster management

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

মেঘনাদ সরকার। গত কয়েকদিন ধরে কলকাতার বাঁশদ্রোনি অঞ্চলের এই মানুষটি খবরের শিরোনামে। পাতকুয়োয় পড়ে গিয়ে এক যুবকের মর্মান্তিক মৃত্যু এবং পরিস্থিতির কারণে মেঘনাদের দ্বারা ওই যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার। এই 'পরিস্থিতির কারণ' বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যাব পরে। তার আগে মেঘনাদের কথা।

Advertisment

মেঘনাদ নিঃসন্দেহে অত্যন্ত বাহবাযোগ্য একটি কাজ করেছেন। তাঁর সাহস, মনের জোর, স্বার্থহীনভাবে এগিয়ে আসাটা আজকাল অনেকটাই বিরল ঘটনা। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে, কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া বুলবুল ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি। কাকদ্বীপের ঘটনা। ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে গেছে হাতানিয়া দোয়ানিয়া জেটি। ডুবে গেছে দুটি ট্রলার ও একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। সেই সময় কাকদ্বীপেরই কয়েকজন মৎস্যজীবী নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডুবে যাওয়া ট্রলারের দুজন ধীবরকে উদ্ধার করেন। এরই সঙ্গে মৃত মৎস্যজীবীদের দেহ উদ্ধারের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন ওঁরা। প্রসঙ্গত, এখানেও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর সদস্যদের ক্ষেত্রে কাজটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

এই কিছুদিন আগেই খবরে প্রকাশ পায় হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটের একটি ঘটনা। গঙ্গায় এক মহিলাকে ডুবে যেতে দেখে উদ্ধার করার চেষ্টা করে এক কিশোর। সুরজ তাঁতি নামের ওই কিশোর জেটিতে বসেছিল। হঠাৎই ওই মহিলাকে ডুবন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে এগিয়ে যায় সে। এর মধ্যেই ডুবে যান মহিলা। ঘাট পর্যন্ত তাঁকে কোনওমতে টেনে আনে সুরজ। আশপাশের লোকজনও সাহায্য করে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মহিলাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। তা সত্ত্বেও সুরজের  প্রচেষ্টাকে ছোট করে দেখার নয়।

আরও পড়ুন: পুলিশ, প্রশাসন, এবং ভিলেনের মুখোশ

অর্থাৎ এটা বলা যায়, একদিকে যেমন এক আত্মকেন্দ্রিক যাপনের সময় অতিবাহিত করছি আমরা এখন, উল্টোদিকে কিছু মানুষের বিপরীত মনোভাব যে যথেষ্ট ইতিবাচক ভাবনার ইঙ্গিতবাহী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

এবার সেই 'পরিস্থিতির কারণ' নিয়ে আলোচনা করা যাক, যেখানে দমকল বা রাজ্য পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী থাকা সত্ত্বেও মেঘনাদকে কুয়োয় নেমে যুবকের দেহ উদ্ধার করতে হয়। অনেকেই মেঘনাদকে কৃতিত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কাজকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছেন। শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নয়, বেশ কয়েকটি প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমেও বিষয়টা এভাবেই দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে, যেন বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর কর্মীরা চেষ্টাই করেননি ওই যুবকের দেহ উদ্ধারের, অথবা তাঁরা যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ নন। মেঘনাদের কৃতিত্ব এতটুকু খাটো না করেই বলছি, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ক্ষেত্রে যে ধারণা এখানে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যে অভিযোগগুলি উঠছে, তা একশো ভাগ ঠিক নয়। উনিশ-বিশ সাফল্য সব পেশাতেই আছে। এক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য।

বাঁশদ্রোনির ঘটনাটিকে সামনে রেখেই আসুন বুঝে নিই, কীভাবে কাজ করে কলকাতা পুলিশের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ বা ডিএমজি। একটি নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করতে হয় তাদের। ট্রেনিং থেকে শুরু করে নিয়মকানুন, সবক্ষেত্রেই কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। ঠিক কী ধরনের বিপদ বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি তারা হতে পারে. সেটা আগাম বোঝা সম্ভব নয়। মোটামুটি একটা সম্ভাব্য ধারণা রাখা যায় বড়জোর। যেটা সর্বদা বাস্তবের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে না-ও মিলতে পারে। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে অনেক সময়ই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেখানে 'থিওরি'র সঙ্গে 'প্রাকটিক্যাল' মেলে না।

আরও পড়ুন: আজ কা গুন্ডারাজ, আর আমাদের ভাগ্যে কাঁচকলা?

