সকালে উঠে খবরের চ্যানেল খুলেই দেখছি, এবারে কালীপুজোর পরে শহরে দূষণের মাত্রা নাকি অনেক কম। বায়ু ও শব্দ, দুই ক্ষেত্রেই। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এই সার্টিফিকেট দানে রীতিমতো অবাকই হই। কারণ আমি নিজেই তো প্রায় সারারাত জেগে। বাজির শব্দ শুনে একবারও মনে হয়নি, পুজো উদ্যোক্তারা কোথাও নিয়ন্ত্রণ মেনে চলছেন। তারপরই দেখি, ও হরি, এ তো রাত দশটা পর্যন্ত দূষণমাত্রার খবর। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মতো বেড়েছে বাজির দাপট। স্বাভাবিক ভাবেই বেড়েছে দূষণের মাত্রাও। খবরেই দেখলাম, শব্দবাজি ফাটানোর অপরাধে মোট ১৭৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রশাসন তার দায়িত্ব পালন করেছে। অন্যদিকে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদও বসে নেই। প্রশাসনকে এই সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানানোর কাজটা নিষ্ঠা সহকারেই পালন করেছে তারা।
তাহলে বিধি ভেঙে দূষণ ছড়াল কারা? কাদের দ্বারা সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের অভাব প্রকট হলো? অবশ্যই আমরা! এখানে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ বা প্রশাসন বড়জোর শাস্তি দিতে পারে। তাতেও অবশ্য নানা সংশয়। আমরা যেটা দেখতে অভ্যস্ত, অপরাধটা হয়ে চলে। ধরপাকড় হয়। তারপর আইনের হাত ধরে ছাড়া পেয়ে যায় অপরাধী। রাজনৈতিক বা অন্যান্য প্রভাবশালী লোকজনের আস্কারা তো নিত্য ঘটনা। বোঝাই যাচ্ছে, এভাবে শুধু আইনের শাসনে দূষণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব।
আরও পড়ুন: সভ্যতা? ভব্যতা? সে কাকে বলে?
ইদানীং সারা বিশ্ব জুড়েই দূষণের উত্তরোত্তর মাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে সার্বিক স্তরে আলোচনা, সেমিনার, প্রচার ইত্যাদি চলছে। সচেতন ও সাবধান না হলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে, তাও মানুষকে বোঝানো হচ্ছে। এই কালীপুজোর কথাই ধরা যাক। যে পরিমান দূষণ ঘটেছে, তাতে একদিকে শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট বাড়বে। চূড়ান্ত শারীরিক ক্ষতি হবে তাঁদের। সবার ওপরেই, বিশেষত, শিশু ও বৃদ্ধদের ওপর, মারাত্মক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এই দূষণ। হার্ট ও উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগে ভুগছেন যাঁরা, তাঁদের জন্যও যথেষ্ট চিন্তাজনক এই পরিস্থিতি।
উৎসব পালনের মধ্যে এখন আনন্দের চেয়ে উল্লাস বেশি। উল্লাস থেকেই শৃঙ্খলা হারানোর প্রবণতা। এই প্রবণতা এতদূর যে আশপাশের মানুষগুলি এর দ্বারা কতদূর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, সেটা জেনেও মনে রাখেন না কেউ। প্রতি বছর কালীপুজোয় শব্দবাজির দাপটে শ্রবণক্ষমতা হারিয়েছে চিরকালের মতো, এমন শিশুর অভাব নেই। ডাক্তারদের মতে, সদ্যোজাতদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব মারাত্মক। বাইরের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যে পরিমাণ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রয়োজন, তা গড়ে ওঠার আগেই তাদের কানের পাশে বাজে ওই বাজি নামক উল্লাসের দামামা। ফল তো খারাপ হবেই।
বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য বাতাসে মিশে যাওয়া, শব্দদৈত্যের হুঙ্কার, তার পাশাপাশি দিবারাত্র মাইকে গান। কিছু কিছু অঞ্চলে নাচাগানাসহ সারারাতের জলসা। প্যান্ডেলের পাশেই হয়তো কোনও পরীক্ষার্থীর বাড়ি। সেসব দেখার কেউ নেই। কোনও কিছুরই বাড়াবাড়ি হলে সেটা বিরক্তির উদ্রেক করে, এটা উদ্যোক্তাদের কে বোঝায়?
আরও পড়ুন: মিলনমেলার সিঁদুর-খেলা, সংস্কারের স্থান কোথায়?
শুধু শব্দ নয়। আলোয় আলোকিত করে তোলে যেসব বাজি, তার মধ্যেও রয়েছে মারাত্মক রাসায়নিক। এই রাসায়নিকের ব্যবহারে এই সময়টায় স্মগের সৃষ্টি হয় আবহাওয়ায়। পরিবেশবিদরা এই স্মগ (ফগ+স্মোক) নিয়ে গত কয়েকবছর ধরেই প্রবল মাত্রায় চিন্তিত। কুয়াশার সঙ্গে ক্ষতিকারক ধোঁয়া মিশে এটা তৈরি হয়। এরই পাশাপাশি বিপুল হারে গাছ কেটে ফেলার ফলে এর বিরুদ্ধে যুঝবার পথটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
আসলে আমরা জেগে ঘুমোই। আমরা সব জেনেও ভাবি, আমার কী? এক্ষেত্রে চেতনার অভাবটা মহামারীর আকার ধারণ করেছে। সকলেই ভাবছেন, আমি ফুর্তি করব, মোচ্ছব করব, তাতে কার কী? উৎসবে দুনিয়াকে জানান দিয়ে উদ্দাম উল্লাসে মেতে ওঠা আমার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। পাশের বাড়ির মানুষটিকে অত্যাচার করে অসুস্থতার পথে ঠেলে দেওয়া যে তাঁর অধিকারের বাইরে, এটা কে তাঁকে বোঝাবে? সমাজের মানুষ হিসেবে তাঁর কিছু দায়িত্ব আছে, এই শিক্ষাটা শৈশব থেকেই হওয়া দরকার তাঁর। এটা নিঃসন্দেহে অভিভাবকদের দায়িত্ব। চেতনাটা তাঁরাই যদি হারিয়ে ফেলেন, তবে পরের প্রজন্ম কী করে শিখবে?
