Advertisment

নিজে কী খেলেন তার ছবি দিন, তবে অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেও ক্ষতি কী?

এমন অনেকেই আছেন তো, যাঁদের দোকানে জিনিসপত্রের অভাব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করার বিলাসিতাটুকুও নেই। স্রেফ একবেলার খাবার জোটাতে যাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়ছেন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
নিজে কী খেলেন তার ছবি দিন, তবে অন্যের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেও ক্ষতি কী?

দরিদ্র শিশুদের হাতে রংতুলি। ছবি সৌজন্য: কলকাতা পুলিশ/ফেসবুক

লকডাউনের আবহে মন ভালো নেই কারোরই। একথা বলা বাহুল্য। নয় নয় করে দু'সপ্তাহের ওপর হয়ে গেল। বাড়িতে আটক, বন্দীদশা, বেরোতে গেলে হাজারো প্রস্তুতি, বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকতে গেলে তার চেয়েও বেশি। কাজ নেই, দোকানে প্রয়োজনীয় সামগ্রী মনের মতো নেই, ওষুধ নেই, অজস্র হয়রানি।

Advertisment

তবে অনেকসময়ই অন্যের দুর্দশার কথা ভাবলে, বা অন্যের কাজে লাগতে পারলে, নিজের খারাপ লাগাটা একটু হলেও কমে। আজই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার ফেসবুক পেজে লাইভে এসে কতকটা এই কথাই বললেন অভিনেতা দম্পতি দেবলীনা দত্ত মুখার্জি এবং তথাগত মুখার্জিও। মূল বক্তব্য হলো, এই অন্ধকার সময়ে যদি আর মাত্র একজনকেও সাহায্য করা যায়, তাও ঢের।

এমন অনেকেই আছেন তো, যাঁদের দোকানে জিনিসপত্রের অভাব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করার বিলাসিতাটুকুও নেই। স্রেফ একবেলার খাবার জোটাতে যাঁরা দিশাহারা হয়ে পড়ছেন। 'পাঁচ কিলো চাল কিনলে চলবে, নাকি ১০ কিলোই কিনে রাখি' ভাবাটাই যাঁদের কাছে স্বপ্নের মতো। এরকম কারোর দায়িত্ব নিতে পারলে কিন্তু নিজেদের অবস্থাটা কিছুটা হলেও সহনীয় মনে হবে। তখন হয়তো আর নিজের হেঁশেলে আজ কী মজাদার রান্না হলো, তা দিয়ে ফেসবুক ভরাতে মন চাইবে না, বা আজ কী কী গান শুনলাম, তা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে স্কাইপ কল করে সেই ছবি দুনিয়াকে দেখাতে ইচ্ছে করবে না।

lockdown diaries দরিদ্রদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ। ছবি সৌজন্য: কলকাতা পুলিশ/ফেসবুক

শুধু মানুষই কেন, আমাদের চারপাশের পশুপাখিও কি ভালো আছে? যাদের জীবন আমাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আমরা খেতে না দিলে যাদের খাদ্য জুটবে না, তাদের ভালো রাখার দায়িত্বটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে, তা আবহ যেমনই হোক।

কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে কিছুদিন যাবত দেখছি, #পাশেআছিসাধ্যমতো হ্যাশট্যাগ দিয়ে বড় সুন্দর একটি প্রয়াস চালু করেছে তারা। আজ যেমন দেখলাম, অতি দরিদ্র পরিবারের কিছু শিশুদের, "যাদের বাড়িতে না আছে টিভিতে বা কম্পিউটারে কার্টুন-কমিক্স-অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ দেখার সুযোগ, না আছে স্কেচপেন-রংতুলিতে ইচ্ছেমতো ড্রয়িং বুকে আঁকিবুকি কাটার বিলাসিতা", তাদের ছোট ছোট হাতে কলকাতা পুলিশের তরফে তুলে দেওয়া হলো ঘরে বসে খেলার জিনিস, যেমন লুডোর বোর্ড, তারপর ড্রয়িং খাতা, রঙ পেনসিল, ইত্যাদি। সঙ্গে কিছু খাবার।

