ডিসেম্বর মাস ছিল প্রতিবাদের মাস। দিল্লিতে, আলিগড়ে, কলকাতায়, সারা দেশ জুড়ে। সেই প্রতিবাদ চলছে এখনও। ভারতের অসংখ্য নাগরিকের অস্তিত্ব মুছে যাওয়ার আশঙ্কায় প্রতিবাদ, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এখন পর্যন্ত সেই লড়াইয়ের বলি হয়েছেন বেশ কিছু ভারতীয়। এ নিয়ে নিত্যদিন তোলপাড় সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া, রাজনৈতিক নেতা, সরকারি মন্ত্রীরা।
অথচ ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে রাজস্থানের কোটা শহরে এক হাসপাতালের একটিমাত্র বিভাগে যে ১০০ টির বেশি প্রাণ গেল, তা নিয়ে তেমন কেউ কিছু বললেন না এখনও। বিশেষ করে যেখানে শহরের সাংসদ আবার খোদ লোকসভার অধ্যক্ষ ওম বিড়লা। এবং এখনও থামে নি সেই মৃত্যুমিছিল। এই প্রতিবেদন লেখার সময় ১০০ বেড়ে হয়েছে ১০৭, যা আরও বাড়তেই পারে, কুছ পরোয়া নেই।
কাদের মৃত্যুর কথা বলছি, এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয়ই। কোটার জে কে লোন গভর্নমেন্ট হসপিটালে শুধুমাত্র ডিসেম্বর-জানুয়ারি মিলিয়েই মৃত্যু হয়েছে ১০০-র বেশি শিশুর। এবং হাসপাতালের নথি বলছে, ২০১৪ থেকে এই হাসপাতালে গড়ে প্রতি বছর মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১,০০০ শিশুর। সদ্যসমাপ্ত বছরের কথাই ধরুন না। জানুয়ারি মাস থেকে প্রতিমাসে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৬০টি শিশুর, কখনও কখনও সেই সংখ্যা ১০০ ছুঁইছুঁই - অগাস্ট (৮৭), সেপ্টেম্বর (৯০), অক্টোবর (৯১), নভেম্বর (১০১), ডিসেম্বর (১০০)। কোনও ময়নাতদন্ত হয়নি এইসব মৃত্যুর, বলা হয়েছে, সন্দেহজনক ছিল না একটিও।
আরও পড়ুন: জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য
অর্থাৎ, এমাসে মিডিয়ার নজরে না পড়লে অবাধে চলত ছোট ছোট লাশের মিছিল। এই একই চিত্র ২০১৭ সালে পাওয়া যায় বিহারের গোরখপুরে, যেখানে এক বছরে ৯৬৩ জন শিশুর মৃত্যুর পরেই মিডিয়ায় ওঠে আলোড়ন, অতএব টনক নড়ে প্রশাসনের। এবং গত বছরের মাঝামাঝি বিহারেরই মজফফরপুরে অ্যাকিউট এনকেফেলাইটিস সিনড্রোমে একমাসের মধ্যে ১৫০-র বেশি শিশুর মৃত্যুর কথাও নিশ্চয়ই অনেকেরই মনে আছে। দুই জায়গাতেই দীর্ঘদিন ধরে নথিভুক্ত হয়ে আসছে একাধিক শিশুমৃত্যুর খবর, অথচ কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করেন নি।
এর মানে কী জানেন? মৃত্যুর সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট সীমা না ছাড়ালে তা কারোর নজরে পড়ে না। মজফফরপুরে দিল্লির এইমস-এর একটি দল তদন্ত করতে গিয়ে আবিষ্কার করে, অঞ্চলটিতে জল নিকাশি ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। নেই ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করে মৃত শিশুদের পরিবারগুলি, এবং গত ১০ বছরে একই রোগে ১,৩৫০ জন শিশু মারা গেছে সেখানে। কেন কারোর নজরে পড়ে নি তা? একসঙ্গে ১৫০ শিশুর মৃত্যুর তুলনায় 'কম গুরুত্বপূর্ণ' বলে?
