আমরা আর কবে সভ্য হব? আর কবে আমরা আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকে ভাবব, 'কলকাতা, তোর কাপড় কোথায়?'
কালীপুজো আর দিওয়ালির গত দুটো দিন-রাত যে অনেকটাই বেআব্রু করে দিয়ে গেল শহরকে! বুঝিয়ে দিয়ে গেল, 'তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার শব্দবাজিই চাই'। তীব্রতার নিরিখে অন্য বছরের তুলনায় নিশ্চিতভাবে কম, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সময়সীমার নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ফাটল তো চকলেট-দোদোমা-পটকা। 'বেশ করব ফাটাব, যা পারিস করে নে'-র নিঃসীম ঔদ্ধত্য নিয়ে।
কে কী করবে এই ঔদ্ধত্যের মুখোমুখি, কে কী করবে এই নিয়ম ভাঙ্গার মজ্জাগত রোগ নির্ণয়ে? পুলিশ-প্রশাসন? চেষ্টা করেছে যথাসাধ্য। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ? চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না তাঁদেরও। পরিবেশ কর্মীরা? লড়েছেন আপ্রাণ। কিন্তু দিনের শেষে, রাতের শেষে, আইন মানে নি শহরের একটা বড় অংশ। আগুন দিয়েছে বারুদে।
আরও পড়ুন: শবরীমালার তাণ্ডবেও অম্লান নারীশক্তির আরাধনা
সব কিছু আইন দিয়ে হয় না। সব কিছু পুলিশ দিয়ে হয় না। সব কিছু আদালতের আদেশ দিয়ে হয় না। হলে এতদিনে দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ হয়ে যেত। শিশুশ্রমের নাম কেউ শুনত না। কন্যা ভ্রূণহত্যা থাকত শুধু ইতিহাসের পাতায়। হয় না, আইন দিয়ে হয় না সব। হলে শবরীমালা সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করা যেত। মন্দিরে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে নারীর একমাত্র পরিচয় হত না তার যোনি-চিহ্ন।
আসল কথা হোল বোধ। আসল ব্যাপার হল সচেতনতা। যা জাগ্রত না হলে সুপ্রিম কোর্ট কেন, পৃথিবীর কোন কোর্ট কিস্যু করতে পারবে না, আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে কাঠগড়ায় তোলা হবে সরকারি সংস্থাকে, সে পুলিশই হোক বা দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। যাক, বলির পাঁঠা তো একটা-দুটো পাওয়া গেছে, আমার তো কিছু যায়-আসছে না, এই পরম স্বস্তি নিয়ে রবিবারের মাংস-ভাতে ডুব দেবে শহুরে মনন।
মুশকিল শুধু এই, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। যতক্ষণ না শব্দবাজির বিরুদ্ধে সংগঠিত নাগরিক জনমত গড়ে না তোলা যাবে, যতক্ষণ না 'শিয়রে শমন' অনুভব করবে আমজনতা, ততক্ষণ কিছু হওয়ার নয়। চিন্তা হয়, কবে আসবে সেই বোধ, যখন পাড়ার কাউকে শব্দবাজি ফাটাতে দেখলে রুখে দাঁড়াবেন পাড়ারই বাকিরা, পুলিশের বা প্রশাসনের উপর স্বভাবসিদ্ধ দায় না চাপিয়ে দিয়ে? কে জানে কবে কোন মূল্যে সচেতন হবে এই শহর, তবে দ্রুত না হলে 'শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর' !
নীরেন্দ্রনাথের অমর কবিতায় 'উলঙ্গ রাজা'-কে দেখে কেউ কিছু বলেনি। একটি শিশু শুধু সাহস দেখিয়েছিল বলার, 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়?'
নিশ্চিত থাকুন, যে ভাবে বছরের পর বছর চলছে বেপরোয়া শব্দ-শিহরণ, প্রশ্ন ওঠার সময় আসছে দ্রুত, 'কলকাতা, তোর কাপড় কোথায়?'