এই প্রয়াসেরই অঙ্গ হিসেবে আরও দেখলাম, শহরের নানা এলাকায় দৈন্যপীড়িত মানুষের মধ্যে রান্না করা খাবারও বিতরণ করছেন পুলিশ অফিসার-কর্মীরা। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কলকাতার দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষ, দুঃস্থ-দরিদ্র এবং ফুটপাথবাসীরাও। জানলাম, কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে একটি খাদ্য সরবরাহকারী গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে থাকছে রান্না করা খাবার, এবং অন্যান্য পুষ্টিকর শুকনো খাবার-সহ রেশনের প্যাকেট।

lockdown kolkata police অভুক্ত ঘোড়াদের পরিত্রাণ। ছবি সৌজন্য: কলকাতা পুলিশ/ফেসবুক

lockdown kolkata police আমরা খেতে না দিলে যাদের খাদ্য জুটবে না। ছবি সৌজন্য: কলকাতা পুলিশ/ফেসবুক

আর ওই যে পশুপাখিদের কথা বলছিলাম, তাদের কথাও মনে রেখেছেন অনেকেই। যেমন ময়দান ও ভিক্টোরিয়া-সংলগ্ন এলাকায় যেসব ঘোড়ার পিঠে আমোদের জন্য চাপি আমরা, সেইসব এখন বন্ধ। ঘোড়ার মালিকদের রোজগারও বন্ধ, ফলে বন্ধ ঘোড়াদের খাওয়াও, মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল তাদের অনাহারে অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা। এই অবস্থায় রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের সঙ্গে একজোট হয়ে ময়দান এবং হেস্টিংস মাজার এলাকায় ৪১ জন ঘোড়ার মালিককে প্রায় ১৫০টি ঘোড়ার খাবার পৌঁছে দেয় কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের টিম। একই সঙ্গে খেতে পায় শহরের রাস্তায় এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো আরও বেশ কয়েকটি ঘোড়াও। চোখে পড়ল রাস্তার কুকুরদের খাওয়ানোর বেশ কিছু ছবিও।

আবারও একবার বলা বাহুল্য, এগুলোর কোনোটাই কলকাতা পুলিশের দৈনন্দিন কাজের বা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। তবু এই দুঃসময়ে একটা চেষ্টা রয়েছে, কিছুটা হলেও স্বস্তি প্রদান করার। এছাড়াও শহরে একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই কাজই করছে, তবে এইসব প্রয়াসের হয়তো প্রচার কম হচ্ছে, সঙ্গত কারণেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেককে চিনি, যাঁরা নীরবে শহরের একাধিক বস্তিতে গিয়ে খাদ্যসামগ্রী এবং দৈনন্দিন প্রয়োজনের সামগ্রী বিতরণ করছেন, কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল এবং অর্থবল না থাকায় যতটা করতে চান, তা পারছেন না। সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটলে এমন অনেকের সন্ধান পাবেন। জুড়ে যান তাঁদের সঙ্গে, ভালো লাগবে। সবচেয়ে বড় কথা, এই সমাজসেবাতে কিন্তু সরকারের অনুমোদনও রয়েছে, অবশ্যই যথাযথ বিধি মেনে।

অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এই জনসেবার কথা প্রচার করছেন না, নিন্দিত হওয়ার ভয়ে। কারণ একথা সত্যি, চালডাল বিতরণ করে তার ছবি দিলে 'লোকদেখানো' বলে ব্যঙ্গ করার লোকের অভাব নেই। তবে ওই ছবি দেখে যদি আরও পাঁচজন একই কাজ করতে অনুপ্রাণিত হন, তবে ক্ষতি কী? অন্তত নিজে দুপুরে ডিম খেলেন না চিকেন না পর্ক, সেই তুলনায় আরও একটু তাৎপর্য তো বহন করে সেইসব ছবি।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, নিজের পাড়াতেই অন্তত একজনকে পাবেন, যাঁর বাজারটা করে দিলে ভালো হয়, বা রোজগারের অভাবে যাঁর সঠিক খাওয়া জুটছে না। সাহায্য করে দিন, ভালো রাখুন, ভালো থাকবেন নিজেও।

Advertisment