গত কয়েকবছর ধরেই একটা আতঙ্ক, কালীপুজোর দিন না জানি খবরে কী দেখব। বাজির ফুলকিতে আগুন লাগা তো অতি চেনা ঘটনা। এবছরের সংযোজন অত্যন্ত মর্মান্তিক, বেহালার শীলপাড়ায় তুবড়ি বার্স্ট করে মারা গেল সাড়ে পাঁচ বছরের শিশু আদি দাস। তার ঠাকুমাই তুবড়ি জ্বালাচ্ছিলেন। পুলিশি তদন্ত চলছে। ধৃত বাজি বিক্রেতা ও কারিগর। আদির পাশে আরও একটি শিশু ছিল, সেও আতঙ্কিত ও আহত।
অন্যদিকে কসবায় এভাবেই তুবড়ি ফেটে মারা গেছেন চল্লিশ বছরের দীপকুমার কোলে। অনেকেই বলবেন, এগুলো তো নিছক দুর্ঘটনা। নিঃসন্দেহে। তবে অসাবধানতার দিকটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, যে সব উপকরণে বাজি বানানো হচ্ছে, তার উপরে কতটা নিয়ন্ত্রণ থাকে? সে বাজি কেনাই হোক বা নিজেরা তৈরি করে ফাটানো! আমাদের শৈশবেও বাজিতে হাত-পা পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটত। ডানপিটে অবাধ্য বাচ্চা সবকালেই আছে। কিন্তু তখন এত ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহৃত হতো না। মুশকিল হলো, এখন বাজি ফাটানোর মধ্যেও তীব্র প্রতিযোগিতার আঁচ। আক্ষেপ, এতে বড়রাও সামিল হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: দীপাবলির সুখ ও অসুখ
খবরে দেখলাম শব্দবাজি ফাটানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় এক গৃহবধূ ও তাঁর পরিবারের লোকজনকে বেধড়ক মারা হয়েছে। মহিলা আবার সন্তানসম্ভবা। এটি দক্ষিণ ২৪ পরগণার বাসন্তীর ঘটনা। কথা হলো, এত বড় সাহস কী করে পায় এইসব দুষ্কৃতীরা? প্রতিবাদী মহিলার পাশে কি তার প্রতিবেশীরা ছিলেন? আজকাল দেখি, যে প্রতিবাদী, সে-ই একঘরে। দুষ্কৃতীর দল দাপিয়ে বেড়ায়। এক্ষেত্রে কী হবে জানি না এখনও। কিন্তু পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশ যে কোনও শুভ চেতনারই ধার ধারেন না, সেটা পরিষ্কার। এদের অবস্থা ওই পিপু-ফিসুর মতো।
দূষণে জর্জরিত পৃথিবী। এই নিয়ে আলোচনা, প্রচার, নানা পদক্ষেপ গ্রহণ চলছে বিশ্বজুড়ে। চেতনাবিহীন আমরা জেগে ঘুমিয়ে আছি। খবরে এটাও দেখলাম, দীপকুমার কোলে যাঁর কাছ থেকে বাজি কিনেছিলেন, তাঁর লাইসেন্স ছিল না। এক্ষেত্রেও কী মারাত্মক উদাসীনতা ক্রেতাদের। বাজির মধ্যে নানা ধরনের রাসায়নিক দাহ্য থাকে। লাইসেন্সবিহীন বিক্রেতার ওপর কোন যুক্তিতে নির্ভর করছি আমরা?
ভূবিজ্ঞানের নিয়ম মেনে বাংলার ঋতু পরিবর্তন। এই সময়টাতেই পুরাণ মতে তিথি মেনে কালীপুজোর আয়োজন। শৈশবে বাড়িতে বড়রা বলতেন, বাজি পোড়ানো বা ফাটানোর রীতি চালু হয় এই সময় বাতাসে উড়ে বেড়ানো রোগজীবাণু বিনাশ করার জন্য। কথাটা শুনে খুব আপ্লুত হয়েছিলাম, মনে পড়ে। এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে কিনা জানি না। তবে হিন্দুশাস্ত্রের নিয়মকানুনের মধ্যে বেশ কয়েকটির বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে মেলে। সব নিয়মই মানুষের মঙ্গল কামনায়।
কিন্তু আমাদের চেতনাই যে দূষণ জর্জরিত হয়ে পড়েছে। শাস্ত্র নিয়ে হইচই, হুজুগ রয়েছে। কিন্তু বিবেচক পদক্ষেপ নেই। আমরা ভাবনার জগৎ থেকে যুক্তি, বিবেচনা, উচিত-অনুচিত বিষয়গুলিকে বিদায় জানিয়েছি। ভাবছি না, মহামারীর হাত থেকে কেউই বাঁচে না। আজ আমি যার কথা অগ্রাহ্য করছি, কাল সেও একই আচরণ করবে। একটা বোধ ও চেতনাযুক্ত সমাজ সবার প্রয়োজন। আর এ ব্যাপারটা শুরু করতে হবে ঘরের চার দেয়ালের ভিতরেই।