পরিবারের পরিধির বাইরে এক অন্য পৃথিবী। শুধু পরিবার নয়, পাড়া-প্রতিবেশী থেকেও অনেকটা দূরের অদেখা, অচেনা এক পটভূমি। স্বাভাবিক ভাবেই কিছুটা দ্বিধা নিয়েই সেখানে পা রেখেছিল সে। চোখে একরাশ স্বপ্ন। স্বপ্ন নিজের এবং বাবা-মায়ের। কত আশা, কলকাতার বড় কলেজে পড়াশোনা করে, সেই স্বপ্ন ও আশা পূর্ণ করবে সে।
হৃষীক কোলে। সিঙ্গুরের এই কিশোরের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তার জীবনের চলা থেমে গেছে শুরুতেই। শূন্য হয়েছে তার বাবা-মায়ের বুক।
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র হৃষীকের আত্মহত্যার ঘটনা আরও একবার আমাদের আলোড়িত ও বেদনাহত করে। দাঁড় করিয়ে দেয় নানা প্রশ্নের মুখে। ঠিক কোন বিন্দুতে পৌঁছে একটি এই বয়সী ছেলে একেবারে তার বাঁচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলে? কখন তার মন এক নিশ্চিন্ত আশ্রয় হারায়? কোন অবস্থায় সে সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়? এ সমাজ তাহলে তাকে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম! এমন কী ঘটে যখন নিজের ও পারিপার্শ্বিক, সবের ওপরেই বিশ্বাস হারিয়ে মৃত্যুকে বেছে নেয় সে?
হুগলি জেলার সিঙ্গুর। এখান থেকেই কলকাতায় পড়তে এসেছিল হৃষীক। সুইসাইড নোটে খুব প্রাঞ্জল ভাষাতেই সে জানিয়ে গেছে তার সমস্যা, যন্ত্রণার কথা। কলেজে ক্লাস ফলো করতে তীব্র সমস্যা হচ্ছিল তার। ইংরেজি মাধ্যমে অনভ্যস্ত হৃষীকের ক্লাস লেকচার বুঝতে অসুবিধা হতো। ইংরেজিতে কথা বলার সমস্যাও নাকি ছিল। মাঝে মাঝেই বন্ধুদের একথা বলেছে সে। পছন্দের বিষয় অঙ্ক নয়,পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে বাধ্য হয় হৃষীক, এটাও ছিল ক্ষোভের একটা কারণ।
আরও পড়ুন: আমাদের সমাজ কি ধর্ষণকারীর স্বর্গরাজ্য নয়?
তথ্যসূত্র বলছে, হৃষীক তার ক্লাসের পড়া বুঝতে না পারার কথাটা মা-বাবাকে জানাতে ভয় পেত। অভিভাবককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু হৃষীক বা তার মতো আরও অনেকের মনের প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গেলে কিছু অপ্রিয় সত্য উঠেই আসে। ক্লাস ফলো করার অসুবিধার কথাটা হৃষীক যদি মা-বাবাকে জানাতে ভয় না পেত, তাহলে তাঁরা হয়তো বুঝিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে সাহায্য করে ছেলের অসুবিধা দূর করলেও করতে পারতেন। এটাও হতে পারে, বিষয় পছন্দ নয়, তাই ভালো লাগাটা তৈরি হতে পারছে না! বাবা-মাকে ভয়ে বলতে পারছে না। ভয় বা দ্বিধা, সংশয় ও অস্বস্তি, এগুলোই তো বয়ঃসন্ধির একটি ছেলে বা মেয়ের অভিভাবকদের সঙ্গে দূরত্বটা তৈরি করে।