পরিকাঠামোর ভয়াবহ দুরবস্থা এ দেশে নতুন কিছু নয়। কোটার হাসপাতালে যেমন দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল জরুরি উন্নয়ন এবং মেরামতির কাজ। মজার কথা হলো, ব্যাপক হারে শিশুমৃত্যুর খবর ছড়ানোর পর হাসপাতালে সরকারি কর্তা এবং মন্ত্রীদের পদধূলি পড়তে না পড়তেই জোরকদমে প্রায় রাতারাতি সেজে উঠেছে জরাজীর্ণ হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। এমনকি পেতে ফেলা হয়েছিল লাল কার্পেটও। পরে ভিডিও তোলা হচ্ছে বুঝে তা সরিয়ে ফেলা হয়।
আরও পড়ুন: নারীর ‘শত্রু’ যখন নারীই, ভবিতব্য অসম্মানই
ইতিমধ্যেই মর্মান্তিক এই ঘটনা নিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি। বর্তমান কংগ্রেস সরকার বলছে, এর আগের পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালের কোনও উন্নতি করেনি বিজেপি সরকার। অন্যদিকে বিজেপির প্রশ্ন, নিজেদের ১৩ মাসের শাসনকালে কোনও পদক্ষেপ কেন নিল না কংগ্রেস? এই ক্লান্তিকর দোষারোপ পাল্টা-দোষারোপের খেলাও নতুন নয়। রাজস্থানের বর্তমান সরকার তো সাফাই গেয়েই রেখেছে - এবারের মৃত্যুর সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় এমন কিছুও আহামরি নয়। ২০১৯-এ যদি ৯৬৩টি মৃত্যু হয়ে থাকে, তবে ২০১৪ (১,১৯৮), ২০১৫ (১,২৬০), ২০১৬ (১,১৯৩), ২০১৭ (১,০২৭) এবং ২০১৮ (১,০০৫) কম কিসে? বরং বেশিই! অতএব কসুর মাফ।
একদিকে হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগ বলছে, তাদের অধিকাংশ যন্ত্রপাতিই সচল এবং সক্রিয়, এবং একটি মৃত্যুও প্রয়োজনীয় ওষুধের ওভাবে ঘটেনি। অন্যদিকে রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষা দফতরের সচিব স্বীকার করে নিয়েছেন যে সমস্যা একাধিক, যেমন যন্ত্রপাতির অনুপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং অক্সিজেন লাইনের ঘাটতি। হাসপাতালও এটুকু স্বীকার করেছে যে তাদের নার্সিং কর্মী প্রয়োজনের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। রুগীদের মুখে মুখে ফেরে হাসপাতালের কর্মীদের ঔদাসীন্য এবং সংবেদনশীলতার অভাবের কাহিনি।
এখন হয়তো হুড়মুড় করে একসঙ্গে নেওয়া হবে একাধিক পদক্ষেপ। পূরণ হবে অনেক ঘাটতি। কিন্তু এর প্রয়োজন হবে কেন? কেন ধরেই নিতে হবে যে, অসহায়, অসুস্থ শিশুদের চিকিৎসার ভার যাঁদের হাতে, তাঁরা একমাত্র ভয় দেখালেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন? মানবিকতার তাগিদে নয়?
এইসব প্রশ্ন আগেও ওঠে নি এমন নয়। বিহার-রাজস্থান ছাড়ুন, আমাদের পশ্চিমবঙ্গেই ২০০২ সালে বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালে চারদিনে ১৮টি শিশুর মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছিলেন, "এক দিনে ১০ জন শিশু মারা যাওয়াটা নতুন বা অস্বাভাবিক কোনও ঘটনা নয়।"
সেসময় কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের পরিকাঠামো ব্যবস্থার ত্রুটির কথা উল্লেখ করেন, বলেন যে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও বেড-এর অভাব প্রকট ছিল। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা যাবে না, এমনই নির্দেশ ছিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীর। তারও আগে, ২০০০ সালে, কোনও অজ্ঞাত কারণে ওই একই হাসপাতালে ৪১ জন শিশু মারা যায়, স্রেফ সেপ্টেম্বর মাসেই।
আরও পড়ুন: ওরে, আমার পেঁয়াজ গিয়েছে চুরি!
অতএব আমাদের দেশের এটাই ট্র্যাডিশন, এটাই প্রথা। সুতরাং বছরের পর বছর আমরা এটা মেনে নেব। নিজেদের নাগরিকত্ব বাঁচাতে অবিরাম মিছিল করব, কিন্তু ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্য কুটোটিও নাড়ব না। অনেকেই হয়তো জানেন না, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার ভারতে প্রতি ১,০০০ জনের মধ্যে ৩৯ জন। যা নেপাল ও বাংলাদেশের মতো দেশের চেয়েও বেশি, যাদের তুলনায় নিজেদের উন্নত মনে করি আমরা। ভারতে কেরালা ও গোয়াতে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে কম, তুলনা করা যায় ইউরোপের দেশগুলির সঙ্গে। শিশুমৃত্যুর হার বেশি মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, বিহারে। কম যায় না উত্তরপ্রদেশও।
দারিদ্রের বিরুদ্ধে নিত্যদিন হাড়ভাঙা লড়াই লড়েন এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করাটাই বিলাসিতা। তাঁদের সন্তানদের লালনপালনের ভার রাষ্ট্র না নিতে পারে, কিন্তু ন্যূনতম চিকিৎসার ভারও সমাজ এবং সরকার নেবে না কেন? বছরের পর বছর আর কতজন শিশুর মৃত্যু হলে আমাদের মনে হবে, "আর নয়, যথেষ্ট হয়েছে, এবার কিছু করা উচিত"? কেন স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা, যে দুটি হওয়া উচিত সমাজের দুই মূল স্তম্ভ, এত অবহেলিত আমাদের দেশে?
আমাদের সরকার বা নেতা-মন্ত্রীরা তো আমাদেরই প্রতিফলন, আমাদের সমাজ থেকেই উঠে আসা, সুতরাং তাঁদের আচরণে নিজেদের আচরণের প্রতিবিম্ব দেখব আমরা, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের আসল রোগ হলো অমানবিকতা, যা কোনও হাসপাতাল সারাতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন সচেতনতার, সমব্যথার। এবং সেই মনোভাব দ্বারা চালিত হয়ে সরকার এবং তার প্রতিনিধিদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার। নইলে এমন দেশের নাগরিকত্ব পাব আমরা, যে নাগরিকত্ব গর্ব আনে না, আনে লজ্জা।