সব সময় মনে রাখতে হয়, অধিকাংশ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি। তৎসত্ত্বেও বলা যায়, যে কোনও বিপর্যয়ের ক্ষেত্রেই ডিএমজি-র কর্মীরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেন। বাঁশদ্রোনির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যে কোনও উদ্ধারকার্যের সময়ই ওঁদের একটি 'স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর' (এসওপি) মেনে চলতে হয়। তারই অনুসরণে এখানেও সন্ধ্যার পর সাময়িক কাজ বন্ধ রাখতে হয়। একে তো আলোর অভাব। তার মধ্যে কুয়োর ভিতরে নামার পথটিও অত্যন্ত সংকীর্ণ। এতে আরও মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিতে পারত। এসওপি-র নিয়ম অনুযায়ী উদ্ধারকারীর নিরাপত্তার বিষয়টিকেও সমান গুরুত্ব দিতে হয়। আর এর যৌক্তিকতাও অনস্বীকার্য। সেই সময় মেঘনাদ, যিনি একজন অভিজ্ঞ পাতকুয়া মিস্ত্রি, এগিয়ে এসে যুবকের দেহ উদ্ধার করেন।

প্রসঙ্গত, কলকাতা পুলিশ তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ইতিমধ্যেই মেঘনাদকে তাদের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীতে সিভিক ভলান্টিয়ারের পদে নিয়োগ করার বিষয়ে ভেবেছে বলে জানা গিয়েছে। যে কোনও বিপর্যয়ে, সে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হোক বা অন্য কারণজনিত দুর্ঘটনা, আঞ্চলিক ভাবে কিছু মানুষকে অনেক সময়ই এগিয়ে আসতে দেখা যায়। কর্মকুশলতার পাশাপাশি এঁদের মধ্যে সাহস ও আত্মশক্তির একটা দিকও থাকে। এঁরা স্বভাব পরোপকারী। নিজেদের ক্ষতির পরোয়া না করেই অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মেঘনাদ তাঁদেরই একজন। এই ধরনের মানুষকে নিশ্চয়ই কুর্নিশ জানাব আমরা। কলকাতা পুলিশ মেঘনাদকে কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে, এটাও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বৃহত্তর স্তরে এই প্রয়োগ ঘটলে, তাতে সমাজই উপকৃত হবে।

কিন্তু তার জন্য দমকল বা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর ভূমিকাকে গুরুত্ব না দিলে চলবে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার দাবী মেনেই এই সংস্থাগুলির যাত্রা শুরু একদা। প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের ব্যাকরণ মেনেই ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছে এদের আধুনিক থেকে আধুনিকতর পরিকাঠামো। এটা এক ধরণের 'ট্রায়াল অ্যান্ড এরর সিস্টেম' বলা যায়। বাস্তব ঘটনার মুখোমুখি হতে হতেই ভুল-ত্রুটি শুধরে নেওয়ার পালা চলে। যে কোনও সার্ভিসের ক্ষেত্রেই এই প্রয়োগ পদ্ধতি প্রযোজ্য। থিওরি এখানে কখনওই শেষ কথা বলতে পারে না। যাকে বলে, মাঠে নামার পরই বোঝা সম্ভব, কোন কৌশল প্রয়োগ করলে জয় আসবে।

আরও পড়ুন: গুরুগিরি: বাঙালি ও ভারতীয়দের ঐতিহ্য

আর একটা কথা হলো টিমওয়ার্ক। সেখানে বোঝাবুঝি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই ব্যক্তি বিশেষের কর্মকুশলতাও সমান জরুরি। এর সঙ্গে প্রযুক্তি ও পরিকাঠামোর যথাযথ ব্যবহার। অর্থাৎ মানুষের হাত-পা-মাথার সঙ্গে যন্ত্রপাতির সমন্বয় সাধন। একজন মানুষের একক সিদ্ধান্তে জলে বা আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার চেয়ে অনেক জটিল বিষয়টি।

এত কিছুর পরও মেঘনাদের মতো মানুষদের কৃতিত্বের উল্লেখও বারবার প্রয়োজন। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনেন ওঁরা। আর একটি সুবিধার দিক হলো, নিজেদের পাড়া, অঞ্চল, কাজের ক্ষেত্রকে হাতের তালুর মতোই চেনেন এঁরা। সরু, অন্ধকার, পিচ্ছিল পাতকুয়োর ঠিক কোন জায়গাগুলোয় পা রেখে নামলে বিপদের সম্ভাবনা কম, সেটা মেঘনাদের পক্ষে জানা যত সহজ, বহিরাগত একজন বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মীর ক্ষেত্রে ততটা নয়। তাঁর ক্ষেত্রে ওই এসওপি মেনেই কাজটা করতে হবে।

একই কথা কাকদ্বীপের জলের মানুষগুলির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁরা ওই জলকে আপন আত্মীয়ের মতোই চেনেন। হয়তো মেঘনাদের  ক্ষেত্রে কলকাতা পুলিশ যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তেমন আরও কোনও মেঘনাদের বিষয়ে ভাববেন কলকাতা, রাজ্য, অন্য রাজ্য বা কেন্দ্রীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ। সংগঠিত বাহিনীর সঙ্গে অসংগঠিত ক্ষেত্রের দক্ষ, সাহসী, পরোপকারী, সমাজ সচেতন মানুষের কাজের মেলবন্ধনে তুলনায় সহজ হয়ে উঠবে বিপর্যয়ের মোকাবিলা। তাতে উপকৃত হব আমরা সকলেই।

kolkata police
Advertisment