এ দূরত্ব কখনও কখনও অনতিক্রম্য হয়ে যায়। যা কিনা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, সর্বনাশী এক প্রক্রিয়ার শুরুয়াত। বিশেষত যখন সে মা-বাবার কাছ থেকে দূরে এক অচেনা পরিবেশে থাকতে গেছে প্রথমবারের জন্য। পড়া না বোঝার অসুবিধা ছাড়াও মফঃস্বলের একটি ছেলের পক্ষে কলকাতার মতো মেট্রো শহরে মানিয়ে নেওয়ার আরও অনেক সমস্যাও থাকে। কিছুই সে কোথাও জানাতে পারছে না। যোগাযোগের এবং বোঝাবুঝির এই ফাঁক এধরনের ঘটনা ঘটার একটা বড় কারণ নিঃসন্দেহে।
এদেশের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বলতে গেলে শব্দে কুলোবে না। বিস্তারে না গিয়েও বলা যায়, এখানে
এখনও শুধুই কেরিয়ার গঠনের জন্য ডিগ্রী আহরণ করা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। ব্যক্তিত্বের বিকাশ বা
পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি চরম অবহেলিত। বাস্তব জীবনটা কিভাবে ভবিষ্যতে
যাপন করবে সে, তার সঙ্গেও এই তথাকথিত কেরিয়ারমুখী শিক্ষার কোনও সম্পর্ক থাকে না। অথচ ভালো
রেজাল্ট করার চাপটা প্রবল হয়। এখানে সামাজিক ভাবেও বড়রা ছোটদের পাশে থেকে সাহস ও বিশ্বাস যোগানোর কাজটা দায়িত্ব নিয়ে করেন, এটা বলা যাবে না। যা কিনা খুবই জরুরি।
আরও পড়ুন: জয়া মিত্রের কলাম: জল মাটি (প্রথম পর্ব)
আমরা আমাদের শৈশবে, কৈশোরে এটা পেয়েছি। শিক্ষক, অভিভাবক থেকে চেনাজানা মানুষ - শিখতে বা বুঝতে চাইলে সহমর্মিতার অভাব হয়নি কখনও। এখন ছেলেমেয়েদের সামনে রেখে মা-বাবারা প্রতিযোগিতায় নামেন। এর থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?
এক দেশ এক শিক্ষাব্যবস্থা এক্ষুনি হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু ন্যূনতম সমন্বয় সাধন কি করা যায় না? ইংরেজি মাধ্যম বনাম বাংলা মাধ্যম। ব্র্যান্ডেড স্কুল বনাম সাধারণ স্কুল। গ্রামের স্কুল এবং শহরের স্কুল। সরকারি বনাম বেসরকারি স্কুল। কত রকম যে ভেদাভেদ! হৃষীকের মতো অনেকেই এই বিভেদের বিষময় ফলের শিকার। তার এলাকারই একটি স্কুলে পড়েছে মেধাবী ছাত্র হৃষীক। উচ্চ মাধ্যমিকে ৯২ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে সে। কিন্তু পড়ানোর পদ্ধতি ও পরিবেশ? মফস্বলের একটি স্কুলের সঙ্গে সেন্ট জেভিয়ার্সের তফাৎ কতটা হতে পারে, এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
প্রশ্ন, এমন সমস্যা তো অনেকেরই হয়, সবাই কি আত্মহত্যা করে? জবাবটা লুকিয়ে প্রশ্নের মধ্যেই। সবাই একরকম মানসিকতার হয় না। ক্লাসে পড়া বুঝতে না পারার কারণে প্রতি মুহূর্তে যে বিষয়গুলি হৃষীকের চেতনায় আঘাত করছিল, তার মধ্যে নিঃসন্দেহে হীনমন্যতা বোধটাই প্রধান। "সবাই পারছে, আমি পারছি না", এই একটা ভাবনা কুরে কুরে খাচ্ছিল তাকে। পাশাপাশি অকৃতকার্য হওয়ার ভয়, বাড়িতে কী বলবে? সঙ্গে সহপাঠীদের কাছে লজ্জা !
অথচ, এই সমস্ত ভাবনা থেকেই মুক্ত রাখা যেতে হৃষীককে। হৃষীক এবং তার মতো হতাশ এমন ছেলে বা মেয়েকে। একটু সহমর্মিতা, একটু সাহায্যের হাত কেউ বাড়িয়ে দিলেই হয়তো সে তার হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস
ফিরে পেত। সেই উষ্ণ হাতের ছোঁয়াটা পায়নি হৃষীক। একা একা ভয়, দুশ্চিন্তা, অশান্তিতে দগ্ধ হয়েছে এই
তরুণ। বেছে নিয়েছে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পথ। ওই মুহূর্তে ওটাই তার নিষ্কৃতির উপায় বলে মনে হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ইংরেজি ও বাংলা মাধ্যমকে ঘিরে যে জটিলতা ও বিতর্ক, সেটা কিন্তু নতুন নয়। বাংলা মিডিয়ামে স্কুলে পড়ে, কলেজে গিয়ে ইংরেজিতে লেকচার ফলো করতে শুরুতে আমাদেরও অসুবিধা হয়েছে। কিন্তু তার জন্য হীনমন্যতায় ভুগিনি কখনও। কারণ, আমাদের শিক্ষক ও সহপাঠীদের ব্যবহারে কোনও তারতম্য পাইনি কোনও সময়। বাড়িতেও অভিভাবকদের মধ্যে এটা দেখিনি যে, ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেই জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে। পড়াশোনাটা ভালো করে করতে হবে, সেটাই ছিল আসল কথা। ইংরেজি ভাষাটা জানা দরকার, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আবশ্যক, এটাও পাশাপাশি বুঝিয়ে দেওয়া হতো। তার জন্য মাতৃভাষা শিখবই না, এটা ভাবতেই পারতাম না আমরা। এখন অনেক মা-বাবাই খুব গর্ব করে বলেন শুনি, "আমার ছেলেটা (বা মেয়েটা) না, বাংলা পড়তেই পারে না"।
আরও পড়ুন: জন ও স্বাস্থ্য: গ্রামীণ চিকিৎসক
আজ্ঞে হ্যাঁ, এটা অবশ্যই একটা বিবেচ্য বিষয়। শিকড় ওপড়ানোর ঘটনাটি এখান থেকেই ঘটে। এখান থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে হীনমন্যতা বোধটির জন্ম হয়। যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়েছে আর যারা পড়েনি, দু'পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট একটা দেওয়াল উঠে যায়। হৃষীকরা এভাবেই তথাকথিত পিছিয়ে থাকার দলে চলে যায়।
বলা বাহুল্য, এই হীনমন্যতা দূর করার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায়িত্ব প্রথমেই। সন্তানের ব্যক্তিত্বের
বিকাশ এমনভাবে ঘটানোর চেষ্টা করুন, যাতে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলায় সক্ষম হয় সে। বন্ধুরা
হাসাহাসি করুক বা শিক্ষকেরা অবহেলা, তার নিজের এতে ছোট হওয়ার কিছু নেই। মেধা, বুদ্ধি, চর্চার মাধ্যমে
নিশ্চয়ই এই সামান্য অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে পারবে সে আগামীতে, এই বিশ্বাসটা দিতে হবে তাকে।
যাঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা তথাকথিত ব্র্যান্ডেড বা ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে, তাদের অভিভাবকদেরও সন্তানদের কিছু বোঝাবার আবশ্যিক দায় আছে। অপরকে ছোট করে নিজে বড় হওয়ার প্রক্রিয়াটা আসলে একটা সামাজিক অসুস্থতা। একজন যথার্থ মানুষ হতে গেলে এই সচেতনতার শিক্ষাটা জরুরি। এছাড়া, কেরিয়ার বা রেজাল্ট নিয়ে ভয় দেখানো নয়, এটা অত্যন্ত নেতিবাচক একটা প্রক্রিয়া।
সব শেষে শিক্ষকের দায়িত্বও কম নয়, বলাই বাহুল্য। শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে জাতির ভবিষ্যৎ, এই দর্শন আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ। সব ছাত্রের বোঝার ক্ষমতা সমান নয়। তার অসুবিধা ও
সমস্যা বোঝা জরুরি। ছাত্রদের সঙ্গে এটুকু সংযোগ স্থাপন করতেই হবে তাঁদের। মাথায় হাতটা রাখা দরকার।
বিশেষত যখন কোনও না কোনও কারণে বিপর্যস্ত সে। বিশ্বাস ও ভরসা যোগাতে হবে। শিক্ষকরা এ দায়িত্ব না
নিলে একটি আত্মবিশ্বাসী ও পরিণতমনস্ক, সামাজিক বোধসম্পন্ন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কী করে পাব আমরা?